এ পৃথিবীর বুকে আঠারো আসুক নেমে

১৮ ডিসেম্বর ২০২২, স্মৃতির গহীনে এক বর্ণিল আলোকচ্ছটা। দীর্ঘ ৩৬ বছরের অবসান। একটা রুপকথার শেষ পাতা জুড়ে নেওয়ার দিন। কাতারের মরুভূমির বুকে লিওনেল মেসি নামক এক ভীনগ্রহের প্রাণির শ্রেষ্ঠত্বের দিন। দিনটি যেন চির অমলিন।

২০২২ সালে মরুর দেশে নেমেছিল সবচেয়ে জমকালো আয়োজন। দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। ফুটবলের দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আসর। সেবারে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে আর্জেন্টিনা ছিল টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই। তবে সৌদি আরবের সাথে প্রথম ম্যাচ হারের পরই যেন হিসেব খানিকটা হয়েছিল এলোমেলো।

তবে ওই যে জাদুকর একজন ছিলেন বটে, লিওনেল মেসি। এক মেসির হাতে বিশ্বকাপটা তুলে দিতে একাট্টা গোটা দল। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ফুটবল সমর্থক অন্তত মেসি নামক মেজিশিয়ানের হাতে দেখতে চেয়েছিলেন সেই স্বর্ণালী ট্রফিটা।

সৌদির সাথে সেই ম্যাচের পরই ভুলগুলো শুধরে নিয়ে অপরাজিত থেকেই বিশ্বকাপের ফাইনেল আর্জেন্টিনা। ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনারকে উৎসর্গ করতেও তো প্রয়োজন ছিল সেই শিরোপা। তবে প্রাপ্তির রাস্তায় সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছিল দুর্ধর্ষ ফান্স।

ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স টানা দ্বিতীয় শিরোপার দ্বারপ্রান্তে। দিদিয়ের দেশমের মত অভিজ্ঞ কোচ তাদের ডাগআউটে। লিওনেল স্কালোনি খানিকটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন বটে। কি এক রোমাঞ্চ ছড়িয়েছিল সেই ম্যাচ! উত্তেজনার পারদ পৌঁছে গিয়েছিল মহাকাশ অবধি। ১২০ মিনিটের রুদ্ধশ্বাস এক লড়াই!

ফাইনালের শুরুটা অবশ্য আর্জেন্টিনার পক্ষেই ছিল। ম্যাচের ২৩ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে গোল করে মেসি এগিয়ে নেন আলবি সেলেস্তাদের। ৩৬ মিনিটে ম্যাক অ্যালিস্টারের পাস থেকে ব্যবধান দ্বিগুণ করে ফেলেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া।

২-০ গোল ব্যবধানে এগিয়ে বিশ্বকাপ জয়ে ক্ষণ গুণতে শুরু করেছে আর্জেন্টিনার দর্শকরা। তবে তখনও খেলার অনেকটাই বাকি। তখনও যে কিলিয়ান এমবাপ্পের নায়ক হওয়া বাকি। ম্যাচ গড়িয়ে গেছে ৭৯ মিনিট অবধি। আর মাত্র ১১ মিনিটের অপেক্ষা।

ঠিক তখনই পেনাল্টি। এবার সেটা আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। এমি মার্টিনেজের দূর্গের এমবাপ্পের প্রথম আঘাত। ব্যবধান কমিয়ে ২-১ করেন এমবাপ্পে। এরপরই যেন ঐশ্বরিক এক শক্তি এসে ভর করে তার উপর। পরের মিনিটে ফ্রান্সকে সমতায় ফেরান এমবাপ্পে।

খেলা চলে যায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানেও কি জম্পেশ লড়াই! দম বন্ধ করে দেওয়ার মত পরিস্থিতি। অতিরিক্ত সময়ে জুলস কুন্ডে চেষ্টা করেছিলেন মেসির করা শট আটকে দিতে। তবে ততক্ষণে গোললাইন অতিক্রম করে ফেলেছে বল। ৩-২ গোলে আবার এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা।

তবুও নির্ধারিত ৩০ মিনিটে খেলা তো শেষ হওয়া প্রয়োজন। শেষ বাশি বেজে ওঠার দুই মিনিট আগে আর্জেন্টিনার জয়োল্লাস খানিকটা বিলম্বিত করে দেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। পেনাল্টিতে পরাস্ত করেন এমিনিয়ালো মার্টিনেজকে। খেলা গড়ায় পেনাল্টি শ্যুটআউটে।

তার আগে অবশ্য সেই অভাবনীয় সেভ এমিলিয়ানো মার্টিনেজের। কাফ মাসেলে আটকে যায় কোলো মুয়ানির করা শট। সেখানেই বরং লেখা হয়ে যায় ফান্সের পরাজয়ের গল্প। টাইব্রেকারে আবার কিংসলে কোমান ও অরিলিয়ন শোয়ামিনি গোল করতে ব্যর্থ হন। চতুর্থ শটে আর্জেন্টিনার পক্ষে মন্টিয়েল গোল করা মাত্রই যেন বিশ্ব জুড়ে এক কম্পনের সৃষ্টি হয়।

বিশ্ব জয়ের কম্পন। হাটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়েন লিওনেল মেসি। সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে খুশিতে আত্মহারান লিওনেল স্কালোনি। চোখ বেয়ে তার আনন্দের অশ্রু গড়িয়েছে সবুজ ঘাসে। কাতার থেকে আর্জেন্টিনার রোজারিও কিংবা এই ছোট্ট বঙ্গ ভূখণ্ডে যেন এক অবিশ্বাসের আনন্দধারা বয়ে যেতে শুরু করে। ঢাকার মধ্যরাতে চারিদিক কম্পিত হতে শুরু করে উচ্ছ্বাসের বুনো উল্লাসে।

শত বঞ্চনা, তিরস্কার আর কটু কথা আর সুদীর্ঘ অপেক্ষার অবসান। আর্জেন্টিনা জিতে নেয় তাদের তৃতীয় শিরোপা। সেই রাতটা ভুলে কি আর যাওয়া যায়। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে মেসির মলিন মুখটা, ২০২২ ফাইনালে স্বর্ণালী ট্রফিতে এঁকে দিয়েছেন ভালবাসা, প্রাপ্তি আর স্বস্তির এক চুম্বন। লিওনেল মেসি তারপরই পেয়ে গেলেন অমরত্ব। সেই অমরত্বকে ছোঁয়ার সাধ্য কার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link