ইমরান খান, পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাস বদলে দেয়া একজন অধিনায়ক। বলা হয়ে থাকে, ক্রিকেট বিশ্বের ইতিহাসেই তিনি নাকি সবচেয়ে প্রভাবশালী অধিনায়ক৷ একাদশ নির্বাচন মিটিংয়ে দুই পকেটে দুইটি কাগজ নিয়ে যেতেন ৷ একটা কাগজে লেখা থাকতো নিজের পছন্দের খেলোয়াড়দের তালিকা, অন্য পকেটে থাকতো নিজের পদত্যাগপত্র।
তাঁর দল মেনে না হলে সটান পদত্যাগপত্র বের করতেন ৷ আর তাই বোর্ডের নির্বাচকরা প্রথম কাগজ নিয়ে যতই আপত্তি করুক, দ্বিতীয় কাগজ গ্রহণ করার মত ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। আর এভাবেই একক আধিপত্য পাওয়া ইমরান পাকিস্তান দলকে বিশ্বজয়ের স্বাদ এনে দিয়েছেন।
মুদ্রার আরেকদিকেও একটা গল্প আছে। খালেদ মাসুদ পাইলটের গল্প। সম্ভবত ইমরান খানের ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০০৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ক্যাপ্টেন খালেদ মাসুদ পাইলটকে তৎকালিন বোর্ড সভাপতি আলী আজগর লবী একক ক্ষমতা ও স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিলেন। না, ইমরানের মত পাইলট সোনা ফলাতে পারেননি বরং পুরো দলে সৃষ্টি হয়েছিল ভাঙন।
একদিকে ছিল অধিনায়ক আর ম্যানেজমেন্ট, অন্যদিকে দলের বাকি সদস্যরা৷ মাঠের ফলাফলেও বিভীষিকা দেখেছিল লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। কেনিয়া ও কানাডার মত দলের সাথে হেরে এখন অবধি কোন বিশ্বকাপে প্রতিটি ম্যাচ হারার রেকর্ড গড়েছিল সেই বিশ্বকাপ ৷
ফিরে আসা যাক মূল বিষয়ে, সাকিব আল হাসানের কাছে ৷ বাংলাদেশ ক্রিকেটের পোস্টার বয় প্রথম অধিনায়কত্ব পেয়েছিলেন ২০০৯ সালে। নতুন ক্যাপ্টেন মাশরাফি হঠাৎ ইনজুরিতে পড়ায় নেতৃত্বের ব্যাটন উঠেছিল সহ-অধিনায়ক সাকিবের হাতে৷
প্রত্যেক খেলোয়াড়ের নিজ নিজ দর্শন আছে। মুস্তাফিজ কিংবা লিটনের ক্রিকেট ভাবনা খুবই সরল। মাঠে নিজের দায়িত্ব পালন করতেই তারা ব্যস্ত। দায়িত্বের বাইরে গিয়ে উদ্যোগী হয়ে ভিন্ন কিছু করার তাগিদা তাদের খুব একটা নেই। বাংলাদেশের সদ্য সাবেক টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল হকও প্রায় একই ধাঁচের। কিছুটা উদাসীন নির্মোহ থেকেই তারা ক্রিকেটটা খেলে যায়।
কিন্তু মাশরাফি, সাকিব কিংবা তরুণদের মাঝে মিরাজ; এরা আবার ভিন্ন প্রকৃতির। নিজেদের মূল দায়িত্বের বাইরে গিয়েও মাঠের খেলায় বিভিন্নভাবে প্রভাব রাখতে চেষ্টা করেন। এদের তবে সবার মধ্যে সাকিব আল হাসান নি:সন্দেহে বিশেষ। তার ক্রিকেট মস্তিষ্ক বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে পরিপক্ক সেটিও বলে দেয়া লাগে না। আর তাই তার সবসময়ই ইচ্ছে ছিল ক্রিকেটীয় মেধা দিয়ে লাল-সবুজকে ক্রিকেট দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করতে।
এজন্য সাকিব চেয়েছিলেন, তার নিজস্ব দর্শন বোর্ডের সাথে তুলে ধরবেন। তারপর বোর্ড তাঁকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে রাজি হলেই কেবল তিনি ক্যাপ্টেন হবেন। কিন্তু হঠাৎ অধিনায়কত্ব পাওয়ায় প্রথমে আনুষ্ঠানিকভাবে এমন কোন আলোচনা করা সম্ভব হয় নি। পরবর্তীতে অবশ্য তৎকালীন সভাপতি মোস্তফা কামালের সাথে কথা বলে অনেক বার নিজের একচ্ছত্র ক্ষমতা চেয়েছেন সাকিব।
কিন্তু, পাইলটের উদাহরণ দেখিয়ে এমন সুযোগ দেয়া হয়নি তাকে। এরপর প্রায় বছর দুয়েক অধিনায়ক থাকার পরে ২০১১ বিশ্বকাপ শেষে সাকিব কে সরিয়ে দেয়া হয় ৷ সাকিবও এটা মেনে নেন নতুন বাস্তবতায়। অথচ সেই সময় ম্যানেজম্যান্ট যদি সাকিবের উপর ভরসা রাখতেন, তবে হয়তো ওয়ানডে’র মত বাংলাদেশের টেস্ট কিংবা টি২০ পারফরমেন্স এতটা হতদরিদ্র থাকতো না ৷ কারনটা একেবারে সহজ, খালেদ পাইলট আর সাকিবের চিন্তাভাবনা আর নেতৃত্বগুন একই নয়।
২০১১ এর পর থেকে অনেকটা সময় জুড়ে মুশফিক ছিলেন লাল বলের অধিনায়ক ৷ এইসময় যেমন অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মত দলকে টেস্টে হারিয়েছে বাংলাদেশ, তেমনি বিভিন্ন বিতর্কে জড়িয়েছে মুশফিকের নাম।
২০১৮ সালে বর্তমান বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের চেষ্টায় সাকিবকে পুনরায় টেস্ট ক্যাপ্টেন করা হয় ৷ এসময় সাকিবকে ইচ্ছা মতো ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল যার প্রমান চট্টগ্রামে আফগানিদের বিরুদ্ধে চার স্পিনার খেলানোর মধ্যে। কিন্তু এরপর আবারও বিঘ্ন ঘটে, আইসিসির নিষেধাজ্ঞার খড়গ নেমে এসেছিল সাকিবের উপর।
নিষেধাজ্ঞা শেষে পুরোনো অধিনায়কত্বের আসনে ফেরার চেয়ে সাকিব মনোযোগ দেন ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে। আর তাই, তার নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়র পর বাংলাদেশ ১৩ টা টেস্ট খেললেও তিনি হাজির ছিলেন মাত্র পাঁচটা ম্যাচে।
মুমিনুল হক সৌরভ অধিনায়ক হিসেবে মোটামুটি চলার মত হলেও হয়তো আর সাকিবকে অধিনায়ক করার কথা উঠতো না। কিন্তু নেতৃত্বের চাপে পিষ্ট মুমিনুলকে মুক্তি দিতেই আবারো সাকিবের কাঁধে সওয়ার হলো টিম টাইগার্স।
ক্যারিয়ারের শেষদিকে থাকা সাকিব সম্ভবত নিজেই চেয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে তার নতুন এক বিপ্লবের সূচনা করতে। যে স্বাধীনতা পেলে তিনি নিজের মত করে দেশের টেস্ট ক্রিকেটের রূপরেখা অনেকটা বদলে দিতে পারবেন সে স্বাধীনতা তাকে দেয়া হয়েছে বলেই ধরে নেয়া যায়।
আর এই বিপ্লবের এই অনুপ্রেরনা সাকিবকে উল্টো পথে হাঁটাতে পারে। সাধারনত বয়সের সাথে সাথে সবাই টেস্ট ক্রিকেট ছাড়লেও সাকিব হয়তো ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি খেলা কমিয়ে দেশের টেস্ট ক্রিকেটে মনোযোগ দিবেন।
গত এক যুগের বেশ সময় ধরে বিশ্ব সেরা অলরাউন্ডার হয়ে বাংলাদেশকে যে সম্মান এনে দিয়েছেন, তার চেয়েও তিনি সম্মানিত হওয়ার হাতছানি সাকিবের সামনে এখন৷ জয়-পরাজয়ের হিসেবে নয়, সাকিব আল হাসান যদি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দেশের টেস্ট ক্রিকেটকে ইতিবাচকভাবে বদলে দিতে পারেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই তিনি বাংলাদেশ নয় শুধু, বিশ্বের ইতিহাসেও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
শুধু সাকিবভক্ত নয়, বরং সাকিবকে দেখা প্রতিটি চোখ জানে সাকিবের সে সামর্থ্য রয়েছে। উপস্থিত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, চাপ নেয়ার সামর্থ্য, মেধাশক্তি আর নেতৃত্বগুন – সবমিলিয়ে পরিপূর্ণ সাকিব আল হাসান ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রাচীন ফরম্যাটে বাংলাদেশকে পরাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলবেন সেটি হয়তো প্রত্যাশা করাই যায়।