পূজারা খেলছে!

একশো পঞ্চাশ কোটি। মতান্তরে একটু কম হলেও হতে পারে। জাস্টিন ল্যাঙ্গারই মনে করিয়ে দিলেন সংখ্যাটা। একই জলহাওয়ায় নি:শ্বাস নিচ্ছে এই সংখ্যক মানুষ। পৃথিবীর সেই ভরকেন্দ্র ঝুঁকে আছে একটা স্ক্রিণের দিকে, মোবাইল ফোন, ট্যাব কিংবা তেলচিটে ধরে যাওয়া অনিডা টিভি। ভারত জিতে গেছে অনেকদিন হল।

সে একবার না বারবার জিতেছে। বিশ্বকাপ জিতেছে, ইডেনে জিতেছে, জিতল গাব্বায়। এই যে সমস্ত জয় এ আসলে এক একটা উত্থান। কিন্তু তেমন কোনো মানুষকে দেখিনি যারা এভাবে জিতে যান। সম্বিত বসু লিখেছিলেন – ‘জয় নয়। আসলে জয়ের ভগ্নাংশ।’

সত্যিই তো। এমন একটা রূপকথাকে আমরা ১৫০ কোটি টুকরো করে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছি। সেই যে সবেধন নীলমণি জয়ের টুকরো তা আমরা গুছিয়ে রেখেছি। সে আসলে সাজানো শো পিস, তাকে রোজ দেখে, উলটে পালটে ধুলোঝেড়ে রেখে দিই আমরা৷ সে সুন্দর। বিরাট কোহলির কভার ড্রাইভের মতো, শচীন টেন্ডুলকারের স্ট্রেট ড্রাইভের মতো, অনিল কুম্বলের গুগলির মতো।

পূজারার মতো কেউ না। একথা সত্যি, পূজারাকে নিয়ে এতদিনে একটা ভয়ানক হইচই পড়ে গেছে। বিশেষত শরীরে নীল দাগের পর এই দীর্ঘদেহী লোকটাই যেন ‘ব্লিড ব্লু’-এর আদর্শ পোস্টার বয়। কিন্তু সে জিতে গিয়েও জেতে নি। জিতে গিয়েও প্রমাণ করল আসলে জিতে যাওয়া বলে কিছু হয় না, ছোটো ছোটো জয়ের টুকরো আসলে রোজের ডায়রি, রোজকার মাসকাবারির খাতা।

সেখানে উপন্যাস নেই। সাদাকালো হিসেব আছে, কুড়িটাকা কম পড়ার হিসেব, বাকি রাখা দেড়শ টাকার হিসাব। সিডনির বিখ্যাত সংবাদসংস্থা একটা আর্টিকেল প্রকাশ করেছিল এই সিরিজের পর, গতকাল। সেখানে বলা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার এই বডিলাইন বোলিং ভারতকে জিতিয়ে দিল। আসলে কথাটা অনেক আগেই তুলেছিলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা, কমেন্ট্রি বক্স থেকে।

শরীর লক্ষ্য করে বল আসলে ব্যাটসম্যানের প্রতি আক্রোশকে প্রতিপন্ন করে, সে পাড়ার দাদার মতো চমকায়, ধমকায়, কিন্তু আউট করে দিতে পারে না। লাইন আর লেংথে বল বাবার মতো, আস্ফালন কম কিন্তু আসলে উইকেট তোলে। ব্যটসম্যানের ধৈর্যের পরীক্ষা এই বলে, লাইন আর লেংথের নিখুঁত প্রয়োগ ব্যাটসম্যানের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটালে সে ফোর্থ স্টাম্প থেকে সামান্য বাঁকে ছুঁইয়ে দেয় ব্যাট।

ম্যাকগ্রা জানেন, দ্রাবিড়ের সামনে যিনি লড়েছেন তিনি জানেন৷ কিন্তু কেন অস্ট্রেলিয়া এই শরীরে বলকে আঁকড়ে ধরল? অজি মানসিকতা তো এত ভীতু ছিল না কোনোদিন। আসলে কামিন্স-হ্যাজলউডের এই বডিলাইনের পিছনে কিছুটা অদৃশ্য পূজারা লেগেছিলেন কোকাবুরা বলটায়। গাব্বার ধুলোর মতো।  এই যে ধৈর্যের লড়াই, এখানেই বাজিমাত করেছেন পূজারা।

গত সিরিজে পূজারা ব্যাট করেছিলেন ১২০০ মিনিট, প্রায় কুড়ি ঘন্টা। এই সিরিজও একই প্রায়। একজন বোলারকে বাধ্য করা ব্যাকফুটে ঠেলে দিতে, তাঁকে বাধ্য করা উইকেট টেকিং লাইন ছেড়ে শরীরে আসতে। ম্যাচ টেনে আনা নিজের দিকে, নিঃশব্দে। শ্লথ পূজারা, একঘেয়ে পূজারা, অসহনীয় পূজারা, ক্লান্ত পূজারা – কিন্তু এই সবের যোগফল সাধক পূজারা।

যিনি আদতে সেই টেক্সটবই, ক্রিকেটের, জীবনের। পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরে যাকে মাঝে মাঝে উলটে পালটে দেখতে হয়, যেখানে লেখা আছে নিখুঁত উত্তর। আমরা জীবনের সাথে তাকে মেলাই। ভুল করলে আবার বসে পড়ি তার সামনে, শিখি, প্রতিদিন। এখানে কোনো রোমাঞ্চ নেই, গল্পের বই-এর মতো পাতায় পাতায়  বিষণ্ণতা কিংবা উচ্ছ্বাস কিছুই নেই।

তবু পূজারা আছেন, কতদিন আছেন জানা নেই। সাদাজার্সির কুরুক্ষেত্রে ভারতের পতাকা মাথায় নিয়ে তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামার লোক কমে আসছে, আমরা বড় হলেও ছেলেবেলার অঙ্কবই যত্ন করে রেখে দিই,  সে একঘেয়েমির দাগ নিয়ে থাকে, ঘরের এক কোণে থাকে, দ্রাবিড়ের ছবি থাকে মানিব্যাগে, পোস্টারে থাকেন সচিন-কোহলি, তাঁরা মহাতারকা, অনতিদূরে গিল-পন্থরা থাকবেন। কিন্তু পূজারা লেগে থাকবেন প্রতিটা কাঁকড়ে, পঞ্চম দিনের ফাটল ধরা পিচ থেকে উড়ে আসা ধুলোয়, স্কোরবোর্ডে পূজারার রান দেখার সময় মনে পড়বে কার্দাস সাহেবের কথাটাক্স স্কোরবোর্ড আসলে গাধা,  পূজারা থাকবেন ঘড়ির কাঁটায়, একঘন্টা, দু ঘন্টা, তিন ঘণ্টা…।

পূজারা খেলছে, ভারত জিতবে কিনা জানা নেই, কিন্তু হেরেও যাবে না। পূজারা খেলছে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link