আমাদের ‘বন্ধু’ রানা

সেই ছোটবেলায় জাফর ইকবালের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ পড়তে গিয়ে বইয়ের পাতায় খুঁজে পেয়েছিলাম বন্ধুত্বের নিদর্শন। যেখানে রাশেদ তার সাথী ইকবালকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিল। আহ্বান জানিয়েছিল প্রানের বন্ধু হওয়ার, যে বন্ধুত্ব সারা জীবনের; মরে গেলেও যে বন্ধুত্ব শেষ হয় না। রাশেদের এমন আবেদনে ইকবাল কি বলেছিলে সেটা গল্পকার বলেনি। কিন্তু বাংলার ক্রিকেটের একজন কিংবদন্তি বাস্তবে সাড়া দিয়েছেন এমন আবেদনে।

তিনি মাশরাফি বিন মুতর্জা। যিনি মৃত্যুর পরেও বন্ধু রানাকে মনে রেখেছিলেন, ধারণ করেছিলেন হৃদয়ে। রানা আবার শুধু মাশরাফির বন্ধুই নয়, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রতিভাবান এক স্পিন বোলিং অলরাউন্ডারও ছিলেন। পুরো নাম মানজারুল ইসলাম রানা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে যিনি এসেছিলেন অমিত সম্ভাবনা নিয়ে।

২০০৭ বিশ্বকাপে রফিক, রাজ্জাক, সাকিবের মত এক ঝাঁক বাঁ-হাতি স্পিনার দলে থাকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিমান ধরা হয়নি রানার। কিন্তু বিধাতা ঠিকই তাকে নিজের কাছে ডেকে নিয়েছিলেন। ২০০৭ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ নিয়ে আগের রাতে যখন পরিকল্পনা চলছিল টিম হোটেলে তখন রানার মৃত্যুর খবর পৌঁছেছিল উইন্ডিজে। বিশ্বাস করতে পারেননি বাশার, রফিকরা। মাশরাফিকে তো আর পাওয়াই যায়নি টিম মিটিংয়ে।

একটু খুঁজতেই দেখা গেল নিজের রুমে দরজা আটকে শিশুর মতই গুমরে মরছেন ম্যাশ। রানা তো তার সতীর্থ কিংবা বন্ধু নয়, একেবারে মায়ের পেটের ভাইয়ের মত। সৈয়দ রাসেলকে আলো জ্বালতে দেখে হাউমাউ করে বলেছিলেন, ‘অন্ধকার না হলে ঘুমাতি পারত না রানা!’

শুধু ম্যাশই নয়, সবাই যেন রানার শোকে বাস্তব থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন। মনের ভিতর শুধুই ‘রানা! রানা!’ বলে খুঁজে বেড়িয়েছেন স্মৃতি। একসাথে ক্রিকেট মাঠে দারুন একজন ক্রিকেটারের স্মৃতি কিংবা টিম আড্ডায় সদা হাসিখুশি এক তরুনের স্মৃতি।

পরেরদিন বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ। টেন্ডুলকার, যুবরাজ, শেবাগ, জহির খানের মত তারকাখচিত ভারতের বিপক্ষে শোকে মূহ্যমান এক বাংলাদেশ। ভুল হয়েছে, শোককে শক্তিতে পরিনত করে বাংলাদেশ তখন শক্তিমান। ম্যাচের আগে মাশরাফির ‘ধরে দিবানি’ এর মত অনুপ্রেরণা আর ম্যাচ শুরু থেকেই সাদা গোলকটাকে গোলার মত করে ছুঁড়তে থাকা; জয়ের ভিত গড়ে দেয়ার জন্য এই যথেষ্ট ছিল। একাই চার উইকেট নিয়ে শক্তিশালী ভারতীয় ব্যাটিং লাইন আপকে ১৯১ রানে আটকে ফেলেছিলেন ম্যাশ। ম্যাশের শুরুর স্পেলে উথাপ্পা, শেবাগ রীতিমত বিধ্বস্ত হয়ে ফিরেছিলেন ড্রেসিং রুমে।

এরপর রাজ্জাক,রফিক মিলে ভারতের শক্তিশালী মিডল অর্ডার গুড়িয়ে দিয়ে বাকি কাজ সেরে রেখেছিলেন। প্রতিরোধ যা ছিল তা শুধুই যুবরাজের ব্যাটে, সাথে সৌরভ গাঙ্গুলিও ছিলেন। তবু ইন ফর্ম এক ব্যাটিং লাইন আপ নিয়েও দুইশো ছুঁয়ে দেখতে পারেনি টিম ইন্ডিয়া।

এরপরের দায়িত্বটা ছিল ব্যাটসম্যানদের। তামিম, সাকিব, মুশফিক এর দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি ভারত। তামিমের ডাউন দ্য উইকেটে এসে জহির খানকে মারা সেই ছক্কা এখনো মানস চোখে দিব্যি দেখা যায়। তিনজনই পেয়েছিলেন অর্ধশতক। তিন তরুণের এমন ব্যাটিংয়ে ভারতের দেয়া লক্ষ্য তাড়া করে যখন জিতে গেল বাংলাদেশ তখন বিশ্বকাপ না খেলেও বিশ্বকাপের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন রানা। জয়টা যে তারই জন্য, জয়টা রানার জন্য। ম্যাচের শুরুতে রানার জন্য এক মিনিটের নিরবতা আর শেষে তার জন্য জেতা। না থেকেও যেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ মানজারুল ইসলাম রানা।

আচ্ছা মানজারুল ইসলাম রানা কি এই ম্যাচটা দেখছিলেন? রহস্যময় অজানা যে ভুবনে চলে গেছেন তিনি, সেখান থেকে কি ক্রিকেটটা দেখা যায়? ভাবা যায় ক্রিকেট নিয়ে?

সব সময় হাসি মুখে থাকা রানার হাসিটা হয়তো আরো চওড়া হয়েছিল বাংলাদেশের এমন অর্জনে। রানার মুখে হাসি ফোটানোর প্রতিজ্ঞা নিয়েই তো মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। সেই প্রতিজ্ঞা পূরণ করে ২০০৭ বিশ্বকাপকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ।

২০০৭ সালের ১৬ মার্চ। সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ ক্রিকেটের একজন ভবিষ্যতের কাণ্ডারি চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে। তবু তিনি আছেন আমাদের মাঝেই। মানজারুল ইসলাম রানা ভাই, আজও আপনাকে খুঁজে ফিরি তারকাখচিত রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে। আপনি আজও বেঁচে আছেন ‘চিরতরুণ’ হয়ে, আছেন আকাশের ‘উজ্জ্বলতম নক্ষত্র’ হয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link