না হয় ভালোবাসার যজ্ঞে অভিষেক আহুতিটা দিয়ে দেব

খ্যাতি, যশ অথবা মিডিয়া চাহিদার কেন্দ্রবিন্দু তখন তপু ভাইয়ের ছাত্র মুস্তাফিজ। মুস্তাফিজ জাদুতে গা ভাসিয়ে আমিও তখন একের পর এক স্ট্যাটাসে টাইমলাইন ভারী করছি। কিন্তু কোথায় যেন একটা সুতো ছেঁড়া ছেঁড়া লাগতো। ধুর, এগুলো নিয়ে ভাবার তখন সময় কোথায়? বিস্ময় বালকের বিস্ময় থেকে মন উঠিয়ে ছেঁড়া সুতোর ভাবনা কোন গাধাই বা ভাববে!

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেককে কি বলবেন আপনি? সাইক্লোন নাকি সুনামি? বিশেষণ যেটাই হোক না কেন, কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ক্রিকেট বিশ্বকে এটা তো বলাই যায়। ২০১৫ সালে যদি বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইঞ্জিন নতুনরুপে স্টার্ট নেয়, তাহলে পেছনের ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু এই সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ থানার তেঁতুলিয়া গ্রাম থেকে উঠে আসা মুস্তাফিজুর রহমান।

পাকিস্তানের বিপক্ষে মুস্তাফিজকে একাদশে দেখে চমকে উঠেছিলেন সেদিন অনেকেই। আমি একটুও চমকাই নি, অনূর্ধ্ব ১৯ দলের সেরা বোলার, প্রথম শ্রেণি এবং লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে অভিষেক হয়ে যাওয়া প্রতিভাবান কাউকে জাতীয় দলে দেখতে পাওয়াতে চমকের কিছু নেই। তবে, অভিষেকের চার ওভারে ১৬ টি ডট বল আমাকে চমকিত করেছিল।

আমি আকর্ষিত হয়েছিলাম ছেলেটার নিয়ন্ত্রণ দেখে, ভাল করার একটা নেশা তার শরীরী ভঙ্গিতে প্রকাশ পাচ্ছিল। একই দিনে আমাদের দুজনেরই অভিষেক হয়ে গেল। কোন বোলারে ভালবাসা খুঁজে নেবার অভিষেক হল আমার, আর আগমনী শঙ্খে ফুঁ দিয়ে নিজের অবস্থান দাবি করলেন মুস্তাফিজ।

পাকিস্তানের বিপক্ষে যদি মুস্তাফিজের ওই স্পেলটা মহড়া হয়ে থাকে, তাহলে ভারতের বিপক্ষে তো সেটা পুরোদস্তুর যুদ্ধ! ছেঁটে দেয়া বলুন অথবা গুঁড়িয়ে দেয়া, কাজটা এতটাই নিখুঁতভাবে করলেন যে বিশ্ব ক্রিকেটের চোখ তখন টমেটোর সাইজ। ‘কাটার’ শব্দটা তখন গুগল সার্চ ইঞ্জিনের সবথেকে জনপ্রিয় শব্দ।

খ্যাতি, যশ অথবা মিডিয়া চাহিদার কেন্দ্রবিন্দু তখন তপু ভাইয়ের ছাত্র মুস্তাফিজ। মুস্তাফিজ জাদুতে গা ভাসিয়ে আমিও তখন একের পর এক স্ট্যাটাসে টাইমলাইন ভারী করছি। কিন্তু কোথায় যেন একটা সুতো ছেঁড়া ছেঁড়া লাগতো। ধুর, এগুলো নিয়ে ভাবার তখন সময় কোথায়? বিস্ময় বালকের বিস্ময় থেকে মন উঠিয়ে ছেঁড়া সুতোর ভাবনা কোন গাধাই বা ভাববে!

টেস্ট অভিষেক বলুন অথবা আইপিএল, কিং মাইডাসের মত যেখানেই হাত লাগিয়েছিলেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। পরিবারে কোন ডাকনাম ছিল না তার, আইপিএল থেকে ‘দ্য ফিজ’ নামকরণে সেটাও জুটে গেল। খ্যাতি বাড়তে থাকল, আর সেইসাথে বাড়তে থাকল প্রত্যাশার চাপ। এদিকে থেমে নেই প্রতিপক্ষ, একবিংশ শতাব্দির ক্রিকেটে বিস্ময়ের অবস্থান ক্ষণস্থায়ী।

শুরু হল তাঁর বোলিং নিয়ে কাটাছেঁড়া, দুর্বল দিকগুলো আস্তে আস্তে ভেসে উঠতে শুরু করল। অন্যদিকে পেস বোলারদের চিরশত্রু ইনজুরিও সঙ্গ দিতে থাকল ছায়ার মত। নতুন কোচ আসলেন, বদলে দিলেন একশন! তরুন শরীর ভেঙ্গে পড়তে লাগলো, একজন বিস্ময় বালক হয়ে উঠতে থাকলেন একজন সাদামাটা পুরুষ।

তবে কি মুস্তাফিজের শেষ দেখে নিয়েছে ক্রিকেট বিশ্ব? প্রশ্নটা বেশ সহজেই করা যায় বর্তমান পরিস্থিতিতে, কিন্তু উত্তর দেয়াটা কঠিন। হয়ত তিনি মুস্তাফিজ বলেই ‘স্টিল আর্লি টু সে’ বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু শেষের শুরুটা কিন্তু খুব কদর্যভাবে সামনে বেরিয়ে এসেছে। মুস্তাফিজের এমন অবস্থা কেন, এমন প্রশ্নে হাজারো উত্তর হয়ত মিলবে, কিন্তু সেই উত্তরে মুস্তাফিজের শেষটা আটকান যাবে কি?

‘মুস্তাফিজ ফিরবে মুস্তাফিজের মতই’ কথাটা কানে মধু বর্ষণ করলেও, বাস্তবতা কিন্তু বেশ কাঁটাযুক্ত। তার শেষ কয়েকটি ম্যাচের পরিসংখ্যান এবং ইনজুরি প্রবনতা খুব একটা আশার আলো দেখাচ্ছে না। পুরাতন অস্ত্রগুলোতেই মরিচিকা জমে গেছে, সেখানে নতুন অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে নামতে পারবেন কি ফিজ?

‘ইনজুরি-বিশ্রাম-রিহ্যাব’ এই যদি হয় কোন তরুন খেলোয়াড়ের সারা বছরের সূচি, তাহলে তাঁর স্বরূপে ফেরার সম্ভবনা দশমিকের ঘরে। কাটার দিয়ে বেশিদিন টিকতে পারবেন না, সেটা অনুমেয় ছিল। কিন্তু নতুন কিছু নিয়ে আসবেন সেটা প্রত্যাশা করেই বুক বেঁধেছিল ভক্তকুল। কিন্তু সে গুঁড়ে বালি দিয়ে ইনজুরিকেই বন্ধু বানিয়ে বসেছেন কাটার মাস্টার।

আধুনিক ক্রিকেটের হৃদয় বড় পাষাণ। খোঁড়া ঘোড়ার দাওয়াই খরচ খুব বেশিদিন বহন করবে না এটা জানা কথা। অসময়ের ইনজুরিকে অতি শিগ্রই বশে আনতে না পারলে খরচের খাতায় আরেকটি বিস্ময়ের নাম উঠে যেতে সময় লাগবে না। অজন্তা মেন্ডিস হারিয়ে গেছেন, হারিয়ে গেছেন এমন অনেক বিস্ময় জাগানিয়া প্রতিভাই।

শেষের শুরুর পথে হাঁটতে শুরু করেছেন মুস্তাফিজও। হয়ত দুই বছর পর বাংলাদেশের জার্সি গায়ে সদা বিনয়ী তরুণ ছেলেটিকে আর বোলিং প্রান্তে দেখা হবে না, দেখা হবেনা সেই বিধ্বংসী ইয়র্কার, দেখা হবেনা স্লোয়ারে বিভ্রান্ত ব্যাটসম্যানের ভ্যাবাচ্যাকা চোখ, দেখা হবেনা আবুল কাশেম এবং মাহমুদা খাতুনের ছোট ছেলে মুস্তাফিজের চিরচেনা উদযাপন।

 

হ্যালির ধুমকেতুর মত আরেকজন মুস্তাফিজ ঠিক কত বছর পর আবার বাংলাদেশ ক্রিকেটে আসবে সেটা নির্ধারণ করার ভার সময়ের হাতেই তোলা থাক। যদি আমার আয়ুষ্কালে আসে, তাহলে আরেকবার না হয় ভালোবাসার যজ্ঞে অভিষেক আহুতিটা দিয়ে দেব।

২০১৮ এবং ২০১৯ পার হয়েছে ইতিমধ্যেই। ইনজুরি, কামব্যাক, ফর্মের সাথে যুদ্ধের অংকে মুস্তাফিজ কিছু হিসেব মিলিয়েছেন, কিছু হিসেব মেলাতে পারেননি। নতুন শুরুর সূচনালগ্নে এসে তাই এখনো আমি আশাবাদী। ফিজের শাসন নতুন করে শুরু হোক বাইশ গজে, ফুরিয়ে যাওয়া ফিজ নয়, ফিরে আসা ফিজকে লাল সবুজে মোড়ানো জার্সিতে দেখার অপেক্ষায়।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...