নয় নম্বরে লেখা ছিল এক মহাকাব্যের নাম—ফেনোমেনন

নয় নম্বর জার্সিটা যেন জন্মেছিল তাঁর জন্যই। গোল করা একটা শিল্প, রোনালদো নাজারিও ছিলেন সেই শিল্পের মাইকেলেঞ্জেলো। তিনি ছিলেন রক্ষণের ত্রাস, ডি-বক্সে তাঁর পায়ে বল আসা মানেই গোলরক্ষকদের কাঁপাকাপি শুরু হয়ে যেত। বিশ্বের সেরা সব গোলরক্ষকরা হাফ ছেড়ে বাঁচতে পারেন। কারণ, এই শহরের ডি-বক্সে রোনালদো, ‘দ্য ফেনোমেনন’ আর দু:স্বপ্ন ছড়াতে আসেন না।

নয় নম্বর জার্সিটা যেন জন্মেছিল তাঁর জন্যই। গোল করা একটা শিল্প, রোনালদো নাজারিও ছিলেন সেই শিল্পের মাইকেলেঞ্জেলো। তিনি ছিলেন রক্ষণের ত্রাস, ডি-বক্সে তাঁর পায়ে বল আসা মানেই গোলরক্ষকদের কাঁপাকাপি শুরু হয়ে যেত। বিশ্বের সেরা সব গোলরক্ষকরা হাফ ছেড়ে বাঁচতে পারেন। কারণ, এই শহরের ডি-বক্সে রোনালদো, ‘দ্য ফেনোমেনন’ আর দু:স্বপ্ন ছড়াতে আসেন না।

তাঁর প্রতিটা দৌড় ছিল ঝড়ের মতো, যার ড্রিবল ছিল রেইজার-শার্প, আর যার গোল করা মানে ছিল — একটা সভ্যতা দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকা। সেই সভ্যতায় নব্বই দশকের সেরা সব গোলরক্ষকরা ছিলেন। এক নিমিষেই তিনি রক্ষণের সাজানো সংসার উজাড় করে দিতে জানতেন।

ব্রাজিলের রিও ডি জানেইরোর নিচু বস্তিতে এক সন্ধ্যা নামছিল, তখনই হয়তো কোনো ফুটবল দেবতা নিচে তাকিয়ে বলেছিলেন—‘চলো, একটা বিস্ময় বানানো যাক!’ তেমন করেই জন্ম রোনালদোর। বাবা-মায়ের সংসারে অভাব ছিল, কিন্তু ছেলেটার পায়ে ছিল আগুন। সতেরো বছর বয়সে ব্রাজিলের হয়ে জাতীয় দলে ডাক পেয়েই বুঝিয়ে দিয়েছিল, এই গল্পটা সাধারণ হতে আসেনি।

একটা সময় ছিল যখন মাঠে নামলেই বিপক্ষ কোচের বুক ধড়ফড় করত। মালদিনি, কান, স্ট্যাম, কোলিনা—সবাই জানত, রোনালদোর সামনে রক্ষণ মানেই একটা ফালতু রুটিন, যা সে ভেঙে দেবে অনায়াসে। অলিভার কান তো বলেই ফেলেছিলেন, ‘ও আমার আজন্ম দু:স্বপ্ন।’ রোনালদোর পায়ের ফ্লিক দেখে যেন শিরায় শিরায় কাঁপন ছড়িয়ে যেত। প্ল্যানিং, ডিফেন্স, কনফিডেন্স—সব গলে যেত এক নিমেষে।

বার্সেলোনায় এক মৌসুম। মাত্র একটাই। কিন্তু ইতিহাস বলে, কোনো শিল্পীকে নিজেকে প্রমাণ করতে সময় লাগে না, লাগে শুধু একটা ক্যানভাস। বার্সায় ৪৭ গোলের সেই মৌসুমটাই ছিল রোনালদোর ক্যানভাস। এক ম্যাচে যখন ক্যম্পোস্তেলার ডিফেন্ডারদের নাচিয়ে গোল করলেন, তখন বার্সার সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে বস লুই ভ্যান গাল চোখের সামনে হাত রেখে বললেন, ‘আমি ঈশ্বরকে দেখেছি।’

পায়ে বল থাকলে মনে হতো, যেন গতি আর কল্পনার অর্কেস্ট্রা চালাচ্ছেন। ভিয়েনা থেকে মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার থেকে মিলান—সব জায়গায় রোনালদো মানেই হাহাকার, বিস্ময় আর স্যালুট। অথচ এই গল্পটা শুধুই ম্যাজিকের নয়। মাঝপথে যেন ছুরি চালিয়ে দিয়েছিল ইনজুরি নামক ট্র্যাজেডি। হাঁটু ভাঙল। আবার ভাঙল। মাঠের বাইরে দীর্ঘ দুই বছর। সবাই ভাবল, শেষ। কিন্তু না, ‘ফেনোমেনন’রা শেষ হয় না।

১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে পারেননি। সেই ট্র্যাজেডিটা ফিরিয়ে দিলেন ২০০২ বিশ্বকাপে। ফিরে এলেন সেই পুরনো রোনালদো। চুলের সামনে অদ্ভুত ছোট্ট এক স্টাইল। আট গোল করে বিশ্বকাপ জিতিয়ে দিলেন ব্রাজিলকে। জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে কানকে ভেঙে দিলেন দু’বার। এশিয়ার মাটিতে সাম্বার উৎসব হল।

ডি-বক্সে গোলরক্ষককে পাশ কাটিয়ে করা ৮৮টা গোল করেছেন। কেন তাঁকে দু:স্বপ্নে অলিভার আজও দেখেন, সেটা এখানেই স্পষ্ট।  তাঁর ড্রিবল ছিল র‍্যাপিড, অথচ ভারসাম্যপূর্ণ, তাঁর শরীরী ভাষা ফুটবলের নতুন শব্দভাণ্ডার গড়ে দিয়েছিল।

রোনালদিনহো বলেছিলেন, ‘তিনি আমার আদর্শ।’মেসি বলেছিলেন, ‘তিনি ইতিহাসের সেরা নাম্বার নাইন।’ জিদান নির্বাক্যে তাঁকে নাম্বার ওয়ান মেনে নেন আজও। যারা দেখেননি, তাঁরা ইউটিউব ঘাটেন। যারা দেখেছেন, তাঁদের আজও অবিশ্বাস্য মনে হয়, সত্যি দ্য ফেনোমেনন ছিলেন তো?

রোনালদো লুইস নাজারিও ডি লিমা শিখিয়ে গেছেন, স্ট্রাইকার মানে শুধু গোল করা নয়। স্ট্রাইকার মানে ভয় তৈরি করা। স্ট্রাইকার মানে বিপক্ষ ডাগআউটকে নি:শব্দ করে দেওয়া। নব্বই দশক তাই বুঝে গেছে নাম্বার নাইন মানেই দ্য ফেনোমেনন!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link