এত চাপ নিতে পারবেন তো পেদ্রি!

ন্যু ক্যাম্পের বিশ্বাস তাঁরা পরবর্তী স্টারের দেখা পেয়ে গিয়েছে। সেটা লিওনেল মেসি থাকতেই। জাভি-ইনিয়েস্তা চলে যাওয়ার পর থেকে বার্সেলোনায় ঠিক যুৎসই ক্রিয়েটর খুঁজে পাচ্ছিল না মাঝমাঠে। যে কারণে লিওনেল মেসিকেই অনেকটা নিচে এসে খেলতে হয়েছে অনেকদিন।

কিন্তু লিওনেল মেসি যখন থাকবেন কী থাকবেন না দোটানায়, বার্সেলোনা সমর্থকেরা তখন তাকে ধরে রাখার মতন তারকা পেয়ে গিয়েছিলেন তারা। এমনও বলা হয়েছিল, মেসি নাকি তাকে দেখেই বার্সেলোনাতে থাকার নতুন কারণ খুঁজে পেয়েছেন। বলাটা কোনো অংশে ভুল নয়, অনেক বছর ধরেই বার্সেলোনায় নিজের মতন পার্টনার খুঁজে পাচ্ছিলেন না মেসি। আর সে জায়গাতেই নাম লিখিয়েছিলেন স্প্যানিশ ইয়াংস্টার পেদ্রি!

২০১৯ সালে যখন পেদ্রিকে কেনা সমপন্ন করে বার্সেলোনা, তখন লাস পালমাসের ম্যানেজার পেপে মেল ট্রান্সফারটাকে আখ্যা দিয়েছিলেন, ‘বার্সার নতুন যুগ’ হিসেবে। ছোট দল থেকে বড় দলে খেলোয়াড় বিক্রি করলে সলের মালিকরা এমন অনেক কিছুই বলে থাকে। কিন্তু পেদ্রির ব্যাপারটা যে ছিল সম্পূর্ণ আলাদা তা মৌসুম শুরু হতে না হতেই বোঝা যায়। সত্যি বলতে এতে চমকাবার কিছু নেই। বরং ছোটখাটো দল থেকে বড় দলে কোনো ইয়াংস্টার মুভ করলে সাবেক কোচেরা এমনটা বলেই থাকেন।

কিন্তু ৫ মিলিয়নের বদলে এমন হীরের টুকরো ছেলে এনেছে, এমনটা কে জানতো? রোনাল্ড কোম্যান অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলীন যে এই ভঙ্গুর বার্সেলোনার মাঝমাঠ যদি কেউ সামাল দিতে পারে, তবে সেটা হবেন পেদ্রিই। আর সে কারণেই কীনা লিগের ৩৮ ম্যাচের মধ্যে ৩৭ ম্যাচেই তাকে পাওয়া গিয়েছে মাঠে।

সেখানে তো কেবল শুরু, পিএসজির কাছে হেরে বাদ হয়ে যাওয়ার আগে চ্যাম্পিয়নস লিগে মোট ৮ ম্যাচ খেলতে হয়েছে বার্সাকে। সেখানে আট ম্যাচের সাতটিতেই মাঠে নেমেছিলেন পেদ্রি। কোপা দেল রেতেও তার দেখা মিলেছে প্রতিটি ম্যাচেই। বার্সেলোনার ম্যাচ হলেই তাকে দেখা যাবে মাঠে, এমনটাই ভেবে নিয়েছে দর্শোকেরা। এবং সেটা করেছেনও কোম্যান। তাছাড়া কিছু করবারও ছিল না।

বার্সেলোনার অ্যাটাকে বড় বড় নাম আছে বটে, কিন্তু মাঝমাঠ থেকে বল বানিয়ে দেওয়ার লোক কোথায়? লিওনেল মেসিকে পুরদুস্তর আক্রমণভাগে ছেড়ে দিয়ে পেদ্রিকে দিয়েই মাঝমাঠ সামলানোর কাজটা করতে চেয়েছিলেন কোম্যান। এবং পেদ্রিও সেটা করে গিয়েছেন নিঃসংকোচে। আর এতটা করতে পারার ফলাফল হিসেবে ডাক পরেছে স্পেন দলে। ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত ২০২০ ইউরোর স্পেন দলের মূল তারকার ভারটা এখন পেদ্রির হাতে।

বার্সেলোনার হয়ে কোভিড পরবর্তী মৌসুমে খেলেছেন মোট ৫২ ম্যাচ। এমনিতেই কোভিড পরবর্তী মৌসুম হওয়ায় খেলোয়াড়দের উপর দিয়ে চাপটাও একটু বেশি পরেছে। ম্যাচের মধ্যে হ্যাপ কম, বায়ো-বাওবলে থাকা, সব মিলিয়ে একজন ১৮ বছর বয়সী খেলোয়াড়ের উপর দিয়ে কী যেতে পারে, তা নিশ্চয় বলে বোঝাতে হবে না। কিন্তু পেদ্রি সবটাই মেনে নিয়েছিলেন, নিজের দলকে সাজায্য করার জন্য। আর সেটাই যখন সুযোগ করে দিলো তাকে ইউরো দলে, তখন অনেকেই চিন্তায় পরে গিয়েছিলেন।

অবশ্য একটা দিক দিয়ে স্বস্তিও পেয়েছিলেন তারা। কেন না কোচ হিসেবে আছেন বার্সেলোনারই সাবেক খেলোয়াড় ও কোচ লুইস এনরিকে, ভেবেছিলেন ১৮ বছর বয়সী পেদ্রির ভালোমন্দের দিকটা ভালোভাবে দেখবেন তিনি। কিন্তু প্রথম দুই ম্যাচে বাজে পারফর্ম করা স্প্যানিশ দলের আশার আলো ছিলেন একমাত্র পেদ্রিই। ফলে তাকে আর মাঠ থেকে উঠানোর কথা চিন্তাও করেননি তিনি।

ইউরোতে ৬ ম্যাচ খেলেছে স্পেন, ছয় ম্যাচেই ছিলেন তিনি স্পেনের ভরসার পাত্র হয়ে। ছয় ম্যাচেই ছিলেন পুরোটা সময় মাঠে। এমনকি নক-আউট পর্বের তিন ম্যাচে তো পুরো এক্সট্রা টাইমও কেলেছেন তিনি। বলতে গেলে স্পেনের ইউরো যাত্রার পুরোটা সময়ই তিনি ছিলেন স্পেনের মাঝমাঠের দায়িত্বে। ফলে কাহজে কলমে ৬ ম্যাচ খেললেও প্রেশার পরেছে ৭ ম্যাচের। ইতালির সাথে পেনাল্টিতে হেরে বাদ না পরতে হলে ফাইনালটাও খেলতে হতো তাকে।

ইউরো শেষে বার্সেলোনা সমর্থকেরা যখন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন, ভাবলেন পেদ্রি হয়তো নিজেকে রেস্ট দিয়ে সুস্থ করে ফিরতে পারবে মাঠে, তখনই স্প্যানিশ বোর্ড থেকে ডাক পড়ল, অলিম্পিকে যাওয়ার জন্য। স্প্যানিশ বোর্ডের নিয়ম অন্যুযায়ী অলিম্পিকের কোচ যেসব খেলোয়াড়কে সিলেক্ট করবেন, তাদের ক্লাবকে অবশ্যই অবশ্যই সেই ডাকে সাড়া দিতে হবে।

অলিম্পিকের জন্য অনুর্ধ্ব-২৩ আর তিনজন বেশি বয়স্ক খেলোয়াড় নেওয়া যায়। সে হিসেবে পেদ্রিকে ডেকে পাঠান স্প্যানিশ অলিম্পিক দলের কোচ। বার্সেলোনা আবেদন করেছিল এই ১৮ বছত বয়সী খেলোয়াড়ের উপর আর চাপ আ দিতে, কিন্তু পেদ্রি নিজেই যেতে চেয়েছেন জাপান। ফলে স্পেনে ফেরত আসতে না আসতেই ধরলেন জাপানের প্লেন। আর সেখানে শুরু হলো আরেক স্ট্রাগল।

স্পেনের ট্যাক্টিস ইউরো থেকে অলিম্পিকেও বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। বোরিং ফুটবল, ম্যাচ ড্র করতে পারলেই যেন বাঁচে। দুই ম্যাচ ড্র অরে উঠে কোয়ার্টার ফাইনালে। সেখান থেকে এক্সট্রা টাইমের সূচনা। নক-আউট পর্বের তিন রাউন্ডেই এক্সট্রা টাইমে খেলতে হয়েছে তাদের। যদিও এখানে প্রতিটি ম্যাচে পুরো সময়টা খেলতে হয়নি তাকে। কিন্তু প্রতি ম্যাচের স্টার্টিং এলিভেনে ছিলেন তিনি। ফাইনাল পর্যন্ত খেলতে হয়েছে মোট ৬ টি ম্যাচ। শিরোপার দেখা পাননি, রৌপ্য পদক নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাকে। নিজের ২০২০-২১ মৌসুম শেষ করে যখন নিজের বাড়িতে ফিরলেন পেদ্রি, তখন তার মোট খেলা ম্যাচের সংখ্যা ৭৩!

পেদ্রির জন্য সমস্যাটার শুরু এখন থেকেই, বয়সটা মোটে ১৮। এই বয়সে খেলোয়াড়দের খেলার প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকে, তারা সেভাবে খেলেও। তারা নিয়মিত খেলতেও চায়। বার্সেলোনার থেকে ভালোবাসা থেকে পেদ্রির খেলতে চাওয়াটা দোষের কিছু না, বিশেষ করে যখন দলের বাজে অবস্থা।

সেখানে প্রশ্ন চলে আসে টিম ম্যানেজমেন্ট ও যারা খেলোয়াড়ের ভালোমন্দ দেখছেন তাদের। মৌসুমের শুরু থেকেই এটা জানা, এই মৌসুমটা অন্যসব মৌসুমের মতন হতে যাচ্ছে না। বরং এই মৌসুমটা হতে যাচ্ছে একটু অন্যরকম।

খেলার মধ্যে বিরতি কম, ঘন ঘন কোভিড টেস্ট, এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে যে পরিমাণ প্রোটোকলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তার মুখোমুখি হতে হয়নি কাউকেই। কোনো কোনো খেলোয়াড় মৌসুমের মাঝেই ক্লাবের কাছ থেকে ছুটি চেয়েছিলেন। যেখানে নিয়মিত খেলা খেলোয়াড়দেরই মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো, সেখানে পেদ্রির উপর দিয়ে কী গিয়েছে, সেটা না বললেই নয়।

কিন্তু পেদ্রি বারবার সেটা না মেনে খেলতে চেয়েছেন, শরীরের উপর রেস্ট দেননি। তিনি এমন একটা পজিশনে খেলেন, যেখানে সচরাচর খেলোয়াড় পাল্টানোর কথা মনেও আসে না। সেদিক থেকে ১৮ বছর বয়সী পেদ্রির উপর দিয়ে যে ধকলটা গিয়েছে তা তার মুখ দেখলেই বোঝা যায়। সদা হাস্যোজ্জ্বল একজন খেলোয়াড়ের মুখ ভেঙ্গে গিয়েছে পরিশ্রমে।

এমনই পরিশ্রম দেখিয়েছিলেন ব্রাজিলের অ্যান্ডারসন, স্যার অ্যালেক্সের অধীনে বিওস্ট হয়ে উঠা অ্যান্ডারসন কোনো বাঁধা না মেনেই নিজের শরীরকে পাত্তা না দিয়ে খেলে গিয়েছেন দিনের পর দিন। ২০০৮ অলিম্পিক খেলে এসে কোনো রেস্ট না নিয়ে নেমে পরেছিলেন প্রিমিয়ার লিগ জয়ে। ফলে অল্প বয়সেই পরেছে তার উপর চাপ। সে চাপ শরীর না নিতে পেরে হারিয়ে গিয়েছেন অকালেই। অল্প বয়সে চাপ নিয়ে এমন কত খেলোয়াড় হারিয়ে গিয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই।

পেদ্রির ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা একইরকম। মৌসুমে ৭৩ ম্যাচ খেলা কোনো কম কথা নয়। একজন সাধারণ খেলোয়াড় মৌসুমে ৪০-৫০ ম্যাচ খেলে থাকেন, তাও সেটা মৌসুমের মাঝে কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট থাকলে। সেখানে পেদ্রি দুটো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলেছেন, পুরো মৌসুম খেলছেন, এখন ফিরতে চাচ্ছেন লা লিগাতে। বার্সেলোনাও কিছু বলতে পারছে না।

সত্যি বলতে বলার অবস্থাতেও নেই। মাঝমাঠে মেসি চলে যাওয়ার পর কোম্যানের ভরসা এখন পেদ্রির উপর। তার একক নৈপুণ্যই পারে এখন বাঁচাতে বার্সাকে। তার উপর মাঝমাঠে ডি ইয়ংয়ের চোটের কারণে নিয়মিত হতে হবে পেদ্রিকে। সে কারণে চাইলেও তাকে ছুটি দেওয়ার অবস্থায় নেই বার্সা। আর একবার মৌসুম শুরু হয়ে গেলে ছুটি পাওয়ার সম্ভাবনাও একেবারে কর্পুরের মতন উড়ে যাবে। বার্সেলোনা নিজেদের বর্তমানের জন্য নিজেদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে না তো?

সেখানে ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন চলে আসছে, এত চাপ নিয়ে পারবেন তো পেদ্রি?

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link