১৯৮০ থেকে ১৯৯৫। একেবারে করগুনে ১৫ বছর। এই সময়টাতে ভিভ রিচার্ডস থেকে ক্লাইভ লয়েড, ম্যালকম মার্শাল থেকে কোর্টলি আম্ব্রোস হয়ে রিচি রিচার্ডসন কিংবা ব্রায়ান লারা – ক্যারিবিয়ান সাম্রাজ্যে একে একে আসছেন,ইতিহাস লিখছেন, ১..২… থেকে সংখ্যাটা ১৬!
রান নয়, উইকেট নয়, লাগাতার টেস্ট সিরিজে অপরাজিত থাকার সংখ্যা এটি। ১৫ বছরে ১৬ টি টেস্ট সিরিজ খেলে ১১ টি জয় ও ৫ টি ড্র- লয়েড জমানার ব্যাটনের হাতবদল হয়ে রিচি-লারার কাঁধে এলেও ১৯৯৫ সালে দাঁড়িয়ে সারাবিশ্ব একবাক্যে মেনে নিচ্ছেন ব্র্যাডম্যানের ঐ ঐতিহাসিক তিরিশ-চল্লিশ দশকের দলের সাথে সর্বকালের সেরা টেস্ট দলের মুকুটের অংশীদার এসে গেছে, ব্র্যাডম্যানের একমাত্র হার ছিল ১৯৩২-এর বডিলাইন, বাকি ১৫ সিরিজের ১৩ টিতে জয়, একটি ড্র!
নীল গোলকের শরীর তখন মাঝবরাবর চিরে গিয়ে জন্ম নিয়েছে দুই মহাদেশ। ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়া আর লয়েড-ভিভ-রিচির ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
১৯৯৫ সালে ছকেবাঁধা অঙ্কের ক্লাসে হঠাৎ-ই ঢুকে পড়লেন এক আনমনা কবি, যেন জটিল ক্যালকুলাস সহজেই কবিতা করে উড়িয়ে দিলেন, মার্ক আর স্টিভের হাত ধরে প্রথম ইতিহাসের পাতাটা ওল্টালো, যেন ভয়ংকর শক্তির ট্রান্সফরমেশন হল ক্রিকেটের গালিচায়- অস্ট্রেলিয়া হারিয়ে দিল সিরিজ, ১৫ বছর পর- কিংস্টোনের মাঠে নিঃশব্দ বিপ্লব। অথচ স্টিভ জানতেন,পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম টেস্ট দলের চওড়া ব্যাটন বওয়ার কাঁধ তার দলের তৈরী হয়ে গেছে।
ম্যাকগ্রা-পল রাইফেল-ওয়ার্ন-স্টিভ-মার্ক থেকে একটু একটু করে শুরু হল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটীয় ইতিহাসের আরেকটা মাইলস্টোন খোদাই-এর কাজ- যার খাতায় কলমে পরিসংখ্যান বলল- লাগাতার ১৬ টেস্ট জয়- অপরাজিত নয়- বিজয়ী!
ইনিংস হার বাঁচাতে বাকি প্রায় দেড়শোর ওপর রান। সবে কলির সন্ধ্যে, তৃতীয় দিন! সৌরভ আউট! শচীন আউট!
ক্রিজে হুংকার দিচ্ছেন শেন ওয়ার্ন, নাকের ওপর সাদা সানপাওডার, নিজের শিকারের লোভে হাতের সিমটা নিয়ে ছেলেখেলা করছেন গ্লেন ম্যাকগ্রা, পন্টিং ফিরছেন চেনা হিংস্রতায়, স্টিভ হাত নেড়ে শেষ হয়ে যাওয়া উপন্যাসে শেষ আঁচড় দিচ্ছেন- আর ক্রিজে দাঁড়িয়ে থমথমে মুখের রাহুল দ্রাবিড়, আর থম মেরে যাওয়া ভিভিএস লক্ষ্মণ।
ইডেন গার্ডেন্স জানে সময়ের একটা নিজস্ব মৌনতা আছে, সে হাজার ললাট লিখন উল্টে দিতে পারে স্তব্ধতার ওজনে।
একটা বল। একটা প্রাণ পাওয়া- লড়াই শুরু। পরের একটা বলে বাড়তি অক্সিজেন। এই লড়াই চলল কতক্ষণ? ৭৫৩ টা ডেলিভারি, ৩৭৬ রান!
চতুর্থ দিনের শেষে নিজের চুইং গামটা এত বিরক্তিভরে ছুঁড়েছিলেন শেন ওয়ার্ন সামনের টিভি রিপোর্টার আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সাহস পাননি। স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে ৯০ ওভার, তিনটে সেশন বল করেও একটি উইকেটও কপালে জোটেনি, কাদের?
না ম্যাকগ্রা, ওয়ার্ন, গিলেসপি এবং ক্যাসপ্রোউইচ যাদের শেষ ১৫ টি টেস্টে ক্রিজে মাটি ধরেছেন বিশ্বের সমস্ত ব্যাটসম্যান।
হরভজনের কাঁধে সৌরভ হাত রাখার আগেই বুঝেছিলেন যে আগুন নিয়ে খেলা শুরু হয়ে গেছে কল্লোলিনীর বুকে তাঁকে শেষ করবে এই ছেলেটাই,চতুর্থ দিনে ভাঙা পিচে ধুলো উড়ল ক্রিকেটের। সে ক্রিকেট যেন এক ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি জুড়ছিল- ক্যারিবিয়ান সাম্রাজ্য ভেঙেছিলেন স্টিভ আর স্টিভের সাজানো উদ্যানে ক্লাসের লাস্টবয়ের দাদাগিরি নিয়ে এলেন বেহালার তরুন, একটা করে উইকেট, একটা করে পিলার খসল অজি সোনালি দৌড়ের ইমারতের!
অথচ ভারত তখন কার্গিল থেকে ভাঙছে, ভাঙছে গড়াপেটার দায় ঝেরে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে, ঠিক যেমন থমথমে দুই মুখ দাঁড়িয়েছিল ক্রিজে, যেখান থেকে ক্রিকেট ঈশ্বর তাঁদের কবজিতে বেঁধেছিলেন কবচকুণ্ডল!
কেউ বলেন ‘ঈশ্বরের টেস্ট ম্যাচ’, কেউ বলেন ‘ক্রিকেটের ইতিহাসের সেরা টেস্ট’, অথচ ইডেন জানে এ লড়াই ছিল নিজেকে পোড়াতে পোড়াতে ফিনিক্স হয়ে ওঠার, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া একটা জাতির ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই, দুই দক্ষিণী নায়ক, পাঞ্জাবি সেনসেশন, বাঙালি ক্যাপ্টেন, মারাঠি দেবতা মিলে মিশে এঁকে দেওয়া ভারতের আসল মানচিত্র।
এ টেস্ট ভারতের শেষ সীমান্ত, যেখান থেকে জন্ম হল এক নতুন ভারতের, কেউ জানেনা কোন মন্ত্রবলে সেদিন এই লড়াই করেছিলেন দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ, কোন শক্তিতে চোখে চোখ রাখলেন সৌরভ তার কঠিনতম প্রতিপক্ষের, কীভাবে এক তরুন শিখ গুঁড়িয়ে দিলেন ঐ ব্যাটিং লাইন আপ, এর কোনো ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা নেই- আছে শুধু ধূসর পাণ্ডুলিপি- যার পাতায় পাতায় বৃষ্টি নামে ২০ বছর পরেও।