এক থা টাইগার!

৪৬ টেস্টে ২৭৯৩ রান বা একটা ডবল সেঞ্চুরি সমেত ছয়টা সেঞ্চুরি আর ১৬ টা হাফ সেঞ্চুরিতে এবং একটি উইকেট নেওয়াতে এই ভদ্রলোকটিকে মানে মনসুর আলী খান পতৌদি ওরফে পতৌদির নবাব টাইগার পতৌদিকে মাপতে যাওয়া আর নিজের জীবনটাকে নম্বরে মাপতে যাওয়া একই ব্যাপার। দুটোতেই বিরাট বড় ভুল হবার সম্ভাবনা।

যখন থেকে ক্রিকেট বুঝতে শুরু করি (৯ বছর বয়সে, ক্লাস ফাইভ, ১৯৬৭ – ইংল্যান্ডে ভারত বনাম ইংল্যান্ড, বিকেল থেকে গভীর রাত, চুরি করে রেডিওতে কমেন্ট্রি শুনতে শুনতে), সেই তখন থেকেই বাল্যপ্রেম এনার সাথে। পরে জানলাম, একটি চোখ হারিয়েছেন। এবং এখনো খেলেন। ব্যাট করেন আর ফিল্ডিং করেন। প্রেম বাড়ল। এই রকম চলতে চলতে চার বছর পার হল – এল ১৯৭১। ইতোমধ্যে আমার ক্রিকেট আকাশে নতুন সূর্য উঠে গেছে – সানি গাভাস্কার। যিনি আজও জ্বলছেন সেখানে।

আরো ৩ বছর পার হল – ১৯৭৪ এল। দুর্দান্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বিশ্বত্রাস ওয়েস্ট ইন্ডিজ এল ভারতে। আহত ক্রিকেটার আর নিহত গর্বে ভরে ওঠা ভারতে অধিনায়ক হবার লোক নেই, এমতাবস্থায় ইডেনে তৃতীয় টেস্ট ২৭-১২-১৯৭৪ থেকে ০১-০১-১৯৭৫। অধিনায়ক হয়ে ফিরে এলেন তিনি, প্রথম দিন ৩২/৩ অবস্থায় মাঠে নেমে ৬৮ মিনিটে ছয়টা চার দিয়ে সাজানো ৩৬ (মাঝে চোট পেয়ে বসে গিয়ে আবার ফিরে পরপর চারে ইডেন মাতিয়ে)।

বিশ্বত্রাস রবার্টস-জুলিয়েন-হোল্ডার-গিবসদের বিরুদ্ধে। তখনকার ক্রিকেটে মজে থাকা আম আদমি জানেন, অসম সাহসী বুকের পাটা লাগত তখন এটা করতে গেলে। শেষ পর্যন্ত ভিশি-চন্দ্রর অলৌকিক দক্ষতা এবং তাঁর অনন্য অধিনায়কত্বে ১৯৭৫-এর প্রথম দিনেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানো। আবার উথলে ওঠা প্রেম তাঁর প্রতি। এই স্মৃতিও এনাকে মাপতে যথেষ্ঠ নয়।

আসলে ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম ও শেষ গ্ল্যামারবয়, অন্যতম সেরা অধিনায়ক এবং চিরবিদ্রোহী এই ভদ্রলোক আমাদের মত সাধারণ লোকদের মাপকাঠিতে বেমানান। তাই ওনাকে মাপার চেষ্টা না করাই ভাল। তিনি তো একদিনের ক্রিকেট বা কুড়িবিশ খেলেনইনি কোনদিন। তবু এই মধ্যমেধার একদিনের ক্রিকেট আর কুড়িবিশের জমানা দেখতে দেখতে কেন যে তার কথা আরো বেশী বেশী করে মনে পড়ে যায়?

পাঁচ জানুয়ারি ১৯৪১ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর ২০১১ – এই ৭০ বছরের চেয়ে অনেক বড় পরিধিতে ভারতীয় ক্রিকেটে থেকে গেছেন মনসুর আলী খান পতৌদি। সালাম, নবাব। ক্রিকেট মাঠ থেকে জীবনের মাঠ। কিছু কিছু ভাল দাগ মনে এমনভাবে মনে লাগে যে ওঠেনা। এটাই সত্যি। আজও। কিছু কিছু ‘দাগ আচ্ছে হ্যায়’।

আবার খুব খারাপ একটি দাগও লেগে আছে তাকে ঘিরে থাকা স্মৃতিতে। ২৫-২৮ অক্টোবর ১৯৭৪ অবশিষ্ট ভারতীয় একাদশ ইরানি ট্রফি ফাইনাল খেলেছিল কর্ণাটকের বিরুদ্ধে, আহমেদাবাদে। সে ম্যাচে তরুণ গোপালকৃষ্ণ বসু করেছিলেন ৬২ আর ১০০।

ভারতীয় দলে ঢোকার দরজায় সজোরে ধাক্কা দিচ্ছিলেন তখন তিনি (তার কয়েক মাস আগে ইংল্যান্ডে মার্ক অ্যান্ড স্পেনসারের আনা শপলিফ্টিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত সুধীর নায়েককে টিমে জায়গা করে দিতে গিয়ে টিমে নিশ্চিত গোপালকৃষ্ণ বসুকে টিমে নেননি অজিত ওয়াদেকার, নাহলে সুধীর নায়েক নাকি আত্মহত্যা করতে পারতেন)।

আহমেদাবাদ থেকে বোম্বাইতে ফেরার সময়ে ট্রেনে একটি ক্রিকেটবহির্ভূত ঘটনায় (তারাদের শেষ তর্পণ / ৪র্থ এপিসোড) জড়িয়ে যান ছবির ভদ্রলোক আর গোপালকৃষ্ণ বসু। এর জেরে কয়েক মাস পরে টিমে নিশ্চিত ১১ জনের দলে প্রথমবার নির্বাচিত গোপালকৃষ্ণ বসুকে টিম থেকে বাদ দিয়েছিলেন তখন ভারতীয় অধিনায়ক ছবির এই ভদ্রলোক, বদলে একনাথ সোলকারকে টিমে ঢুকিয়ে।

আর কোনদিন টেস্ট খেলা হয়নি মাত্র একটি ওয়ানডেতে ভারতের ক্যাপ পাওয়া কলকাতার গোপালকৃষ্ণ বসুর এবং বছর তিনেক পরে ক্রিকেট থেকেই তিনি অবসর নিয়ে নেন মাত্র ৩১ বছর বয়সে। নি:সন্দেহে এটি একটি খুব খারাপ দাগ ছিল ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে ভারতীয় অধিনায়ক ছবির এই ভদ্রলোকের জীবনে।

বছর তিনেক হল, তার সঙ্গে আবার দেখা হয়েছে গোপালকৃষ্ণ বসুর। জীবনে না মেলা সমীকরণটা এখন হয়ত মিলিয়ে ফেলেছেন তারা। হয়ত নয়। প্রথম ইনিংস ৭০-এ শেষ হলেও (পাঁচ জানুয়ারী ১৯৪১ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর ২০১১) দ্বিতীয় ইনিংসে এখনো ১০ নট আউট তিনি। আরো বহু বছর চলে যাবে, তবু ক্রিকেট রোমান্টিকতার প্রথম এবং শেষ কথা বলতে কেউ তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতেই পারবেন না এদেশে। গ্যারান্টি।

ভালো থাকবেন প্যাট। আপনার কভার ড্রাইভের মত। আপনার ফিল্ডিং-এর মত। আপনার রোম্যান্টিক ক্রিকেট সত্তার মত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link