আরে, এই টারে চারশো বানায়া দাও!
– ডব্লিউ জি গ্রেস, জুলাই ১২, ১৮৭৬।
আপাতদৃষ্টিতে হালকা এই উদ্ধৃতির পেছনের গল্প শুরু করার আগে আমরা আগে গ্রেট গ্রেস সাহেবের মাহাত্ম্য ও ক্রিকেটের উপর তাঁর প্রভাব নিয়ে কিছুটা আলোচনা করব। বিশেষ করে ১৮৭০ এর দশকে তিনি ছিলেন ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী চরিত্র। গ্রেস শুধু সেই আমলের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানই ছিলেন না, তিনি ছিলেন অন্যদের চেয়ে যোজন ব্যবধানে এগিয়ে। গ্রেসের প্রাধান্য বজায় ছিল তাঁর মৃত্যুর পরও, ডন ব্র্যাডম্যান ‘ব্র্যাডম্যান’ হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত।
গ্রেসের অভাবনীয় সাফল্যের একাধিক কারণ ছিল। প্রথম কারণটি হচ্ছে ফুট-ওয়ার্ক- তিনিই প্রথম ক্রিকেটার যিনি দারুণ দক্ষতার সাথে ফ্রন্ট-ফুট এবং ব্যাক-ফুটে ব্যাট করতে পারতেন। এর আগ পর্যন্ত কোন স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান এরকম সাফল্য দেখাতে পারেন নি। দ্বিতীয়ত, তিনি ছিলেন শারীরিকভাবে দারুণ ফিট। (আমরা তাঁর বিশাল বপুর যে ছবি দেখতে পাই সেটা ক্যারিয়ারের শেষের দিকের, তরুণ বয়সে গ্রেসের যথেষ্ট অ্যাথলেটিক ফিগার ছিল)। গ্রেসের মত রান-ক্ষুধা সে আমলের আর কারও মাঝেই ছিল না। পরবর্তীতে যা আবার দেখা গেছে… জি, অনুমান সঠিক হয়েছে, ঐ ব্র্যাডম্যানের মাঝে! তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি ছিল খেলার প্রতি তাঁর নিখাদ ভালবাসা। আকাশপথে যাত্রা শুরু হবার আগ পর্যন্ত তাঁর মত কোন ক্রিকেটারই এতটা পথ পাড়ি দেয় নি। সুযোগ থাকলে কোন ম্যাচ খেলা থেকেই বিরত থাকতেন না।
১৮৬৮ সাল থেকে ১৮৭৭ পর্যন্ত তিনি ফর্মের তুঙ্গে ছিলেন। শুধু ১৮৭৫ সালে তেমন ম্যাচ খেলতে পারেন নি, সেইন্ট বার্থহলোমিউ হাসপাতালে কর্তব্যরত ডাক্তার হিসেবে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। অবশ্য, সেটা (আগে-পরে) পুষিয়ে নিয়েছেন ১৮৭১ এবং ১৮৭৬ সালে। এই দুই বছরই তিনি এত রান করেছিলেন যে তাঁর পরের ব্যাটসম্যানের রানের সংখ্যা ছিল অর্ধেকেরও কম! বিশেষ করে ১৮৭১ সালে দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন, ১০টি শতক হাঁকিয়েছিলেন। বাকিরা কেউ একটির বেশি করতে পারেনি!
পরিসংখ্যান উল্লেখ করলে বোধহয় আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে। ১৮৭৬ সালের কথাই ধরা যাক-পুরো মৌসুমে ৬২ গড়ে তাঁর ফার্স্ট ক্লাস রানের সংখ্যা ছিল ২৬২২। পরবর্তী রান সংগ্রাহক ছিলেন ইফ্রেইম লকউড। ৩২ গড়ে তাঁর রান ছিল মাত্র ১২৬১! সকল প্রকার ক্রিকেটে ঐ বছর গ্রেসের সংগ্রহ ছিল ৩৬৬৯ রান (গড় ৫৯)! পাশাপাশি বল হাতে দখল করেছিলে ২১১ টি উইকেট। উইকেট প্রতি রান দিয়েছিলেন ১৭ (এর মধ্যে ফার্স্ট ক্লাস উইকেট ছিল ১৯ গড়ে ১৩০ টি)। শুধু তাই নয়, ৭৭ টি ক্যাচও নিয়েছিলেন! পুরো বছরের কথা না হয় বাদই দিলাম, শুধু আগস্ট মাসেই তিনি ৮ দিনের ব্যবধানে দু’টি ফার্স্ট ক্লাস ত্রি-শতকসহ ৮৮৯ রান করেছিলেন!
উপরের সংখ্যাগুলো আজ দেড়শ বছরেরও অধিক সময় পরে এসেও অভাবনীয় মনে হবে। সুতরাং, সেই আমলের ক্রিকেটার, দর্শক এবং খেলার সাথে সংশ্লিষ্টদের কাছে সেটা কেমন ছিল তা সহজেই অনুমেয়!
গ্রেস ছিলেন ক্রিকেটের চেয়েও বড়। নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। পুরো ইংল্যান্ড-জুড়ে মহামান্য রাণীর পর সম্ভবত তিনিই ছিলেন সবচেয়ে পরিচিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। অবশ্য, এ ব্যাপারে ক্রিকেটের পাশাপাশি তাঁর বিশাল বপু এবং মুখ-ভর্তি দাঁড়িরও অবদান ছিল!
নিজের জনপ্রিয়তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার তিনি করেছিলেন। অ্যামেচার হওয়া সত্ত্বেও ১৮৭৯ সাল পর্যন্ত (ডাক্তারি প্র্যাকটিস শুরু করার পর আর দরকার পড়ে নি) ক্রিকেটই ছিল তাঁর আয়ের মূল উৎস। তিনি ‘ইউনাইটেড সাউথ ইংল্যান্ড ইলেভেন’ দলের হয়ে ফার্স্ট ক্লাস খেলতেন। প্রতি খেলা থেকে যে আয় হয় তার ৫ পাউন্ড দলের পেশাদারদের দিয়ে বাকি টাকা নিজে নিতেন। উল্লেখ্য, যেসব ম্যাচে তিনি খেলতেন সেগুলোয় আয়ও হত বেশি। কেননা, ম্যাচের আয়োজক টিকিটের দাম বাড়িয়ে দিত!
নিজের হানিমুনও তিনি স্পন্সরের টাকায় করেছিলেন! ১৮৭৩-৭৪ মৌসুমে ক্রিকেট খেলার জন্য একটি দল নিয়ে অস্ট্রেলিয়া সফরে যাবার সময় সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকেও নিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৮৯১-৯২ মৌসুমের এশেজ সফরেও স্ত্রী ও দুই সন্তান তাঁর সফরসঙ্গী ছিল। সেই আমলে যা ছিল একেবারেই অকল্পনীয়!
খেলার মাঠে তিনি যা বলতেন সেটাই আইন ছিল। গ্রেসের ‘স্বৈরশাসক’ মূলক আচরণের কারণে অনেক কেচ্ছা-কাহিনীও চালু হয়ে যায়। এগুলোর মধ্যে ‘দর্শক আমার ব্যাটিং দেখতে এসেছে, তোমার আম্পায়ারিং নয়’ তো খুবই বিখ্যাত। অবশ্য, তাঁর চরিত্র এবং ব্যক্তিত্বের কথা চিন্তা করলে ঘটনাটি খুব বেশি অতিরঞ্জিত মনে হয় না!
একবার তো তিনি স্কোর-বোর্ডই বদলে দিয়েছিলেন!
গ্রিমসবি’তে অনুষ্ঠিত হওয়া সেই ম্যাচটি বেশ অদ্ভুত ছিল। ঠিক হয়েছিল গ্রিমসবি দলে ২২ জন খেলোয়াড় ব্যাটিং এবং ফিল্ডিং করবে! এমনিতেই ২২ ফিল্ডার, তার উপর আউটফিল্ডের অবস্থা ছিল খারাপ, ফলে চার মারা প্রায় অসম্ভব ছিল। এ ব্যাপারে অ্যান্থনি মেরেডিথ তাঁর বই ‘WG Grace: In the Steps of a Legend’ এ লিখেছিলেন ‘পিচ এবং আশপাশের কিছু জায়গার ঘাস কাটা হয়েছিল। মাঠের বাকি সবখানেই বড় ঘাস ছিল। ফলে, বল কোথাও পড়ার সাথে সাথেই জায়গায় থেমে যাচ্ছিল!’
গ্রেস ম্যাচের একেবারেই শুরুতে নিশ্চিত আউট হবার হাত থেকে বেঁচে যান। (সাইমন রে ‘WG Grace: A Life’ বইতে লিখেছেন গ্রেস একেবারে ‘প্লাম্ব ইনি ফ্রন্ট’, মানে নিশ্চিত আউট ছিলেন!) কিন্তু আম্পায়ার উইলিয়াম মর্টলক আউট দেন নি। প্রথম দিনে তিনি রান করেন ১৩০, দ্বিতীয় দিনে সেটার সাথে যোগ করেন আরও ১৮৪ রান। এরপরও ডিক্লেয়ার দেন নি, এমনকি শেষ অর্থাৎ তৃতীয় দিনেও নয়। এর কারণও অবশ্য ছিল।
দ্বিতীয় দিনের লাঞ্চ বিরতির ঠিক আগে তিনি একটি টেলিগ্রাম পান। মাঠে থাকার কারণে সেটা পড়ে শোনান তাঁর ছোট ভাই ফ্রেড (তিনিও খেলোয়াড় ছিলেন, ঐ ম্যাচেই ৬০ রান করেছিলেন)। টেলিগ্রামে বলা ছিল গ্রেস দ্বিতীয়বারের মত বাবা হয়েছেন!
খবরটি শুনেই গ্রেস খেলা বন্ধ করলেন। বিপক্ষ দল, আম্পায়ার বা আয়োজকদের সাহসও ছিল এ ব্যাপারে দ্বিমত করার। শ্যাম্পেনের বোতল খুলে উপস্থিত সবার সাথে সন্তানের জন্ম উদযাপন করলেন। একই সাথে ঘোষণা দিলেন এই খুশিতে ‘নতুন রেকর্ড গড়তে চান!’ সম্ভবত তিনি ৪০৪ রানের কথা মাথায় রেখে এটা বলেছিলেন। কেননা, তখন পর্যন্ত যে কোন ক্রিকেটে এটিই ছিল ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ১৮৪৮ সালে এডমন্ড টাইলকট রেকর্ডটি করেছিলেন।
এই কথা শুনে আয়োজকদের মাথায় হাত। কেননা, তাদের আশঙ্কা ছিল ম্যাচের পুরো সময় গ্রেস ব্যাট করলে স্থানীয় দর্শক আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে! আয়োজকদের ক্ষতি হয়ে যাবে। হয়েছিলও তাই। তৃতীয় দিনে মাঠে একেবারেই স্বল্পসংখ্যক দর্শক এসেছিলেন।
গ্রেসকে কোনভাবেই আউট করা যাবে না দেখে গ্রিমসবি বোলারগণ তার পার্টনারদের টার্গেট করা শুরু করে। শেষ পর্যন্ত একে একে সবাই আউট হয়ে যায়। ইউনাইটেড সাউথ ইংল্যান্ড ইলেভেন দলের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৬৮০ এবং গ্রেসের ব্যক্তিগত রান ৩৯৯*! ৪০৪ এর রেকর্ড তো ভাঙা হলই না, ৪০০ পর্যন্ত করা হল না!
হতাশ গ্রেস স্কোরারদের ডেকে বললেন, ‘Oh, make it four hundred!’ তারা খুশি-মনেই এটা করলেন। এমনকি বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় স্যাম হ্যাডেলসি পর্যন্ত বললেন, ‘Well, you deserve it!’
ক্রিকেটের পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করার জন্য খ্যাত ক্রিকেট-আর্কাইভ এর স্কোর-কার্ডে ফুটনোট হিসেবে লেখা আছে – ‘ইউনাইটেড সাউথ অব ইংল্যান্ড ইলেভেনের প্রথম ইনিংসের সাথে এক রান যোগ করা হয়েছে। ডব্লিউ জি গ্রেস ৩৯৯ রানে অপরাজিত থাকলেও ম্যাচ শেষে এটা জানার পর এক রান যোগ করে দেয়া হয়েছে!’
৪০০ তম রানটি গায়ের জোরে ছিনিয়ে নেয়া বৈ অন্য কিছু ছিল না। একেবারে জোর যার মুল্লুক তার – টাইপ ব্যাপার। কিন্তু এতকিছুর পরও দর্শক তাঁর খেলা দেখতেই মাঠে উপস্থিত হত! এটাই ছিল ডব্লিউ জি গ্রেসের মাহাত্ম্য! আসলে তিনিই ক্রিকেটকে ‘টাইম পাস করার জিনিস’ থেকে সত্যিকারের খেলার মর্যাদা দিয়েছিলেন।
ডব্লিউ জি গ্রেসই ক্রিকেটের প্রথম মেগা স্টার!