কেন এই দীনতা!

বলা হয়-গেয়ো যোগী ভিক্ষা পায়না!

কথাটিকে অন্তত দেশী কোচদের বেলায় অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণ করতে যেন আটঘাট বেঁধে নেমেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। চলতি বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের কথাই ধরুন।

জাতীয় দল, বয়সভিত্তিক দল কিংবা হাইপারফরমেন্স দলের জন্য কোচিং স্টাফ নিয়োগে কাঁড়িকাঁড়ি টাকা খরচ করতে সিদ্ধহস্ত বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্রিকেট বোর্ড বিসিবি। বিসিবির আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ মেলে এই করোনাকালেও ক্রিকেটারদের মাঠের খেলায় সম্পৃক্ত রাখতে নিজস্ব অর্থায়নে প্রেসিডেন্টস কাপ ও বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণে; যা বর্তমান বাস্তবতায় প্রশংসনীয়ও বেশ।

দেশের পাঁচটি বৃহৎ কোম্পানির মালিকানায় পরিচালিত দলগুলোর খেলোয়াড়দের জন্য এ, বি, সি এবং ডি -চারটি ক্যাটাগরিতে মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিকও নির্ধারণ করে দিয়েছে বিসিবি। টুর্নামেন্টে চার ক্যাটাগরির ক্রিকেটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ ‘এ’ক্যাটাগরিতে ক্রিকেটাররা পাচ্ছেন ১৫ লাখ টাকা করে। সর্বনিম্ন ‘ডি’ ক্যাটাগরিতে পেয়েছেন ৪ লাখ টাকা।

চ্যাম্পিয়ন দল জেমকন খুলনা অনুশীলনে কোচ মিজানুর রহমান বাবুল।

করোনা পরিস্থিতির কারণে বঙ্গবন্ধু কাপে নেই কোন বিদেশি খেলোয়াড় কিংবা কোচিং স্টাফ। সঙ্গত কারণেই পাঁচটি দলের কোচিং স্টাফেই দেশী কোচদের নিয়োগ দিয়েছে বিসিবি। আর তাতেই উদার মানসিকতার অধিকারী বিসিবির উল্টো চেহারার দেখা মেলেছে টুর্নামেন্টে দেশের অভিজ্ঞ এই কোচদের পারিশ্রমিক প্রদানে। ‘ডি’ ক্যাটাগরির খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকেরও প্রায় অর্ধেক পাচ্ছেন দলগুলোর প্রধান কোচরা। সহকারী কোচরা পাচ্ছেন কেবল লাখ বা লাখ দেড়েক টাকা করে। ট্রেনারদের পারিশ্রমিক তো আরো কম।

স্থানীয় কোচদের পুরো টুর্নামেন্টের জন্য সর্বসাকুল্যে মাত্র লাখ খানেক টাকা পারিশ্রমিক দেয়া বিসিবিই বিদেশি কোচ নিয়োগে যেন বসে যায় টাকার বস্তা হাতে নিয়ে।

একশ দিনের চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া কিউই স্পিন কিংবদন্তি ড্যানিয়েল ভোট্টোরির পিছনেই বিসিবির একদিনের খরচ প্রায় লাখ তিনেকের কাছাকাছি, যা বঙ্গবন্ধু কাপের কোচদের পুরো টুর্নামেন্টের পারিশ্রমিক। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া লঙ্কান কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহেকে বিসিবি দিয়েছিল বছরে আড়াই কোটি টাকারও বেশি।

রানার আপ দল গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামের মোহাম্মদ সালাউদ্দিন।

অথচ এক হাতুরুর বেতনের কাছাকাছি তিন কোটির মতো অর্থ দিয়ে বিসিবি সামলায় ক্রিকেট বোর্ডের অধীনে কাজ করা ৯০ জন দেশি কোচের বাৎসরিক ব্যয়ভার। হাথুরু পরবর্তী যুগে ইংলিগ কোচ স্টিভ রোডসের পারিশ্রমিক বাবদ বিসিবির বাৎসরিক খরচ ছিল ২.২০ কোটি টাকা আর বর্তমান কোন রাসেল ডোমিঙ্গোর বেতনও নেহায়েত কম নয়।

প্রোটিয়া এ ভদ্রলোকের পারিশ্রমিক হিসেবে বিসিবির কোষাগার থেকে বছরে যে পরিমান টাকা খসে তার পরিমানও প্রায় পৌনে দুই কোটি ছুঁইছুঁই। বিসিবিতে কাজ করা বিদেশি কোচদের মধ্যে সবচেয়ে কম যার বেতন সেই অর্জুন জৈনের পাঁচদিনে যা উপার্জন বিসিবিতে সর্বোচ্চ বেতনে কাজ করা দুইজন দেশি কোচের সমন্বিত মাসিক বেতনও পনেরো হাজার কম।

এ তো গেলো বিদেশি এসব কোচদের শুধুমাত্র পারিশ্রমিক বাবদ নেয়া খরচের কথা। এর বাইরে বিসিবির তরফ থেকে তাদের জন্য রয়েছে গুলশান-বনানীতে ফ্ল্যাট বাসা কিংবা বিশ্বমানের হোটেল সুবিধা, সার্বক্ষণিক ড্রাইভারসহ গাড়ি, নিজের ও পরিবারের জন্য ভ্রমণভাতা, সাধারণ বোনাসের পাশাপাশি সফর, ম্যাচ এবং পারফরম্যান্স বোনাসও।

সম্মান, সম্মানি, গুরুত্ব- সব বিবেচনাতেই বিদেশি কোচদের তুলনায় উপেক্ষিত দেশি কোচদের ব্যাপারে বিসিবির আচরণ যেন ‘এক চোখে নুন আর অন্যচোখে তেল বেচা’র মতো। পরিসংখ্যান বলছে বিদেশি কোচদের পিছনে বিসিবি যা খরচ করে তার বিশ ভাগের একভাগও পান না এদেশের কোচেরা। অথচ এদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি অবদান অবহেলিত এইসব দেশি কোচদেরই।

সোহেল ইসলাম, ফরচুন বরিশালের কোচ।

বিদেশিদের কাছে না, সাকিব-তামিম-মুশফিকরা আজো কোথাও কৌশলগত কোন সমস্যায় পড়লে সবার আগে ছুটে আসেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম, সালাহউদ্দিনদের কাছে। সব জাতীয় ক্রিকেট তারকাই একবাক্যে গুরু মানেন ফাহিম-সালাহউদ্দিনদের।

দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থার বিদেশি কোচদের পিছনে কোটি কোটি টাকা খরচের হিসাব আর দেশিদের বেলায় নিদারুণ কিপেটপনা দেখে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে- দেশের ক্রিকেটে বিদেশি কোচদের তুলনায় কোন অংশেইতো অবদান কম নয় অবহেলিত এসব দেশি কোচদের, তবে দেশি কোচদের বেলায় কেন এমন বিমাতাসুলভ আচরণ বিসিবির? বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্রিকেট বোর্ডের তকমা গায়ে লাগিয়েও দেশি কোচদের প্রতি এখনো কেন উদার হতে পারেনি বিসিবি?

উত্তরটা জানা নেই দেশের সবচেয়ে মেধাবী, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ক্রিকেট কোচ, সাকিব-তামিম-মাশরাফিদের গুরু নাজমুল আবেদিন ফাহিমের। বিকেএসপির সাবেক এ কোচ, যিনি দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন বিসিবির গেম ডেপেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টে, যার হাত ধরেই গত এক যুগে সমৃদ্ধ হয়েছে ক্রিকেটারদের পাইপলাইন। বিসিবিতে কাজ করার সুবাদে দেশি কোচদের পদে পদে অবহেলার শিকার হওয়াটা খুব কাছ থেকেই দেখেছেন নাজমুল আবেদিন। একটি সংবাদ মাধ্যমে তিনি বেশ আগে বলেছিলেন, ‘বিদেশি কোচেরা অনেক পারিশ্রমিক পেলেও দেশি কোচদের উন্নয়নে বোর্ডের কোনো ভূমিকাই নেই।’

বেক্সিমকো ঢাকার কোচিং স্টাফ দল।

দেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি বোঝাপড়া ও বন্ধনটা মজবুত দেশি কোচদের সঙ্গে। জাতীয় দলকে কোচিং করানোর সবধরনের যোগ্যতা অনেক দেশি কোচদের থাকা সত্ত্বেও বিসিবি কখনোই দীর্ঘমেয়াদে আস্থা রাখতে পারেনি তাদের কারো উপরেই। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে দায়িত্ব নিয়ে সবচেয়ে বেশি বাজিমাতটা দেখিয়েছেন উপেক্ষিত এসব দেশী কোচরাই। ফ্রাঞ্চাইজিভিত্তিক টুর্নামেন্ট বিপিএলে দেশি কোচদের পাশাপাশি মাস্টারি করে গেছেন টম মুডি, ওয়াকার ইউনিস, মাহেলা জয়াবর্ধনে, ডেভ হোয়াটমোর, ডিন জোনস, ল্যান্স ক্লুজনার, মিকি আর্থার, হার্শেল গিবসের মতো বিখ্যাত সব কোচরা। কিন্তু সাফল্যের বিচারে সবশেষ চারটি বিপিএল আসরে একবার একমাত্র টম মুডি ছাড়া কেউই দলকে নিতে পারেননি ফাইনালে।

স্থানীয় কোচদের অবজ্ঞা আর অবহেলা নিয়ে ক্রিকেট পাড়ায় আলোচনাটাও নতুন নয়। সবশেষ গেল বছরে ১১ দফা দাবিতে ক্রিকেটারদের ধর্মঘটে দেশি কোচদের প্রাপ্য সম্মান ও সম্মানী দেয়ার দাবিটাও জানিয়েছিলেন তামিমরা। বিসিবি ক্রিকেটারদের সব দাবি মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্রিকেটারদের খেলায় ফেরালেও বিসিবিতে ভ্রাত্য দেশী এসব কোচেরা রয়ে গেছেন অবহেলিতই। সবশেষ বঙ্গবন্ধু কাপে দলগুলোর প্রধান কোচদের ডি ক্যাটাগরিতে থাকা একজন ক্রিকেটারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক পারিশ্রমিক নির্ধারণ করাটাই যার বড় প্রমাণ। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে বিদেশীদের পিছনে টাকার বস্তা নিয়ে ছোঁটা বিসিবি দেশি কোচদের বানিয়ে ফেলেছে সহজলভ্য।

বিসিবির এসব কর্মকাণ্ডে হতাশ দেশের ক্রিকেটের সফলতম কোচ মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। চলতি বঙ্গবন্ধু কাপের ফাইনালিস্ট এই কোচের ভাষ্যে, দেশি কোচদের মূল্যায়নের নামে বিসিবির এই দীনতা ‘লজ্জাজনক’।

মিনিস্টার গ্রুপ রাজশাহীর কোচ সারোয়ার ইমরান

সালাহউদ্দিন হয়তো খুব বেশি ভুলও বলেননি। ক্রিকেটারদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক যে মানুষগুলোর, যাদের ছোঁয়ায় সাকিব-তামিমরা হয়ে উঠেছেন আজকের মহাতারকা সেই মানুষগুলোকে মূল্যায়ন করতে না পারাটা সত্যিকারার্থেই দেশের ক্রিকেটের জন্য লজ্জাজনক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link