রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক শতাব্দীরও বেশি আগে তাঁর বিখ্যাত ‘জীবিত ও মৃত’ ছোটগল্পটি লিখে গিয়েছিলেন। সেই গল্পের মূল চরিত্র কাদম্বিনী শেষ পর্যন্ত মরিয়া প্রমাণ করেছিল যে সে মরে নাই। বাংলাদেশের পেসারদের অবস্থাও ঠিক এতটাই করুণ। ইনজুরির কারণে এর আগেও অনেক সম্ভাবনাময় পেসারকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। তবুও পেসারদের কাজের চাপের ব্যাপারে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অবহেলা থামছেই না। তাসকিন আহমেদ, শরিফুল ইসলামদের তাই ইনজুরি বাঁধিয়েই প্রমাণ করতে হয় তাঁদের একটু বিশ্রাম প্রয়োজন।
মাশরাফি বিন মর্তুজার বলের গতি নিয়ে তখন দেশের ক্রিকেট তোলপাড়। অনুর্ধ্ব ১৭ এর হয়ে খেলতে থাকা এই পেসারকে তখন নিয়ে আসা হলো বাংলাদেশ ‘এ’ দলে। ভারতও গতির ঝড় তুলে আসলেন, সাথে একটা ছোট নিগলও ছিল। এরপরই খুব দ্রুত জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হলো। টানা খেলেই যাচ্ছিলেন তখন মাত্র ১৮ তে পা দেয়া কৌশিক।
এরপর আলোচনা হচ্ছিল তাঁকে অনূর্ধ্ব১৯ বিশ্বকাপ খেলতে পাঠানো হবে নাকি জাতীয় দলের হয়ে নিউজিল্যান্ডে টেস্ট খেলতে পাঠানো হবে। সেই সময় বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন সবার আগে ছেলেটার বিশ্রাম প্রয়োজন। এরপর কোন চোঁট পেলে সেটা ভয়াবহ হতে পারে। তবুও বাংলাদেশ এমন একটা পেসারকে নিউজিল্যান্ডে না খেলানোর লোভ সামলাতে পারেনি।
হ্যামিলটনে এক প্রান্ত থেকে প্রায় ৩০ ওভার বল করানো হলো মাশরাফিকে দিয়েই। পরের টেস্টেই লিগামেন্টের ইনজুরিতে পড়লেন। সেদিনই আসলে মাশরাফিকে আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম। এরপর আমরা যে পেসার মাশরাফিকে দেখেছি সেটা স্রেফ একটা ছায়া ছিল। ওই সময় মাশরাফি কতটা জোরে বল করতে পারতো তা নাকি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবেনা। এরপর মাশরাফির জীবনে যত ইনজুরি, অপারেশন হয়েছে এগুলো সবকিছুর সূত্রপাতই আসলে সেই নিউজিল্যান্ড সিরিজ।
ফলে মাশরাফি বিন মর্তুজার পুরোটা কখনোই বাংলাদেশ পায়নি। পেসারদের শরীরের যত্ন না নিলে কী ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে তা ম্যাশকে দেখলেই বোঝা যায়। ২০০১ সালে করা সেই ভুল কী বাংলাদেশ আজ ২০২২ সালে এসেও করছে না? মাশরাফিদের মত পেসারদের হারিয়ে ফেলা থেকে কী কোন শিক্ষাই বাংলাদেশের ক্রিকেট নিতে পেরেছিল? এই সময়ে এসে দাঁড়িয়েও অন্তত তাঁর প্রতিফলন দেখা যায় না।
গত একবছরে বাংলাদেশের পেস আক্রমণে একটা বিপ্লব এসেছে। যার আগ্রভাগের সেনানী তাসকিন আহমেদ ও শরিফুল ইসলাম। এই দুই পেসার একবছর ধরেই দারুণ বোলিং করে যাচ্ছেন। দুইজন সত্যিই শুধু বোলিংটাই করে যাচ্ছেন, বিশ্রাম আর নিতে পারেননি।
তাসকিন আহমেদ ফিরে আসার পর থেকেই টানা ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি এমনকি টেস্ট তিন ফরম্যাটেই বাংলাদেশের পেস আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ওদিকে শরিফুল শুরু করেছিলেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট দিয়ে। এরপর ওয়ানডে, টেস্টেও তাঁকে আনা হলো। তাসকিন আহমেদ কিংবা একুশ বছরের শরিফুল কেউই একটু বিশ্রাম পাননি।
এবছর নিউজিল্যান্ড থেকে ফেরার পরই তাসকিন আহমেদে কাধের ইনজুরিটা ধরা পড়ে। সেটা বাংলাদেশ দল নিশ্চয়ই জানতো। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে তাসকিন ওয়ানডে সিরিজ খেললেন। আবার প্রথম টেস্টেও মাঠে নামানো হলো তাঁকে। তাসকিন ক্রাইস্টচার্চে এক ইনিংসে ৩২ ওভার বোলিং করার পর ডারবানে করলেন ২৩ ওভার। ওখানেই কাধের ইনজুরিটা মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো। ফলে বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় টেস্টের আগেই দেশে ফেরত পাঠাতে হলো তাসকিনকে। সাথে ফিরে এসেছিলেন শরিফুলও।
তাসকিনের এই ইনজুরির পিছনের কারণ হিসেবে এই টানা খেলা যাওয়াকেই মনে করেন তাসকিনের মেন্টর মাহবুব আলী জাকি। এই কোচ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি লিগ থেকেই কিন্তু সে টানা খেলে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও তিন ফরম্যাটেই খেলছে। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটের চাও নেয়াটা খুব কঠিন। তাঁকে কোন ম্যাচ খেলানো হবে, আর কোন ম্যাচে বিশ্রাম দেয়া হবে সেটা নিয়ে বাংলাদেশের আরো অনেক বেশি সতর্ক হওয়া উচিৎ ছিল। এখন তো বিদেশি কোচরা আছেন , তাঁদের উচিৎ ছিল তাসকিনের শরীরের খেয়াল রাখা। তাঁদের দিকেও তাই আঙুলটা তুলতে হয়।’
ওদিকে বিসিবির প্রধান চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরীর কথায়ও তাসকিন, শরিফুলদের শরীরের উপর বাড়তি চাপের ইঙ্গিত স্পষ্ট। এই চিকিৎসক বলেন, ‘দেখুন ক্রিকেটারদের শরীরের ওপর তো বাড়তি চাপ যায়ই। আমরা এটাকে বলি ওয়ার্কলোড ম্যানেজম্যান্ট। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি, আমার মনে হয় আরো ভালো ভাবে করার সুযোগ আছে। কারণ দেখুন ওরা তো টানা ক্রিকেট খেলে যাচ্ছে। শুধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না, বিপিএল বা ডিপিএলের মত আসরগুলো খেলছে। ফলে এত চাপ ওদের শরীরের পক্ষে নেয়া কঠিন।’
বিসিবির প্রধান চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী এবং তাসকিনের কোচ মাহবুব আলী জাকির কথায় স্পষ্ট ফুটে উঠে তাসকিন, শরিফুলদের শরীরের উপর দিয়ে আসলে ঠিক কতটা চাপ গিয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে মাশরাফি বিন মর্তুজার ঘটনা থেকে তাহলে ঠিক কী শিক্ষা নিল। নাকি তাসকিন, শরিফুলদের বারবার ইনজুরিতে পড়েই প্রমাণ করতে হবে যে তাঁদের একটু বিশ্রাম প্রয়োজন।