ক্রিকেটের প্রতাপশালী কিংবা শক্তিশালী যা-ই বলেন না কেনো সেখানে অস্ট্রেলিয়ার নাম যেন অবধারিত। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীনতম ক্রিকেট খেলুড়ে দল তাঁরা। তাছাড়া তাঁদের ঝুলিতে আছে পাঁচটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ। সেই সাথে একটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও সম্প্রতি যোগ হয়েছে। এমন এক দলের সাথে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে যাওয়াটাও যেন সবচেয়ে বড় বিষয়। নবাগত দলগুলোর হয়ত প্রত্যাশাও থাকে ঠিক ততটুকুই।
অন্যদিকে, ক্রিকেটের পদচারণের পর থেকেই অনিশ্চিত এক দল পাকিস্তান। বল ব্যাটে সব সময়ই পাকিস্তান ছিল এক পরাশক্তি। তবে তাঁরা কখন কি করবে, তা যেন জানা ছিল না কারোই। সমশক্তির প্রতিপক্ষকে হারিয়ে নিজেরা হেরে যেত অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দলের কাছে। হেরে যাওয়ার কম রেকর্ড নেই পাকিস্তানের। ক্রিকেটের ইতিহাস এই দুই দল মুখোমুখি হয়েছে বহুবার।
হরেক রকমের কাণ্ডকারখানাও হয়েছে এই দুই দলের ম্যাচকে ঘিরে। পাকিস্তান ক্রিকেটের প্রেক্ষাপট থেকে চিন্তা করলে বেশকিছু স্মরণীয় দৃশ্যের মঞ্চায়ন হয়েছে বারংবার। স্মৃতির গভীর অরণ্য থেকে সেই সব দৃশ্যগুলো নিয়েই হবে আজকের আলোচনা।
- ইমরান খান ও কোণঠাসা বাঘ
পাকিস্তান ক্রিকেট ভক্ত এমন যারা ত্রিশটি বসন্ত অন্তত দেখে ফেলেছেন তাঁদের কাছে পাকিস্তান ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় গর্বের দিন হয়ত ২৫ মার্চ ১৯৯২। সেদিন প্রথমবারের মত ওয়ানডে বিশ্বকাপটা ঘরে তুলেছে পাকিস্তান। তবে তাঁর থেকেও আইকনিক ঘটনা ঘটেছিল ১১ মার্চ ১৯৯২ সালে। সে দিনটায় অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তান। বিশ্বকাপে পাকিস্তান তখন কোণঠাসা বাঘ।
সেই ম্যাচে পাকিস্তানের অধিনায়ক ছিলেন ইমরান খান। টসের জন্য যখন বাইশ গজে এলেন দুই দলের অধিনায়ক তখন স্বাভাবিক ভাবেই অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডার এলেন অজি জার্সিতেই। তবে, ইমরান খানের পোশাকে ছিল ভিন্নতা। একটা সাদা টি-শার্টের মধ্যখানে গর্জনকৃত এক বাঘের ছবি।
সেই টি-শার্ট পরে টসে আসার রহস্য অবশ্য পরে জানিয়েছিলেন ইমরান খান। তিনি তাঁর সতীর্থদের বলেছিলেন, কোণঠাসা বাঘের মত প্রতিটা ম্যাচে লড়াই করতে। যেই বাঘের লড়াই করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। সেই এক টোটকাই উজ্জীবিত করেছিল পাকিস্তানের বাকি খেলোয়াড়দের ইতিহাস গড়তে।
- ইয়ান হিলির ও ইনজামামের উইকেট
প্রায় ২১টি বছর কেটে গিয়েছে। তবুও অস্ট্রেলিয়ার সাবেক উইকেট রক্ষক ইয়ান হিলি হয়ত আজও ভুলতে পারেননি ইনজামাম-উল হককে আউট করবার এক সুযোগ। ঘটনাটা ১৯৯৪ এর। পাকিস্তানের করাচিতে তপ্ত এক দিনের ঘটনা। টেস্ট ম্যাচে মুখোমুখি পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া। কি এক অভূতপূর্ব ম্যাচটাই না হয়েছিল সেবার! দায়িত্ব-রত আম্পায়ার ডিকি বার্ড বলেই ফেলেছিলেন সেই ম্যাচটি ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা ম্যাচ।
টার্নিং এক উইকেটে ক্ষণে ক্ষণে বদলেছে পরিস্থিতি। তবে খেলা ঠিকই গড়িয়েছিল পঞ্চম দিনে। শেষ ইনিংসে পাকিস্তানের জয়ের জন্য প্রয়োজন রেকর্ড পরিমাণ রান। ৩১৪ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে পাকিস্তান ২৫৮ রানে হারায় নয় উইকেট। শেষ জুঁটি মুশতাক আহমেদ ও ইনজামাম উল হকের। সেই জুঁটির ম্যাচ বের করে আনতে প্রয়োজন ছিল ৫৫ রান।
একমাত্র স্বীকৃত ব্যাটার ছিলেন ইনজামাম। ঘূর্ণি পিচে শেন ওয়ার্নের ঘূর্ণিতে পরাস্ত হন ডাউন দ্য উইকেট আসা ইনজামাম। তখন দলের জয়ে প্রয়োজন মাত্র তিন রান। ক্রিজের বেশ বাইরেই ছিলেন তিনি। ওয়ার্নের ঘূর্ণিতে শুধু ইনজামাম ধোঁকা খেয়েছিলেন তা নয়। ইয়ান হিলিও পরাস্ত হন। নিশ্চিত স্ট্যাম্পিং মিস করেন হিলি। আর বল গড়িয়ে চলে যায় বাউন্ডারি লাইনে। অবিশ্বাস্য এক জয়ের সাক্ষী করাচি।
- ম্যাকগ্রার বিপক্ষে রাজ্জাকে টানা পাঁচ বাউন্ডারি
গ্লেন ম্যাকগ্রা ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা বোলার সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে সেই সেরা বোলারকে একহাত দেখে নিয়েছিলেন পাকিস্তানের অলরাউন্ডার আব্দুল রাজ্জাক। ২০০০ সালের দিকে সিডনির পেস বান্ধব উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ পাকিস্তানের। সে ম্যাচেই নিজের পেশি শক্তির প্রদর্শন করেছিলেন আব্দুল রাজ্জাক।
কোন এক কোচের টোটকা তাঁর ক্যারিয়ারে বেশ কাজে দিয়েছিল। সেই টোটকার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন রাজ্জাক। তাও আবার ম্যাকগ্রার বলে। পাকিস্তানের ব্যাটিং ইনিংসের ম্যাকগ্রার পঞ্চম ওভারের একেবারে শুরু থেকেই তাঁর উপর চড়াও হন রাজ্জাক। পরপর পাঁচ বলে হাঁকান পাঁচটি বাউন্ডারি। নিশ্চয়ই ইতিহাস সেরা বোলারকে ওমন বেদম পিটুনি ভুলে যায়নি পাকিস্তানের ক্রিকেট সমর্থকরা।
- আন্ড্রু সায়মন্ডসের ১৪৩
২০০৩ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনুস। প্রত্যাশার এক পারদ কাঁধে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমিয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির খেলোয়াড়রা। তবে সে টুর্নামেন্টটা পাকিস্তানের কেটেছে যাচ্ছেতাই ভাবে। সেই বিশ্বকাপই ছিল তারকাদের শেষ বিশ্বকাপ।
ভুলে যাওয়ার মত যাত্রার শুরুটা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচটায় পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে শুরুটা ভালই হয়েছিল পাকিস্তানের। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নামা অজিদের বিপাকে ফেলেন ওয়াসিম আকরাম।
একটা পর্যায়ে ৮৬ রানে চার উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল অস্ট্রেলিয়া। সেই পরিস্থিতি থেকে পাকিস্তানি বোলারদের শাসন করে অ্যান্ড্রু সায়মন্ডন্স খেলেন অনবদ্য ১৪৩ রানের এক দুর্দান্ত ইনিংস। সেই ম্যাচ দিয়ে অস্ট্রেলিয়া তাঁদের বিশ্বকাপ জয়ের যাত্রা শুরু করে।
- মাইক হাসির ব্যাটিং ঝড়
অস্ট্রেলিয়া আর পাকিস্তানের ম্যাচ গুলো সব সময়ই তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয় তার আরো একটি উদাহরণ ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। উমর আকমলের দারুণ ব্যাটিং এর উপর ভর করে ১৯২ রানের বিশাল এক টার্গেট অস্ট্রেলিয়াকে ছুঁড়ে দেয় পাকিস্তান। অস্ট্রেলিয়ার জন্য ২০ ওভারে সেটা এক বেশ বড় টার্গেট।
তাছাড়া পাকিস্তানের বোলাররাও ছিল চিন্তার বড় কারণ। পাকিস্তানের প্রতিটি বোলার অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটারদের রেখেছিলেন দারুণ চাপে। তবে একজন সেই চাপ শুষে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালান। তিনি ছিলেন মাইক হাসি। ১৪৪ রানে সাত উইকেট হারিয়ে ফেলে একটা পর্যায়ে অজিরা।
তখনও প্রয়োজন ১৭ বলে ৪৮ রান। সেই রান তাড়া করতে গিয়ে শেষ ওভারে ১৮ রানের দরকার ছিল জয়ের জন্য। শেষ ওভারে সায়েদ আজমলের চার বলে তিন ছয় ও এক চার মেরে নিজেদের জয় সুনিশ্চিত করেন হাসি। আর অস্ট্রেলিয়া চলে যায় ফাইনালে।
- আবারও সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বাঁধা
২০১০ বিশ্বকাপের পুনরাবৃত্তিই যেন ঘটেছিল ২০২১ সালে হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। আবারও মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া। অপ্রতিরোধ্য পাকিস্তান ছিল শিরোপার দাবিদার। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়াও ছিল হট ফেভারিট দল। ২০ ওভারে অস্ট্রেলিয়াকে ১৭৭ রানের টার্গেট দিয়েছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণ বরাবরই সেরা।
এর ব্যতিক্রম ছিল না ২০২১ বিশ্বকাপেও। সেই সেরা বোলিং আক্রমণকে প্রথম শাসন করেন ডেভিড ওয়ার্নার। এরপর পরিস্থিতি হয়ে যায় প্যান্ডুলাম। তবে সেই প্যান্ডুলাম দাঁড়িপাল্লা হয়ে ঝুঁকে যায় অস্ট্রেলিয়ার দিকে। মার্কাস স্টোয়িনিস ও ম্যাথু ওয়েড দলকে নিয়ে যান জয়ের দিকে। ১৭ বলের ৪১ রানের ওয়েডের ক্যামিও ভুলে যাওয়া দুস্কর। সেই ম্যাচটিও তো ভুলে যাওয়া খুব সহজ নয়।