ডিয়েগো ফোরলান, পারফেক্ট নাম্বার টেন

ফুটবলে সাপোর্টিভ ফরোয়ার্ড বলে একটা কথা প্রচলিত। জার্সি নম্বরের পরিভাষায় যাকে বলা হয় দ্য পারফেক্ট নাম্বার টেন। পজিশন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারই। যার কাজ কী? গোলের দরজা খোলা, পেছন থেকে উঠে এসে অ্যাটাক করা, প্রয়োজন মতো উইং ধরে অপারেট করা, ডান-বাঁ পায়ে ইনস্টেপ-আউটস্টেপ করা – এই তো!

খুব খাটা-খাটুনির পজিশন। যে কোনও প্লে মেকারই তাই হয়, খুব পরিশ্রম না করলে এই রোলটা সে ঠিকঠাক প্লে করতে পারে না। কিন্তু কেউ যদি শিল্পী হয়? কেউ যদি ওই রকম ডেড পজিশনেই ছবি আঁকতে পারে, কবিতা লিখতে পারে! ধরা যাক এমন একটা সময় উপস্থিত, যেখানে কলম-তুলি ছেড়ে যান্ত্রিক হতেই হবে।

ফুটবলের পরিভাষায় স্ট্র্যাটেজিক্যাল ফুটবল খেলতে হবে, টাফ ট্যাকল সহ্য করে অ্যাটাক করতে হবে। সে তছনছ হয়ে যাওয়া বাগানে যদি কোনও মালি এসে ফুল ফোটায়, তাকে শুধু দেখতে হয়। আর কিছু নয়, শুধুই দেখতে হয়।

এরকম এক ভদ্রলোক ছিলেন যার উরুগুয়ের মন্টেভিডিওতে জন্ম। যুব কেরিয়ার যখন শুরু, তখন থেকেই পায়ের টাচ অসাধারণ। যুব দলে খেলতে খেলতেই চোখে পড়েন ফুটবল ঈশ্বরের। মারাদোনা তাকে নিয়ে এলেন, তার নাম সুপারিশ করলেন আর্জেন্টিনার ক্লাব ইন্ডিপেন্ডিয়েন্ততে-তে। ব্যস, তুমুল পারফর্মেন্স!

একের পর এক চোখ ধাঁধানো গোল। ঐসব দেখেশুনেই তো স্যার আলেক্স ফার্গুসন নিয়ে এলেন সুদূর ম্যাঞ্চেস্টারে। লাল জার্সি গায়ে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে খেলতে হবে। সেখানেও তাই। দুটো সিজন ছিলেন, এমন কিছু আহামরি পারফর্মেন্স নয় তার। কিন্তু টাচটা যাবে কোথায়! যে ম্যান ইউ সমর্থকরা তাকে নাম দিয়েছিলেন ‘ফর লোন’, তাঁদেরই পরে আফসোস করতে হয়েছে এই শিল্পীকে হারানোর পরে।

লোকটার নাম ডিয়েগো ফোরলান। যার একটা কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টে পারফরমেন্স সুদূর প্রাচ্যের এক দেশের শহরে থাকা ছেলেটাকে রাতে ঘুম থেকে উঠে টিভিটা চালাতে বাধ্য করেছিল। যার একটা গোল দেখার জন্য ভোর সাড়ে তিনটেয় উঠেও জেগেছিল কলকাতার তৎকালীন যুবকরা, সদ্য কৈশোর থেকে যৌবনে পা দেওয়া একদল ফুটবল পাগলের দল।

লং রেঞ্জে ওই গোলার মতো শটে গোল, ডি বক্সেরও বাইরে থেকে হাফ ভলিতে গোল – কত বিনিদ্র রাত কেটেছে শুধু ফোরলানকে দেখার জন্য। কলকাতায় যখন প্রথম এল, যে ম্যাচটা খেলার কথা ছিল বৃষ্টির জন্য ফোরলান খেললেন না। ব্র্যাঙ্কো ছিলেন সে দলের কোচ। সব আশা মাটি হয়ে গিয়েছিল ঐ ছেলেটির। ফোরলানের কোনও টাচ চাক্ষুষ করা হয়নি বলেই।

দিয়েগো ফোরলান সত্যিই এক বিস্ময়ের নাম। লাতিন আমেরিকার টুর্নামেন্ট, যা এখানে প্রধানত মাঝরাতে, ভোররাতে শুরু হয় সেটাও দেখতে বাধ্য করেছিলেন তিনি, আজ থেকে দশ বছর আগে। ঘুম বাদ দিয়ে জেগে বসে থাকা শুধু ফোরলানকে দেখার জন্য।

তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১০ বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল জেতা। সে বিশ্বকাপে অনবদ্য অবদান রেখেছিলেন! ঘানার বিরুদ্ধে যে গোলটা, থার্ড প্লেসে জার্মানির এগেন্সটে যে গোলটা – এগুলো তো অ্যাসেট। আসলে ফোরলাষ ছিলেন সেই শিল্পী, যার জন্য ফুটবল দেখতে বসা। এমনি তো ফুটবল দেখা হয় মূলত ছক মেনে পাস বাড়িয়ে খেলা, পজিশনিং ফুটবল, স্ট্র্যাটেজিক্যাল ফুটবল হয়।

কিন্তু, আক্ষরিক ভাল লাগা বলতে যেটা বোঝায়, সেটা ফোরলান, কাকা, মেসিদের খেলা দেখতে বসলেই হয়। একটা অদ্ভুত অনুভূতি, যেন মাঠে একযোগে সব শিল্পী আঁকা প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ফোরলান সেই ফুটবলার, যে আমার কৈশোরের হিরো। ডিয়েগো ফোরলান আসলে এক শিল্পীসত্তার নাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link