২০১৫ সালে তিনি যখন আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে এলেন, দুনিয়া স্রেফ অবশ হয়ে গিয়েছিলো।
কাটার, স্লোয়ার, ইয়র্কার; এর আগে মানুষ কখনো দেখেনি, তা তো নয়। এই বাংলাদেশেই মাশরাফি বিন মুর্তজার মত কাটার স্পেশালিস্ট ছিলেন। লাসিথ মালিঙ্গার মত ইয়র্কার স্পেশালিস্ট দেখেছি আমরা। চামিন্দা ভাসের মত পেস ভেরিয়েশন আমরা দেখেছি। তাহলে মুস্তাফিজ কেনো বিশ্বের বিষ্ময় ছিলেন?
আরো পড়ুন
- মুস্তাফিজ ধাঁধার বিবর্তন
- বাংলাদেশি পেসারদের ‘সেকেন্ড ওয়েভ’
- মুস্তাফিজ ২.০
- না হয় ভালোবাসার যজ্ঞে অভিষেক আহুতিটা দিয়ে দেব
- পেস বোলিংয়ের ভবিষ্যত দেখছেন ওটিস গিবসন
কারণ, মুস্তাফিজের মত করে এই কাজগুলো একসাথে এর আগে কেউ করেননি দুনিয়ায়।
টেকনিক্যালি বললে, প্রায় একই অ্যাকশনে স্লোয়ার, ফাস্টার, ইয়র্কার এবং কাটারের এমন বিস্ময়কর সমন্বয় এর আগে দেখা যায়নি। ফলে মুস্তাফিজ ছিলেন সে সময় আনপ্লেয়েবল। কিন্তু সমস্যাটা হলো এর বছর খানেকের মধ্যেই মুস্তাফিজের এই ‘জাদু’টা একটু কমে এলো।
এখানে দুটো জিনিস মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত দুনিয়ার কোনো বোলারই আবির্ভাবের পর লম্বা সময় ধরে তার মিস্ট্রি ধরে রাখতে পারেন না। তাকে নিয়ে অনেক কাটাছেড়া হয়, তার ভিডিও নিয়ে ল্যাবে বিশ্লেষন করা হয়। ফলে তিনি কিছুটা প্রেডিক্টেবেল হয়ে পড়েন।
মুস্তাফিজের ক্ষেত্রে এটা ছিলো ছোট সমস্যা। তার চেয়ে বড় সমস্যা ছিলো টানা খেলায় বেশ কিছু ইনজুরি ২০১৬ সালের দিকে পেয়ে বসেছিলো তাকে। খুব দ্রুতই সেখান থেকে ফিরে আসেন মুস্তাফিজ। আমরা সাড়ম্বরে আবার বলি যে, মুস্তাফিজ ইজ ব্যাক।
কিন্তু সমস্যাটা হলো, একদল লোক এই ‘ব্যাক’ ব্যাপারটা মানতে চাচ্ছিলেন না। তারা কেবল উইকেট সংখ্যা দিয়ে বিচার করতে চাচ্ছিলেন। যেহেতু প্রাইম মুস্তাফিজ ভারতের বিপক্ষে ৬, ৫ উইকেট নিয়েছিলেন, তাই ৫-৬ উইকেট না পেলেই বলা হচ্ছিলো মুস্তাফিজ শেষ; আর ফিরবে না।
অথচ পরিসংখ্যানই বলছে, ২০১৫ সাল থেকেই বাংলাদেশের সেরা বোলার মুস্তাফিজুর রহমান। রোজ ৫ উইকেট পাননি; সেটা কেউ পায়ও না। মুস্তাফিজ ২-৩-৪ উইকেট পাচ্ছিলেন। তখন বলা হলো, সে টেল এন্ডারদের উইকেট পাচ্ছে; ওর দাম নেই।
সত্যি! সিরিয়াসলি! তা হলে তো মুরালিধরণের ৮০০ টেস্ট উইকেট বেকার হয়ে যায়!
আর এই অভিযোগটাও সত্যি না। মুস্তাফিজ টপ অর্ডারেও ঠিক আঘাত করছিলেন। তবে ডেথ ওভারে আরও ভয়ানক হয়ে উঠেছিলেন। ২০১৯ সালের দিকে আমরা দেখলাম, মুস্তাফিজ ২০১৫ সালের চেয়েও ভয়ানক হয়ে উঠেছেন। বিশ্বকাপে ইংলিশ কন্ডিশনে আরও হন্তারক হয়ে উঠলেন বাংলাদেশী এই পেসার। তার বিপক্ষে যে অভিযোগ ছিলো যে, স্লো ও লো ট্র্যাক ছাড়া পারেন না, সেটার অনেকটা জবাব মিললো এই বিশ্বকাপে।
সে সময় এই খেলা ৭১ একটি ফিচার প্রকাশ করেছিলো-মুস্তাফিজ ২.০।
এই মুস্তাফিজ যে কোনো আগের চেয়ে ভযঙ্কর, তার টেকনিক্যাল বিশ্লেষন করা হলো। আমরা দেখতে পেলাম, মুস্তাফিজের অ্যাকশনে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। ২০২০ সাল নাগাদ আমরা দেখলাম, তার রিলিজ পয়েন্ট বদলেছে। ফলে তিনি আরও ভয়ানক হয়ে উঠছেন।
মুস্তাফিজ ফিরে আসছেন-এটা ছেলেমানুষী কথা। মুস্তাফিজ তো আছেনই। আমরা তখন বলতে চাচ্ছিলাম যে, মুস্তাফিজ আসলে আরও ভয়ানক হয়ে উঠবেন কালক্রমে। সে জন্য আরেকটি লেখা প্রকাশ হলো- মুস্তাফিজ ধাঁধাঁর বিবর্তন।
এখানে দেখানো হলো যে, মুস্তাফিজ ঠিক কী কী পরিবর্তন করে নিজেকে আরও দূর্বোধ্য পাজলে পরিণত করেছেন।
সমস্যা হলো, এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর পরও লোকেদের চোখে কাপড় বাঁধাই রইলো। তারা দেখতে চাইলেন উইকেট। উইকেট সংখ্যাতেও মুস্তাফিজ একে একে সমসাময়িকদের ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। তখন বলা হলো, কোয়ালিটি উইকেট নয়।
এখন এই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে প্রথম তিন ম্যাচ দেখার পর অনেকে অবশ্য সুর বদলাতে পারেন। বিশেষ করে তৃতীয় ম্যাচের অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স!
কী অবিশ্বাস্য বোলিং। একটা বলও ব্যাটসম্যান পড়তে পারছিলেন না। মনে হচ্ছিলো বল নয়, রহস্যে আবৃত কোনো গোলক ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছেন।
বল পড়ে টার্ন করছে, বাতাসে বাঁক নিচ্ছে, গতি বারবার বদলাচ্ছে। কখনো জোরে আসছে, কখনো এতোটাই আস্তে যে উইকেটরক্ষক গলদঘর্ম হচ্ছেন। মোদ্দা কথা, তাকে বোঝাটাই যেনো অসম্ভব।
এই ম্যাচের বোলিং দেখে অস্ট্রেলিয়ানরা কী ভাবছেন, সেটা বলা মুশকিল। তবে আগের ম্যাচ শেষেই অস্ট্রেলিয়ান স্পিনার অ্যাস্টন এগার বলেছেন, ‘ভাই, সে খুব কঠিন জিনিস। সে আসলেই দারুন। তার স্লেয়ার করার ক্ষমতা অসাধারণ। ওকে আপনি যদি স্লো মোশনে দেখেন তো দেখতে পাবেন, সে পুরোটাই তার কবজি আর আঙুল দিয়ে করছে। সে অবিশ্বাস্য। তার স্কিল অবিশ্বাস্য। অসাধারণ বিবর্তন।’
অবশ্য তাতেও সমালোচকরা সন্তুষ্ট হবেন কি না, বলা কঠিন। কারণ, ৪ ওভারে ৯ রান খরচ করলেও উইকেট তো পাননি মুস্তাফিজ। আর উইকেট না পেলে কিসের ভালো বোলিং! মানে, আমরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব মানতে রাজিই নই। তাই বারবার বলি, মুস্তাফিজ আর ফিরবেন না।
আরেকটা পরিসংখ্যান দেই। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির ইতিহাসের সেরা বাঁ-হাতি পেসার হলেন মুস্তাফিজুর রহমান। এখানে তিনি মোহাম্মদ আমির, সোহেল তানভির কিংবা স্বয়ং মিশেল স্টার্ককেও পেছনে ফেলেছেন। ৪৬ টি টি-টোয়েন্টিতে মুস্তাফিজের উইকেট ৬৬ টি। অন্যদিকে, আমির ৫০ টি-টোয়েন্টিতে ৫৯ ও স্টার্ক ৪১ টি টি-টোয়েন্টিতে নেন ৫১ টি উইকেট। এবার বলুন, মুস্তাফিজ হারিয়ে গিয়েছিলেন কবে!
আমরা আরেকটু ভেঙে বলি, মুস্তাফিজের ফেরার দরকারই নেই; কারণ তিনি তো কোথাও যাননি।