ইনিংস ঘোষণা ও কিছু কথা

এগুলো ছাড়াও কয়েকটা অদ্ভুত ডিক্লেরেশনের কথা মনে পড়ছে। ২০১৩ সালে যেবার অস্ট্রেলিয়া ভারতে এলো, দ্বিতীয় টেস্টে ক্লার্ক অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসের দান ছেড়ে দেন অস্ট্রেলিয়া ২৩৭ রানে ৯ উইকেট এই অবস্থায়। কারণটা আর কিছুই না, চাপে থাকা সেহওয়াগের বিরুদ্ধে ফর্মে থাকা প্যাটিনসনকে দিনের শেষ দশ মিনিট লেলিয়ে দেওয়া। তা সেদিন ৩ ওভারে উইকেটও পড়েনি আর অস্ট্রেলিয়া লজ্জাজনক ভাবে টেস্ট ম্যাচটি হেরেও যায়।

২৪ বছর পর পাকিস্তানে খেলতে গিয়ে সিরিজ জিতেই নিলো অস্ট্রেলিয়া। মোটামুটি ঘুমিয়ে থাকা পিচে ঢুলতে থাকা সিরিজে দ্বিতীয় টেস্টের শেষ দিন একটু আধটু কফির যোগান দেন পাক অধিনায়ক বাবর আজম। আর শেষ টেস্টে তাঁর প্রতিপক্ষ অধিনায়ক। শুধু অসাধারণ বোলিং তো নয়। সে তো তিনি বরাবর করেই থাকেন।

মোটামুটি ভাবে মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গোনা সিরিজকে  তিনি যে ডিক্লেরেশনের ইঞ্জেকশনটি দিলেন, তা একেবারে মোক্ষম। এমনিতে লাহোরের পিচ করাচি বা রাওয়ালপিন্ডির চেয়ে কিছুটা চনমনে দেখালেও, ব্যাটিং করা মোটেই কঠিন ছিল না। বিশেষত গত ম্যাচে বাবরের ওই ইনিংসের পর, অনেক অধিনায়কই ৩৫০ রান ও প্রায় ১২০ ওভার হাতে নিয়ে দান ছাড়তে পারতেন না।

লাহোরের পিচে ওই রান এবং সময়টা একেবারেই জীবন বিমা নয়। বড়জোর টার্ম প্ল্যান বলা যায়। কামিন্স ঠিক এখানেই তাঁর অধিনায়কত্বের এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড়ো সিদ্ধান্তটি নিলেন। এবং নিলেন বলেই হয়তো সিরিজ জিতে ফিরলেন। এশেজ সিরিজ অস্ট্রেলিয়া জিতলেও, কামিন্সের অধিনায়কত্ব নিয়ে অনেকেই হালকা নাক শিঁটকেছেন। এবং এই ‘অনেকের’ মধ্যে আছেন ইয়ান চ্যাপেল।

টেস্ট অধিনায়কত্ব ব্যাপারটা যিনি খুব খারাপ বোঝেন না। জানি না কামিন্সের এই ডিক্লেরেশন নিয়ে তাঁর কি মতামত হবে। তবে আমার ব্যক্তিগত ভাবে কামিন্সের এই ডিক্লেরেশন দারুন লেগেছে। আর ঠিক সেই কারণেই ডিক্লেরেশন নিয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে আর দু চার কথা বলে যাই।

উইজডেনের বিচারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ইনিংস ১৩৬-৩৭ অ্যাশেজে মেলবোর্নে ব্র্যাডম্যানের ২৭০। তা এই ইনিংসটাই তো দুটো অসম্ভব সাহসী অথচ ট্যাকটিক্যাল ডিক্লেরেশনের সন্তান। অধিনায়ক হিসাবে সবে তৃতীয় টেস্ট খেলতে নামা ব্র্যাডম্যান সন্তান বিয়োগ, সিরিজে ২-০ পিছিয়ে থাকা, প্রেসের ভনভনানি, দল নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক, নিজের খারাপ ফর্ম (চার ইনিংসে দুই ০) সব নিয়ে একেবারে জেরবার। তা প্রথম ইনিংসে ডনের সংগ্রহ মাত্র। যে শটে তিনি আউট হন, সি.বি. ফ্রাই নাকি সেটা দেখে লিখেছিলেন, ‘বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ব্যাট, বিশ্বের কদর্যতম শট খেলে আউট হলেন।’

অস্ট্রেলিয়া যখন ২০০ রানে ৯ উইকেট তখন হঠাৎ দান ছেড়ে দিলেন ডন। এমনিতে অবশ্য চাক ফ্লিটউড স্মিথের ব্যাট করা বা না করা প্রায় সমান। তবুও টাইমলেস টেস্টে এভাবে দান ছাড়া খুব একটা প্রচলিত ছিল না। ডনের দান ছাড়ার প্রধান কারণ ছিল, আগের দিনের বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া পিচ বেশি শুকিয়ে যাবার আগে বল করা। এরপর ইংল্যান্ড যখন ৭৬ রানে ৯ উইকেট, ইংরেজ অধিনায়ক গাবি এলেন দান ছেড়ে দিলেন।

কারণ পিচ তখনও খানিক ভিজে। অস্ট্রেলিয়াকে ওই পিচে ব্যাট করতে পাঠানোই তাঁর মূল লক্ষ্য। ভিজে পিচে ব্যাট করা এতটাই কষ্টকর ! সিরিজে আগের দুই ম্যাচেও অস্ট্রেলিয়া এই ভিজে পিচের চক্করে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছে। ব্রিসবেনে ৫৮ অল আউট ও সিডনিতে ৮০। অস্ট্রেলিয়া তো ইংল্যান্ডের ইনিংসের শেষের দিকে ইংল্যান্ডকে আউট করার লক্ষ্য নিয়ে নয়, কোনোরকমে দিনটা কাটানোর লক্ষ্যে বল করছিলো। সম্ভবত সেই কারণেই দান ছেড়ে দেন গাবি এলেন।

এরপরেই তাঁর অধিনায়ক জীবনের অন্যতম চালটি চালেন ব্র্যাডম্যান। ব্যাটিং অর্ডারই উল্টে দেন। টেস্ট ক্রিকেটের দুই সর্বকালের অন্যতম খারাপ ব্যাটার বিল ওরাইলি এবং চাক ফ্লিটউড স্মিথ ওপেন করেন। ফ্লিটউড স্মিথ ডনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমাকেই কেন বলির পাঁঠা করলে?’

ব্র্যাডম্যান উত্তর দেন, ‘আরে তোমার ব্যাটে বল লাগলেই তুমি আউট হও । ভালো পিচেই ব্যাটে বল লাগাতে পারো না। খারাপ পিচে তার প্রশ্নই নেই।’ বড়ো অদ্ভুত যুক্তি ! কিন্তু ব্র্যাডম্যান অপেক্ষা করছিলেন পিচ খানিক শুকিয়ে যাবার। নিজে নামেন ৭ নম্বরে। স্ট্যান ম্যাকেব নামেন ৮ নম্বরে। তা ৭ নম্বরে নেমে যা খেলে দিলেন, অস্ট্রেলিয়া টেস্ট তো জিতলোই, সিরিজ ও জিতলো। ২-০ পিছিয়ে পাঁচ টেস্টের সিরিজ জেতার নজির টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে এই একটিই।
তবে সব ডিক্লেরেশনের গল্প আবার এরকম ‘গ্লোরিয়াস’ ভাবে শেষ হয় না।

সোবার্সের কথাই ধরুন। তিন টেস্টের সিরিজ ০-০ এই অবস্থায়, চতুর্থ টেস্টে অলস ভাবে বয়ে চলা টেস্ট ম্যাচে প্রাণ ফেরায় সোবার্সের ডিক্লেরেশন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৯২ রানে ২ উইকেট ও এবং ম্যাচের দুটি সেশন বাকি, এই অবস্থায় সোবার্স দান ছেড়ে দেন ইংল্যান্ডকে ২১৫ রানের লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে।খানিক ইংরেজদের স্লো ওভার রেটে বিরক্ত হয়ে, খানিক ইংরেজদের স্লো ব্যাটিংয়ের ওপর ভরসা করে, যে বয়কট ও কাউড্রে এই রান এতো কম সময়ে পারবে না। অধিনায়ক কাউড্রেকে মোটামুটি জোর করে রানটি চেজ করানো হয়। এবং ৭৫ মিনিটে ৭১ করে কাউড্রে এবং কি আশ্চর্য্য, ‘পাথরের দেওয়াল’ বয়কট মিলে ৫২ ওভারে রানটি তুলে দেন।

খানিকটা একই রকম ভাবে গ্রেম স্মিথের সাহসি ডিক্লেরেশন পন্টিংয়ের সামনে উড়ে যায়। সিডনি ২০০৬। পন্টিংয়ের শততম টেস্ট। সিরিজে ১-০ পিছিয়ে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক স্মিথ দুই সেশন বাকি থাকতে অস্ট্রেলিয়াকে ২৮৮ রানের লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে দান ছেড়ে দেন। পন্টিংয়ের কল্যানে ৬০ ওভারে অস্ট্রেলিয়া জিতে যায়।

এগুলো ছাড়াও কয়েকটা অদ্ভুত ডিক্লেরেশনের কথা মনে পড়ছে। ২০১৩ সালে যেবার অস্ট্রেলিয়া ভারতে এলো, দ্বিতীয় টেস্টে ক্লার্ক অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসের দান ছেড়ে দেন অস্ট্রেলিয়া ২৩৭ রানে ৯ উইকেট এই অবস্থায়। কারণটা আর কিছুই না, চাপে থাকা সেহওয়াগের বিরুদ্ধে ফর্মে থাকা প্যাটিনসনকে দিনের শেষ দশ মিনিট লেলিয়ে দেওয়া। তা সেদিন ৩ ওভারে উইকেটও পড়েনি আর অস্ট্রেলিয়া লজ্জাজনক ভাবে টেস্ট ম্যাচটি হেরেও যায়।

১৯৭৬ সালে হোল্ডিংয়ের গোলাবারুদের সামনে বেদির ডিক্লেরেশন আজও ভোলার নয়। তবে ভারতীয় মায় বাঙালি ক্রিকেট জনতা তো! তাই ডিক্লেরেশন বললেই, দুই ভিন্ন সিরিজে হওয়া পরপর দুটি টেস্টের কথা আলোচনায় এসেই যায়। প্রথমটি অতিমাত্রায় রক্ষণশীল ভাবে ডিক্লেরেশন না দেবার গল্প। দ্বিতীয়টি আবার মৌচাকের একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে ঢিল মারার মতো সাহস দেখানোর মতো অথচ বিতর্কিত একটি ডিক্লেরেশন। এই দুটি ডিক্লেরেশনের সাথে যুক্ত দুই অধিনায়ক বর্তমানে বোর্ড প্রেসিডেন্ট ও ভারতীয় দলের কোচ। কি অদ্ভুত বৈপরীত্য না? এখন অবধিই থাক!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...