পেলে, গর্ডন ব্যাংকস আর একটি অতিমানবীয় সেভ!

পেলে তাঁর ক্যারিয়ারে এক হাজারেরও বেশি গোল করেছেন। সে কথা কারো অজানা নয়। প্রায় দুই যুগের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে শত শত গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে বল জালে জড়িয়েছেন। প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের দূর্গ ভেদ করে ফুটবল বিশ্বকে অসংখ্য জাদুকরী মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন। সে সব মুহূর্ত ঠাই পেয়েছে ইতিহাসে। এমন সব ঐতিহাসিক মুহূর্ত যা যুগের পর যুগ ধরে স্মৃতি রোমন্থনের দারুণ সব উপলক্ষ্য জোগায়।

পেলের গোটা ক্যারিয়ারের সিংহভাগই সুখস্মৃতিতে পূর্ণ। তাই পেলেকে ইতিহাসের একটা ঝুপড়ি বললেও খুব একটা ভুল বলা হয় না। কতশত স্মৃতি, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া মুহূর্ত। সে সব কিছুকে এক মলাটে বন্দী করা নিশ্চিতভাবেই দুরুহ এক ব্যাপার। কারণ পেলে আর তাঁর গোটা ফুটবল ক্যারিয়ারই একটা মহাকাব্য।

তবে পেলের এত শত মুহূর্ত, কীর্তি গাঁথা কিংবা স্মৃতির ভিড়ে তাঁর বিপক্ষে অন্যের বীরত্বের গল্পও কিন্তু আছে। এমনকি সেই মুহূর্তে পেলেও এক ধরনের বিস্ময়ে ডুবে গিয়েছিলেন। পেলেকে সেই বিস্ময়কর মুহূর্তের স্বাদ দিয়েছিলেন ইংলিশ গোলরক্ষক গর্ডন ব্যাংকস।

১৯৭০ বিশ্বকাপের কথা। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে সেবার মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড আর ব্রাজিল। ব্রাজিল ১৯৬২ এর চ্যাম্পিয়ন, আর ইংল্যান্ড ১৯৬৬ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন। অর্থাৎ আগের দুই বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নের মধ্যে লড়াই। দারুণ এক লড়াইয়ের পূর্বাভাস আগেই পাওয়া গিয়েছিল। মাঠে সেই চিত্র মিলল দ্রুতই। আক্রমণ প্রতি আক্রমণে সেলেসাও-ইংলিশদের লড়াইটা জমেছিল বেশ। তবে ম্যাচের এক মুহূর্তে চোখ আটকে যায় সবার।

ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার বল বাড়ান রাইট উইংয়ে থাকা জার্জিনহোর কাছে। জার্জিনহো সেই বাড়ানো বল থেকেই সলো এক রেস দেন। তবে বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন ইংলিশ ডিফেন্ডার টেরি কুপার। আর সে কারণেই তিনি ক্রসের মাধ্যমে বল উড়িয়ে দেন পেলের কাছে।

পেলে সেই বল পেয়ে দিলেন এক বুলেট হেড। এমন গতির হেড বল জালে না জড়ানোর কোনো কারণই নেই। তার উপর ইংলিশ গোলবার সামলানো গর্ডন ঝুঁকে ছিলেন ডান দিকে। যার কারণে এক অর্থে গোলপোস্টের বাম পাশ ফাঁকাই পড়েছিল। তাই পেলে সেই হেড দিয়ে এক প্রকার গোল ভেবেই উদযাপন শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

কিন্তু না। পেলের আগাম উদযাপনে ভাটা দিতে হঠাৎ যেন উড়ে এসে জুড়ে বসলেন গর্ডন ব্যাংকস। পেলের হেডের সময় ডান দিকে থাকলেও বল জালে ঢোকার আগেই গর্ডন দিলেন এক লম্বা ডাইভ। আর তাতে সেই বল হাতে লেগে চলে যায় গোলবারের উপরে। আকস্মিক এমন মুহূর্তে বেশ অবাকই হয়ে যান পেলে। কারণ এমন দুর্দান্ত সেভের দেখা সচরাচর মেলে না।

গর্ডন ব্যাংকসের ঐ সেভ কেমন দুর্দান্ত ছিল তা বুঝা যায় পাঁচ দশক আগের সেই ফুটেজ দেখলেই। এখনও বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা সেভ বলে বিবেচিত করা হয় গর্ডনের ঐ সেভটি। ২০১৯ সালে এই গোলরক্ষক মারা গেলে পেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই মুহূর্তের স্মৃতিচারণা করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত যতগুলো ফুটবল ম্যাচ দেখেছি তার মধ্যে ঐ সেভটি ছিল সেরা। ক্যারিয়ারে এক হাজারেরও বেশি ম্যাচ খেলেছি আমি। কিন্তু কখনোই এমন দুর্দান্ত সেভ আমার চোখে পড়েনি।’

সে পোস্টের মাধ্যমে পেলে আরো বলেছিলেন যে, ‘যখন আপনি ফুটবলে কিক করবেন, বুঝতে পারবেন এটা কিভাবে যাচ্ছে। আমি সেই বলটা অনেক জোরে হেড করেছিলাম। এমনকি বল প্রায় ফাঁকা পোস্টের দিকে চলে যাচ্ছে বলে সেলিব্রেশনও শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু গর্ডন ব্যাংকস কিভাবে যেন সে বলটা লাফিয়ে ঠেলে দিতে পেরেছিল। অবিশ্বাস্য, অসম্ভব রকমের সেভ ছিল সেটি। আমি এখনও সেই ফুটেজটা দেখি। যখনই দেখি তখনই মনে হয়, এটা অসম্ভব ছিল। আমি শুধু ভাবি, কতটা দ্রুত সে লাফিয়েছিল। ক্যারিয়ারে অনেক গোল করেছি। কিন্তু গর্ডনের সেই সেভের কথা আমাকে বেশিরভাগ মানুষই দেখা হলে জিজ্ঞেস করে। এটা এক কথায় দুর্দান্ত ছিল।’

পেলে গর্ডন ব্যাংকসকে এক বাক্যে গোলবারের জাদুকর বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। গর্ডন ব্যাংকসও কোনো সন্দেহ না রেখেই একবার তাঁর সময়ের সেরা ফুটবলার হিসেবে পেলের নামই উচ্চারণ করেছিলেন। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে পেলেকে ট্রিবিউট দেওয়ার জন্য লন্ডনে ফুটবল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গর্ডন ব্যাংকস। তবে শারীরিক অসুস্থতার জন্য সেদিন সেই অনুষ্ঠানে আসতে পেরেছিলেন না পেলে। পেলে সেদিন উপস্থিত না থাকলেও তাঁকে প্রশংসায় ভাসিয়েছিলেন গর্ডন ব্যাংকস।

সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘পেলের আমাদের সময়ে বিশেষ কিছু ছিল। আমি অনেক কিংবদন্তিদের বিপক্ষে খেলেছিল। তাদের মধ্যে পেলে ছিল সেরা। সে ঐ সময়েই দারুণ সব স্কিল দেখাতে পারতো। যা দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য হবে।’

পেলের সেই হেড ঠেকানোর মুহূর্ত নিয়েও সেদিন কথা বলেছিলেন গর্ডন ব্যাংকস। ১৯৭০ বিশ্বকাপের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মেক্সিকোতে আলাদা করে অনুশীলন করতাম। ডাইভ দিয়ে বল সেভের ড্রিলটা আমি বেশি করতাম। আর এ কারণে আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। তবে পেলের সেই হেডটা ছিল দুর্দান্ত। পেলে অনেক উপরে জাম্প করে হেড দিতে পারতো। সেটা আমার জানা ছিল। তবে ও যে এভাবে জোরে হেড দিবে এটা ভাবিনি। ভাগ্য ভাল যে, হেড করা বলটা মাটি বরাবর দিক দিয়ে গিয়েছিল। না হলে ওটা সেভ করা সম্ভব হতো না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি মূলত যে কাজটা করেছি তা হলো- হেডের সাথে সাথেই ডান দিকে বড় একটা লাফ দিয়েছিলাম। আর ডান হাতটা গোললাইন বরাবর রাখার চেষ্টা করেছিলাম। এতে করে বল গোললাইন পার হওয়ার আগেই আমার হাতে লেগে উপরে উঠে গোলবার ঘেঁষে চলে যায়। যদিও বল আমার হাতে লাগার পরও মনে হয়েছিল গোল হয়ে গেছে। কারণ তখন পর্যন্ত বল যে কোন দিকে গেছে তা আমি বুঝতে পারি নি। পরে দেখলাম গোল হয়নি, বল বাইরে চলে গেছে।’

অবশ্য সে ম্যাচে পেলের ঐ হেড ঠেকিয়ে দিলেও ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি গর্ডন ব্যাংকসের ইংল্যান্ড। যে জার্জিনহার ক্রসে পেলে হেড করেছিলেন সেই জার্জিনহোর গোলেই ম্যাচটি ১-০ গোলে জিতেছিল ব্রাজিল। আর গোলটিতে অ্যাসিস্ট করেছিলেন পেলে। তাই পেলের হেড ঠেকানোর বীরত্বের দিনেও বিজয়ীর বেশে মাঠ ছাড়া হয়নি গর্ডন ব্যাংকসের। তবে তাতে কী! পেলের হেড আর ব্যাংকসের সেভ- দুই বিশ্বকাপজয়ী কিংবদন্তী দারুণ এক মহারণের চিত্রায়ণ ঠিকই সেদিন হয়েছিল।

যদিও এ দুজনের কেউই এখন এ পৃথিবীতে নেই। ব্যাংকস ওপারে চলে গিয়েছেন ২০১৯ সালে, আর পেলের মহাপ্রয়াণ হয়েছে এই কিছুদিন আগে। তবে ৫২ বছর আগের সেই ফুটেজ দিয়েই যেন এ দুজনকে আবারো একটু খুঁজে নেওয়া। আবারো একটু নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রাণান্তর চেষ্টা। ফুটবল ইতিহাসের আর্কাইভ সমৃদ্ধ হয় তো এমন সব মুহূর্তের কারণেই। সর্বজয়ী পেলে কিংবা গর্ডন ব্যাংকসরা তো নশ্বর এ পৃথিবীতে আজীবন বেঁচে থাকেন এই সব ঐতিহাসিক মুহূর্তের স্রষ্টা রূপে।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link