ঐতিহাসিকভাবেই ন্যাপলসের লোকজনকে বাকি ইতালি একটু টেরিয়েই দেখে। একে তো দক্ষিণের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ শহর। তাও গরীবগুর্বো শ্রমিকদের শহর। উত্তরের মিলান, ফ্লোরেন্স, তুরিন, বোলোনিয়া, রোম এদের বৈভব, ঐশ্বর্য বা কৃষ্টির ধারে কাছে আসে না। আবার নেপোলিয়ান বোনাপার্তে যখন ইতালি দখল করলেন তখন নেপলসকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন ইতালিকে ফরাসি সাম্রাজ্যের হয়ে শাসন করার। এসব উত্তর ইতালির নগর রাষ্ট্রগুলো মেনে নেবে নাকি! ইতালির পূনরেকত্রিকরণের পরে স্বাভাবিকভাবেই একটা রেষারেষি চলে আসে বাকি নগর রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে নেপলসের। ফুটবলেও তাই।
এমনিতেই মিলান, তুরিন বা রোমের ক্লাবগুলির থেকে কৌলীন্যে পিছিয়ে নাপোলি বা এসএসসি ন্যাপোলি। সোসিয়েতা স্পোর্তিভা ক্যালসিও নাপোলি। শতবর্শ হতে এখনও বছর তিনেক বাকি। ইতিহাসও নেই, কৃষ্টিও নেই। কিন্তু গত শতাব্দীর আটের দশকে এসে গল্প পালটে যায়।
তর্কসাপেক্ষে বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার দিয়াগো আর্মান্দো মারাদোনা তখন বার্সেলোনা থেকে প্রায় বিতাড়িত। ৮২’র বিশ্বকাপের পর সকলেই ধরে নিয়েছিল যে যতই প্রতিভা থাকুক না কেন, মাথা গরম ফুটবলার। তার থেকে ঠাণ্ডা মাথার মিচকে পটাশ মিশেল প্লাতিনি অনেক ভালো, জুভে আর ফ্রান্সের হয়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করছেনও।
ওদিকে ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমের জন্য বার্সা থেকে তদানীন্তন বিশ্বরেকর্ড ট্রান্সফার মূল্যে নাপোলি নিয়ে এসেছে মারাদোনাকে। প্রথম দু’বছর সেরকম কিছু হল না। কিন্তু ১৯৮৬-৮৭ হল ল্যান্ডমার্ক বছর। প্রথমবারের জন্য সেরি আ খেতাবের সঙ্গে সঙ্গে এল কোপা ইতালিয়াও। ফরোয়ার্ড লাইনে তখন ব্রাজিলীয় কারেকা এবং ইতালীয় ব্রুনো জিয়ার্দিনো ম্যারাডোনাকে যোগ্য সঙ্গত করছেন। তারপর আবার ১৯৮৯-৯০তে সেরি আ।
তখন ইতালীয় লিগ পৃথিবীর সেরা। এক দিকে ম্যারাডোনা-কারেকা- ব্রুনো- দি ন্যাপোলি- আলেমাওএর নাপোলি, মিলান থেকে হুলিট-বাস্তেন-রাইকার্ড- বারেসি-দোনাদোনির এসি মিলান আর লোথার ম্যাথাউজ-বার্গোমি-ব্রেহমে- ক্লিন্সমানের ইন্টার আর প্লাতিনির পরে ক্যাব্রিনি-আলতোবেলি-মাইকেল লাউড্রপের জুভেন্তাস।
তা সেই ১৯৯০ এর ইতালিয়া ৯০ তো ম্যারাডোনার বিতর্কিত মন্তব্যের জন্যই বিখ্যাত বা কুখ্যাত হয়ে গেল। ইতালির বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল ছিল ন্যাপলসের সান পাওলো স্টেডিয়ামে। তার আগে ম্যারাডোনা বলে বসলেন, যুগযুগ ধরে উত্তরের শহরগুলো ন্যাপোলিকে যেভাবে অবজ্ঞা করেছে। নাপোলির উচিত ইতালির বিরুদ্ধে ম্যাচে আর্জেন্টিনাকেই সমর্থন করা। ন্যাপলসের কতটা সমর্থন আদায় করে নিতে পেরেছিলেন হয় তো বলা যায় না। কিন্তু নেপলস শহর তার প্রিয় পালিত সন্তানকে বিমুখ করেনি। সেমি ফাইনালে টাইব্রেকারে হারে ইতালি এবং সমবেত করতালির মধ্যে মারাদোনা সমগ্র স্টেডিয়ামের সামনে বারবার মাথা নিচু করে অভিবাদন গ্রহণ করেন।
কিন্তু, ইতালির জাত্যভিমানে আঘাত বলে কথা। বিশ্বকাপের পরেই ডোপ পরীক্ষা করে কোকেন সেবনের জন্য ইতালি ছাড়তে বাধ্য করা হয় মারাদোনাকে, যা পরবর্তীকালে মারাদোনা তো বটেই, নাপোলির ম্যানেজমেন্টও বলেছিলেন যে এটা জিঘাংসা চরিতার্থ করা ছাড়া আর কিছুই না।
সেই ১৯৮৯-৯০ই শেষ। তারপর মারাদোনা গত হয়েছেন, সান পাওলোর নাম বদলে ম্যারাডোনা স্টেডিয়াম রাখা হয়েছে, কিন্তু ৩৩ বছর কেটে গেছে নাপোলি আর সেরি আ পায়নি। চাকাটা কিন্তু ঘুরতে শুরু করেছে। গত দু’তিন বছরের মোটামুটি পারফরম্যান্সের পর এবার বছরের শুরুতেই নাপোলির স্টার লরেঞ্জো ইন্সিনিয়ে হঠাৎ আমেরিকার এমএলএস খেলতে চলে যান। তারপর কালিদৌ কোলিবালি, ফ্যাবিয়ান রুইজ বা সার্বিয়ান মিলিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়রাও দল ছাড়েন।
অবশ্য কোচ লুসিয়ানো স্প্যালেত্তি তাতে দমেননি। এবারে দলে যোগ দেন ফুলহ্যাম থেকে মাঝমাঠের অ্যানগুইসা, টঙ্গু এন্ডোম্বেলে লোনে আসেন টটেনহ্যাম থেকে, আর আসেন ফেনারবাহকে থেকে কোলিবালির জায়গায় কোরিয়ান মিন জায় কিম।
আক্রমণভাগে মেক্সিকান লোজানো, নাইজেরীয় ওসিমহান আর জর্জিয়ার ভারাতস্খেলিয়া (অনেক কষ্টে লিখেছি, পড়া হয়ে গেলে দুটো চারআনা রেখে যাবেন স্ক্রিনের সামনে)। এদের মধ্যে ওসিমহানের প্রতিভা দারুণ ছিল, কিন্তু চোটপ্রবণ। লোজানো মেক্সিকোর হয়ে যত ভালো খেলেন ক্লাব ফুটবলে নন আর ভারতস্খেলিয়া তো সিনেই ছিলেন না। ডিপ ডিফেন্সে মূলত কিমের সঙ্গে আলবানীয় রাহমানি, দুই উইং ব্যাক ইতালীয় ডি লরেঞ্জো এবং পর্তুগীজ মারিও রুই।
মাঝমাঠের প্রাণভোমরা করলেন আঙ্গুইসাকে। সঙ্গে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার স্লোভাকিয়ান লোবদকা আর ক্রিয়েটিভ নাম্বার ৮ পোল্যান্ডের জেলিন্সকি। গোলে অ্যালেক্স মেরেত। স্প্যালেত্তির দল খেলাটা তৈরি করে নিচ থেকে, দুই ডিপ ডিফেন্ডার এবং লোবদকা একটা ত্রিভুজ তৈরি করেন, এবং পাস খেলতে খেলতে উঠতে থাকেন। ফল স্বরূপ বিপক্ষ বাধ্য হয় হাইপ্রেসে, সমস্যা নেই।
কিম বা লোবদকা বেশ ভালো পাসার, তিনটে লাইন পেরিয়ে বল পাঠিয়ে দিতে পারেন ওসিমহানকে। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে ওসিমহান হল দানব। গোল সংখ্যায় হাল্যান্ড বেশি থাকতে পারেন কিন্তু ওসিমহান সম্পূর্ণ নাম্বার নাইন। হোল্ড আপ বা বিল্ড আপ প্লে তাঁর দুর্দান্ত। উইং দিয়ে দৌড়তে পারেন, সেক্ষেত্রে জেলেন্সকি বা আঙ্গুইসা বা এন্ডোম্বেলে বক্সে উঠে আসতে পারেন আর ভারাতস্খেলিয়া তো রইলেনই।
ভারাতস্খেলিয়াকে আবার আজকাল জর্জিয়ান ম্যারাডোনা বলা হচ্ছে। বাঁ-পাটা পুরো স্কেটিং রিংকের উপর স্কেটসের ছুরি, আর রয়েছে আনপ্রেডিক্টেবল ড্রিবলিং, পরমুহূর্তে বল নিয়ে তিনি ভিতরে ঢুকবেন না উইং বরাবর দৌড়বেন তা তিনি নিজেও জানেন না। ডাবল কভারিং-এ গেলে জেলেন্সকি চলে আসেন সাহায্যের জন্য বাঁ-দিকে অবশ্য মারিও রুই খুব বেশি উঠবেন না।
দলের প্রয়োজনে তিনি রাহমানি বা কিমের সঙ্গে থ্রি ব্যাক তৈরি করে ফেলবেন। জেলেন্সকি একটু বাঁ-দিক ঘেঁষে আর ডানদিকে উঠছেন ডি লরেঞ্জো আর লোজানো। মাঝমাঠে এন্ডোম্বেলে বা আঙ্গুইসা তখন লোবদকার সঙ্গে একটা ডাবল ডিফেন্সিভ স্ক্রিন তৈরি করেন।
তবে স্প্যালেত্তির ন্যাপোলির খেলা দেখতে ভালো লাগে কারণ তাদের ক্রিয়েটিভিটিই নয় শুধু। শ্বাসরোধকারী হাইপ্রেস। এখানে ওসিমহান আর আঙ্গুইসা দুটো প্রেসিং মেশিন। নিরন্তর ডিফেন্ডারদের তাড়া করে ভুল করতে বাধ্য করেন। কিন্তু হাই প্রেস করা মানেই যে মাঝমাঠ আর ডিপ ডিফেন্সে গ্যাপ তৈরি হবে তা নয়, অথবা ডিফেন্স কাছা খুলে উপরে উঠে যাবে তাও নয়। স্প্যালেত্তির সিস্টেমের বড় কথা ইলাস্টিসিটি। মাঝমাঠের ভূমিকা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
স্কিল সেটের উপর নির্ভর করে মাঝমাঠের তিনজন আক্রমণে বা রক্ষণের সময় নিজেদের পজিশন নেন। সাধারণ ক্ষেত্রে লোবদকা ছ নম্বরে, আঙ্গুইসা মাঝা-মাঝি অবস্থান করেন চকিত প্রতি আক্রমণ ঠেকাবার জন্য, জেলেন্সকি আরেকটু উপরে ওসিমহানের সঙ্গে মিলে ডাবল প্রেস করেন বিপক্ষের স্টপারদের। আর দুই ধারে শিল্পী ভারাতস্খেলিয়া বা ফক্সি লোজানো তো রয়েইছেনই।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল স্প্যালেত্তির সিস্টেমে ত্রিভুজ তৈরি করে বিপক্ষের অর্ধে হাফ স্পেসগুলো দখল করে বিপক্ষের ডিফেন্সিভ কাঠামো নষ্ট করে দেওয়া। তবে দলটার খুঁত কি নেই? আছে আছে। ওসিমহান না থাকলে সাসুয়ালো থেকে আসা রাস্পাদোরি বা দিয়েগো সিমিওনির ছেলে জিওভান্নি গোলটা চিনলেও প্রেসিং ক্ষমতা ওসিমহানের মতো অপার্থিব নয়। আর ওসিমহান চোটপ্রবণ। এই যে আজ যে মিলানের বিরুদ্ধে উচলে কোয়ার্টার ফাইনাল আছে সেটাতেও খেলতে পারবেন না।
আর ওসিমহান না থাকলে কী হতে পারে তা গত সপ্তাহেই ম্যারাডোনা স্টেডিয়ামে দেখা গেছে। এই মিলানের কাছেই পরিষ্কার চার গোলে নিজেদের মাঠেই হেরেছে নাপোলি। মিলানে আমার আরেক পছন্দের রাফায়েল লিয়াও আছেন বেন নাসের, ব্রাহিম ডিয়াজ আর অলিভার জিরুর সঙ্গে। তোমোরি, টোনালি আর বাঁ-দিকে থিও হার্নান্ডেজ তো আছেনই। সব মিলিয়ে হয় তো উচলেতে আটকে যেতেই পারে নাপোলি, কিন্তু ৩৩ বছর পরে যে সেরি আ আসতে চলেছে, সেটা তো সময়ের অপেক্ষা।
বছর খানেক আগে আটালান্টায় গাস্পেরিনি যা করছিলেন, তাই করছেন স্প্যালেত্তি ন্যাপোলিতে। আক্রমণত্মক দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলে সেরি আর মধ্যে প্রাণ ভরছেন। আশা করা যায় উচলেতেও আমরা তার নিদর্শন দেখতে পাব।