ইতিহাসের প্রথম বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটার কে বলতে পারেন?
ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে না বললে হয়তো সৌরভ গাঙ্গুলির নামই উঠে আসবে। কারণ এই শতাব্দীর আগে টেস্ট খেলা ঐ একজন বাঙালি ক্রিকেটারকেই মানুষ সাধারণত চিনে থাকবে। কিন্তু না, প্রথম বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটার তিনি নন, তাঁর আগেও আছেন বেশ ক’জন। প্রথম বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটারের নাম প্রবীর সেন। জন্মেছিলেন কুমিল্লার ভূখন্ডে। কিন্তু এখনকার কুমিল্লা তো তখনকার অবিভক্ত ভারত বর্ষের কুমিল্লা ছিল। তাই কাগজে কলমে তিনি ছিলেন একজন ভারতীয়।
১৯২৬ সালের ৩১ মে কুমিল্লার এক প্রথিতযশা ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মেছিলেন প্রবীর সেন। বাবা অমীয় সেন আর মা বাসন্তী সেনের ছেলে প্রবীর সেনকে অনেকে ‘খোকন’ ডাকনামেও ডাকত। তবে বালক বয়সেই পরিবারের সাথে খোকন চলে আসেন কলকাতায়।
তো হঠাৎ করেই প্রবীর সেনকে স্মরণ করার কারণ হলো, তাঁর জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে দুটি ঐতিহাসিক নাম। একজন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, আরেকজন রানি এলিজাবেথ।
সাল ১৯৫২। রাণী এলিজাবেথ তখন সবেমাত্র ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেছেন ৷ তো সে বছরই লর্ডসে হওয়া ইংল্যান্ড আর ভারত মধ্যকার একটি টেস্ট ম্যাচে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হলেন তিনি। ম্যাচ শুরুর আগে দু’দলের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎয়ের সাথে খেলোয়াড়দের সাথে করমর্দনও করেন তিনি।
ভারতের সেই দলে ছিলেন প্রবীর সেন। প্রবীর সেনের সাথেও হ্যান্ডশেক করেছিলেন রাণী। হাস্যোজ্বল মুখে দু’জনের করমর্দনের সেই মুহূর্ত উঠে গেল ক্যামেরায়। আর সাদাকালো ফ্রেমে তোলা সেই ছবিই হয়ে গেল ইতিহাস। প্রথম কোনো বাঙালির সাথে ফ্রেমবন্দী হলেন দ্বিতীয় রানি এলিজাবেথ।
এবার এ ঘটনার ৪ বছর আগে ফিরে যাওয়া যাক। সাল ১৯৪৮। সেবার দলের সাথে প্রবীর অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিলেন খুব ক্ষীণ আশা নিয়ে। কারণ দলে রয়েছেন জেনি ইরানির মতো উইকেটরক্ষক। বড় জোর কয়েকটা প্রস্তুতি ম্যাচে তিনি সুযোগ পেতে পারেন। একাদশে খেলার আশা নেই বললেই চলে। কিন্তু গ্যাবায় প্রথম ম্যাচে ভারতের শোচনীয় পরাজয় এবং সিডনিতে দ্বিতীয় ম্যাচ ড্র করার পর, মেলবোর্নে হওয়া তৃতীয় টেস্টে ইরানির বদলে স্কোয়াডে নিয়ে আসা হলো প্রবীরকে।
অবশ্য এর একটা কারণও ছিল। জাতীয় দলে অভিষেকের আগেই হইচই ফেলে দিয়েছিলেন প্রবীর। অ্যাডিলেড ওভালে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ট্যুর ম্যাচে তিনি ভিনু মানকাড়ের বোলিংয়ে স্টাম্পিং করেছিলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে। আর তাতেই তাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় গণমাধ্যমে।
পরবর্তীতে প্রবীর নিজেও দাবি করেছিলেন, এটিই ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অর্জন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উত্তেজনার মুহূর্তটি এসেছিল যখন আমি অ্যাডিলেডে ব্র্যাডম্যানকে স্টাম্পড করেছিলাম। কারণ তিনি যে আমার দেখা সর্বকালের সেরা।’
তবে মূল টেস্টে গিয়ে যেন ব্যাটিং টাই বুঝে উঠতে পারেননি কবির। ব্যাট হাতে পুরো সফরটাই যেন প্রবীরের জন্য দু:স্বপ্নের মতো কেটেছিল। ছয় ইনিংসে ৫.৬০ গড়ে ৩৩ রান করেছিলেন তিনি। তবে প্রবীর প্রশংসা আদায় করেছিলেন উইকেট কিপিং দিয়ে। প্রবীরের উইকেটকিপিংয়ে বার্ট ওল্ডফিল্ড এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তাকে নিজের একজোড়া গ্লাভস পর্যন্ত উপহার দিয়েছিলেন ৷
উইকেট কিপিংটা তিনি যে ভাল পারতেন সেটা অবশ্য পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। ১৪ টেস্টে ১৮ ইনিংসেই করেছেন ৩১ টি ডিসমিসাল। ২০ টি ক্যাচ আর ১১ টি স্ট্যাম্পিং। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে স্ট্যাম্পিং করেছেন ৩৬ টা। সেই ৩৬ টা স্ট্যাম্পড আউটের মধ্যে আবার স্বয়ং ব্র্যাডম্যান রয়েছেন।
রাণী এলিজাবেথ আর প্রবীর সেন একই বছরে জন্মেছিলেন। রাণী মাস খানেক মতো বয়সে বড় ছিলেন। কিন্তু দু’জনের মৃত্যু হল ভিন্ন দুই শতাব্দীতে। ১৯৭০ সালে মাত্র ৪৩ বছরেই মারা গিয়েছিলেন প্রবীর সেন। আর রানি এলিজাবেথের মহাপ্রয়াণ হল ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বরে।
প্রবীর সেন আর এলিজাবেথের মধ্যে বলার মতো কোনো সম্পর্ক নেই। রানি এমন হ্যান্ডশেক বহু ক্রিকেটার, বহু ফুটবলারের সাথেই করেছেন। তাঁর স্মৃতির দিনলিপিতে নিশ্চয়ই সবগুলো জায়গা পাবে না। প্রবীর সেনেরটাও পাবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। তারপরও ঐ একটি ছবিই তো ব্রিটিশ মহারানিকে একজন বাঙালি ক্রিকেটারের সাথে যুক্ত করেছিল। তাই সে ছবিটি একটি ইতিহাস। আর সেটি ইতিহাস হয়েই থাকুক।