এক দশক বাদে কলকাতা নাইট রাইডার্সের ঘরে গিয়েছে শিরোপা। সবাই আনন্দ-উল্লাসে পার করছেন দিন। খেলোয়াড়দের প্রশংসা হচ্ছে সর্বত্র। গৌতম গম্ভীর তো ভেসে যাচ্ছেন বন্দনায়। দলকে এক সুতোয় গেঁথে রাখার কৃতিত্ব যে তারই। তবে পর্দার আড়ালে থাকা নায়কদের খোঁজ ক’জনই বা করে?
মানুষ যা দেখে শুধু তাই নিয়ে করে আলোচনা। ক্রিকেট যে শুধু মাঠের খেলা নয়, চার দেয়ালের মাঝেও যে ক্রিকেট খেলা যায়। সেটাই আরও একবার প্রমাণ করে দেখালেন নাথান লিমন। চিনতে একটু কষ্ট হওয়ারই কথা। আলোক রোশনাইয়ের পেছনে থাকা মাস্টার মাইন্ড-কে সবাই চিনবে না সেটাই তো স্বাভাবিক।
নাথান লিমন একজন ইংরেজ নাগরিক। কলকাতা নাইট রাইডার্সের ‘স্ট্র্যাটেজি কন্সালটেন্ট’ হিসেবে ছিলেন তিনি। শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে তার সক্রিয় অবদান। ঠিক কিভাবে তিনি অবদান রেখেছেন- সে আলাপে একটু পরে যাচ্ছি। আগে তার পরিচয় পর্বটা সেরে নেওয়া যাক।
নাথান লিমন তার পড়াশোনা শেষ করেছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গণিতে নাম শুনলে অনেকেই হয়ত আতকে ওঠেন। সেই গণিতই ছিল তার পড়াশোনার বিষয়। এরপর তিনি শিক্ষকতাও করেছেন। ছাত্রদের শিখিয়েছেন গণিতের নানা সূত্র।
লিমনের আগাগোড়া ক্রিকেটের সাথে ছিল না কোন সম্পর্ক। তবে ২০০৯ সালে বদলে যায় চিত্র। ইংল্যান্ড জাতীয় ক্রিকেট দলের সাথে যুক্ত হন তিনি। অ্যানালিস্ট হিসেবেই যুক্ত হয়েছিলেন। এরপর দীর্ঘ একটা পথচলা তার ইংলিশ দলের সাথে। আর সেই পথচলা এখনও চলমান। সেই যাত্রায় ক্রিকেট নিয়ে বইও লিখেছেন নাথান। ‘হিটিং অ্যাগেইন্সট দ্য স্পিন: হাও ক্রিকেট রিয়েলি ওয়ার্কস’ ও ‘দ্য টেস্ট’ বইয়ে মাঠের বাইরের ক্রিকেটকে তুলে ধরেছেন তিনি।
বলা হয়ে থাকে ক্রিকেটের বিস্তার ঘটেছে ইংল্যান্ডের হাত ধরে। কিন্তু সেই ইংল্যান্ডই পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ জিততে পারেনি ২০১৯ এর আগে। তবে ২০১৯ সালে অধরা সেই শিরোপা জিতে নিয়েছে ইংল্যান্ড। তার পেছনেও নানামুখী ডাটা দিয়ে সাহাস্য করেছেন এই নাথান লিমন।
একটা দৃশ্য তো সাম্প্রতিক সময়ে নিশ্চয়ই দেখেছেন। ইংল্যান্ডের খেলা চলাকালীন সময়ে ডাগআউটে নম্বর ও অক্ষর সম্বলিত প্ল্যাকার্ড ঝুলে থাকে। মাঠে থাকা খেলোয়াড়দের কোন তথ্য জানানোর অভিনব পন্থা সেটি। সেই পন্থার প্রবর্তকও নাথান লিমন। সেই একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তিনি কলকাতার ডাগআউটেও।
তবে, নাথান লিমনের সংযুক্তির পরপরই যে ইংল্যান্ড সফলতা পেয়ে গেছে বিষয়টি তেমন নয়। লম্বা সময় ধরে তকে কাজ করবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ পথচলায় তিনি কোটি কোটি তথ্যের ঝুলি বানিয়েছেন। তারপর সেই মোতাবেক ইংল্যান্ডকে পরিকল্পনা সাঁজাতে সহয়তা করেছেন। এরপরই ইংল্যান্ড শিবিরে এসেছে সফলতা।
২০২১ সালে কলকাতা নাইট রাইডার্সের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন নাথান লিমন। গেল দুই আসরে খুব যে ভাল পারফর্ম করতে পেরেছে কলকাতা তা কিন্তু নয়। যেকোন প্রক্রিয়ায় সফলতা পেতে হলে ধৈর্য ধরা প্রয়োজন। ইংল্যান্ড ধৈর্য্য ধরেছে, শেষতক সফলতাও পেয়েছে। ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে দল।
ঠিক একই পথে হেঁটেছে কলকাতা। দশ বছর বাদে শিরোপা উৎসবে মেতেছে দল। নাথান লিমন ঠিক কিভাবে সহয়তা করেছেন তার একটা উদাহরণ নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করছেন অনেকেই। সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের অন্যতম বিধ্বংসী ব্যাটার ট্রাভিস হেড। তার একটা সূক্ষ্ম দূর্বলতা রয়েছে। স্ট্যাম্প লাইনে পড়ে অফ স্ট্যাম্পের বাইরে দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়া বলে আউট হওয়ার প্রবণতা রয়েছে।
সেটাও ধরিয়ে দিয়েছেন তিনি। আরও একটি বিষয় সম্ভবত ধরিয়ে দিয়েছেন। পাওয়ার প্লে-তে ৫০ বা ততোধিক রান করা ম্যাচগুলোতে অনায়াসে জিতেছে হায়দ্রাবাদ। লিগ পর্বে যে দু’টো ম্যাচে তারা ৫০ এর কম রান করেছিলেন, সে ম্যাচ দুটোতে জয় পেতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে হায়দ্রাবাদকে। এই ক্ষুদ্র বিষয়গুলোই পয়েন্ট আউট করে দেওয়া নাথান লিমনের কাজ।
তিনি তার কাজ দারুণভাবে করেছেন বলেই সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ প্লে-অফের দুই ম্যাচেই হেরেছে কলকাতার কাছে। আর শেষে গিয়ে জিতে নিয়েছে বহুল প্রতিক্ষিত শিরোপা। তাতেই যে আবার প্রমাণিত হয়, ক্রিকেট শুধু মাঠের খেলা নয়।