পোট্রেট অব আ ফাস্ট বোলার

সেদিন লিলি বেশ কয়েকবার আম্পায়ার ডিকি বার্ডের কাছে বল পরিবর্তনের আবেদন জানান কারণ বলের শেপ নাকি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেকবারই লিলির আবেদন নাকচ করে দেন বার্ড। শেষে তার একটা ওভারের চারটি বল হয়ে যাওয়ার পর আরও একবার বল হাতে বার্ডের দিকে এগিয়ে যান লিলি। ‘ওভারটা শেষ হোক, তারপর দেখছি।’ বলে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েন ডিকি। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ওভারের শেষ দুটো বল অফ স্পিন করেন লিলি। ওনার বক্তব্য পরিষ্কার – একজন ব্যাটসম্যানের ব্যাটে কোনো ধরনের সমস্যা হলে সেটা তৎক্ষণাৎ পরিবর্তন করে নিতে পারে ব্যাটসম্যান। সেই অধিকার বোলারের থাকবে না কেন?

ফাস্ট বোলার!

কথাটা মনে এলেই অবধারিত ভাবে কয়েকটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

সবুজ মাঠ। স্লিপে পাঁচ–ছয়জন ফিল্ডার গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। অন্তত পিচ যতটা লম্বা উইকেটের পেছনে ততটাই দূরে দাঁড়িয়ে উইকেটরক্ষক।

এবার ক্লোজ আপ।

দৃপ্ত পদক্ষেপে নিজের বোলিং মার্কের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন এক বিশালাকায় পুরুষ। ফুল স্লিভ শার্ট, কনুই অব্দি গোটানো। জামার ওপরের বেশ কয়েকটা বোতাম খোলা থাকায় বিশাল লোমশ বুক দেখা যাচ্ছে। আর হাঁটার ছন্দে সেই বুকের ওপর দুলছে রুপোলি ক্রস।

এক মাথা অবিন্যস্ত চুল নিয়ে ব্যাটসম্যানের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন আমাদের নায়ক। দর্শকদের হাততালি আরম্ভ হল।

অন্তত ষোল-সতের স্টেপের রান আপ। পেটের কাছে ডান হাতে বল নিয়ে আর বাঁ- হাত দিয়ে সেটিকে ঢেকে দৌড় আরম্ভ করলেন। তার স্টেপের সঙ্গে সঙ্গে গ্যালারি থেকে ভেসে আসছে হাততালির শব্দ, সেই সঙ্গে তার নাম ধরেও বার বার ডাকছে দর্শকেরা। ক্রিজের কাছে আসার একটু আগে ডান হাত দুলতে লাগল উরুর পাশে – যেন পরিবেশ থেকে শক্তি সংগ্রহ করছে।

ক্রিজের একটু পেছন থেকে বিশাল লাফ দিয়ে বাতাসে ভেসে গেল শরীর, সেই সঙ্গে বল ধরা হাতটি উঠে এল মাথার অল্প ওপরে। ক্রিজের ওপর বাঁ পায়ের সঙ্গেই চাবুকের তীব্রতায় নেমে এল তার ডান হাতটিও। তার আগেই শত্রুর উদ্দেশ্যে ছোড়া হয়ে গেছে তার অস্ত্র যা এখন ধেয়ে চলেছে ব্যাটসম্যানের দিকে দূর্বার গতিতে। তার শরীরও এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে, প্রায় ব্যাটসম্যানের ক্রিজের সামনে।

তারপর হয়ত সাফল্যের উদ্দামতায় সে আরও একবার লাফিয়ে উঠল। অথবা অভিযোগের দৃষ্টিতে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে কয়েকটি শব্দ মুখ থেকে বেরিয়ে এল। তারপর ডান হাতের প্রথম আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম মাটিতে নিক্ষেপ করে আবার ফিরে চলল নিজের বোলিং মার্কের দিকে।

ওপরের দৃশ্যটা আইডিয়াল, আদর্শ। কিন্তু আদর্শের সঙ্গে বাস্তবের মিল জীবনে কদাচিৎ হয়। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয় ক্রিকেট ইতিহাসের কোন ফাস্ট বোলার এই আদর্শের সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন, এতটাই যে যারা তাকে দেখেছেন তাদের কাছে ফাস্ট বোলারের আদর্শের উল্লেখ মাত্রই তার বল করার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে – তাহলে বেশীরভাগ বোদ্ধা, সমকালীন ক্রিকেটার এবং সাধারন দর্শক যার নাম সবচেয়ে বেশিবার নেবেন তিনি হচ্ছেন ডেনিস কিথ লিলি।

ওনাকে লাইভ পারফর্ম করতে দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নি – টিভিতেও না। তবে তার অসাধারন রেকর্ড দেখেছি। কিন্তু এখানে তিনি সর্বোত্তম নন। ম্যালকম মার্শাল, রিচার্ড হ্যাডলি, ডেল স্টেইন, কার্টলি অ্যামব্রোস, গ্লেন ম্যাকগ্রা – খুব বেশি হলে তাদের সঙ্গে এক সারিতে বসানো যেতে পারে লিলিকে নিছক রেকর্ডের ভিত্তিতে।

কিন্তু, আমাদের ভাগ্য ভালো যে লিলির বেশ কিছু উঁচু মানের ভিডিও রয়েছে ইউটিউবে। ক্রিকেট যারা ভালোবাসে তাদের অনুরোধ করব ভিডিওগুলি দেখুন। সম্ভব হলে বারবার। এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য সমকালীন ফাস্ট বোলার আর ব্যাটসম্যানদের ইন্টার্ভিউগুলিও দেখুন। দেখতে পাবেন সবার মুখে একটা নাম ঘুরে ফিরে আসছে – ডেনিস লিলি।

তিনি ভিভ রিচার্ডসের দেখা শ্রেষ্ঠ বোলার। সানি গাভাস্কারেরও। এবং ইয়ান বথাম। রিচার্ড হ্যাডলি তো নিজেকে গড়েই তুলেছেন তার আদলে। গ্লেন ম্যাকগ্রারও রোল মডেল সেই লিলিই। আরও এক চ্যাম্পিয়ন ফাস্ট বোলার এন্ডি রবার্টসও একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন লিলির শ্রেষ্ঠত্ব। লয়েডের বিশ্বত্রাস ফাস্ট বোলিং ইউনিটের অনুপ্রেরণার উৎসও লিলির নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ার দুর্ধর্ষ পেস আক্রমণ।

কি নেই লিলির মধ্যে? প্রথমেই যেটা চোখে পড়বে সেটা হচ্ছে তার শ্বেতপাথরে খোদাই করা বিশালাকায়, শক্তিশালী এবং অসম্ভব সুন্দর শরীর। এক ঝাঁক কোঁকড়ানো চুল। পুরুষালি মুখের গঠন। দৃপ্ত হাঁটার ভঙ্গি।

তবে আমার মতে, তার বোলিং এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশটি হচ্ছে তার বল হাতে ছোটার দৃশ্য। পাশ থেকে লিলির ছুটন্ত শরীর দেখে মনে হয় এর চেয়ে স্বাভাবিক দৃশ্য আর কিছুই হতে পারে না। যেন ঈগল আকাশে ডানা মেলে দিয়েছে। বা সিংহ চলেছে নিজের শিকারের সন্ধানে।

তারপর চোখে পড়বে লিলির অনবদ্য বোলিং অ্যাকশন। হয়ত হ্যাডলির মতো শক্তি সঞ্চয়কারী নয়। বা ইমরানের মতো শেষ লাফটিও অতটা দর্শনীয় নয়। কিন্তু সব মিলিয়ে দুজনের চেয়েই তার একশান বেশী দৃষ্টিসুখ দেয়।

এবার বলের গতি। এখানেও লিলি পিছিয়ে থাকবেন না প্রায় কারোর চেয়েই। প্রায় লিখলাম একমাত্র তার সতীর্থ জেফ টমসনের কথা চিন্তা করে। তুবও লিলির বল মাথার ওপর থেকে লাফিয়ে এক হাতে গ্যাদার করছেন মার্শ – এ দৃশ্য দেখতে পাবেন প্রায়ই। বা ব্যাটসম্যানের নাকের সামনে দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে বেরিয়ে যাওয়া বাউন্সার।

এবার নিয়ন্ত্রণ। সাধারণত গতি আর নিয়ন্ত্রণ একসঙ্গে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু এখানেও লিলি উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম। শুধু অসাধারন নিয়ন্ত্রনই নয়, সেই সঙ্গে তার বলে ছিল মারাত্মক কাজও। স্যুইং এবং কাট, উইকেটের দুই দিকেই। তার আউট স্যুইং বা লেগ কাটারের প্রমান হিসেবে ক্রিকেট রেকর্ডে পাবেন ৯৫ বার ‘কট মার্শ বো লিলি’ (বিশ্বরেকর্ড) বা ২২ বার ‘ক গ্রেগ (চ্যাপেল) বো লিলি’। আবার ইন স্যুইং বা অফ কাটারের ওপর দক্ষতার নিদর্শন স্বরুপ রয়েছে ৬২ বার এল বি ডাব্লিউ আর ৫৪ বার বোল্ড করে উইকেট দখল করার রেকর্ড।

বল করার পর লিলির অ্যাপিলের ভঙ্গিও কম অ্যাপিলিং নয়। দুই হাত আকাশের দিকে তুলে আম্পায়ারের কাছে উইকেটের জন্য আবেদন নয়, দাবি জানাতেন লিলি। কখনও বা দেখা যেত আউট দিতে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের দেরি হয়ে যাওয়াতে অধৈর্য বিরক্তির প্রকাশ। আর প্রার্থিত নির্ণয় পেয়ে যাওয়ার পর দুই হাত তুলে লাফাতে লাফাতে স্লিপের দিকে ছুটে যাওয়া। ক্যামেরার ক্লোজ আপে ধরা পড়ত মুখে আনন্দের হাসি, কপালে ঘাম।

তবে একঘেয়ে নন লিলি। তার ক্রিকেট জীবনে বৈচিত্র আর বিতর্কেরও অভাব নেই।

ক্যারিয়ার আরম্ভের কিছুদিন পরেই স্পাইনের আঘাতে দেড় বছরের জন্যে মাঠের বাইরে যেতে বাধ্য হন লিলি। এক সময় সবাই ভেবেছিল তার পক্ষে আর ক্রিকেট খেলা সম্ভবই হবে না। কিন্তু অসাধারন মনের জোর আর পরিশ্রমের মাধ্যমে লিলি শুধু ফিরেই আসেন নি, ফিরে আসেন আরও সম্পূর্ণ বোলার হয়ে। এরপর প্রায় তিন বছর টেস্ট খেলেন নি লিলি ১৯৭৭ থেকে।

সেই সময় ক্যারি প্যাকারের ‘ওয়ার্ল্ড সিরিজ’ ক্রিকেটে অংশ নেন অস্ট্রেলিয়া আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের তারকারা। সেই সময় ক্রিকেট জীবনের অন্যতম সেরা ফর্মে ছিলেন লিলি। টেস্ট খেললে এই সময় তিনি ৭০ থেকে ১০০টি উইকেট পেতেন অনায়াসে। সে ক্ষেত্রে ৪০০ উইকেটের মাইলস্টোন অবধারিত ভাবেই লিলি প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ছুঁয়ে ফেলতেন।

নিজের ক্রিকেট ক্ষমতা সম্বন্ধে পুরোমাত্রায় সচেতন ছিলেন লিলি। সেই সঙ্গে তার ছিল ফাস্ট বোলার সুলভ মেজাজ আর দম্ভও। ক্রিকেট মাঠে বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন লিলি তার মেজাজের জন্য। কখনও জাভেদ মিয়াদাদকে লাথি মেরে, কখনও অ্যালুমিনিয়াম ছুঁড়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে, কখনও বা সুনীল গাভাস্কারের প্যাডে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যে কেন তিনি এল বি ডাবলু আউট ছিলেন।

তবে তার মধ্যে একটা ঘটনা বেশ মজার। সেদিন লিলি বেশ কয়েকবার আম্পায়ার ডিকি বার্ডের কাছে বল পরিবর্তনের আবেদন জানান কারণ বলের শেপ নাকি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেকবারই লিলির আবেদন নাকচ করে দেন বার্ড। শেষে তার একটা ওভারের চারটি বল হয়ে যাওয়ার পর আরও একবার বল হাতে বার্ডের দিকে এগিয়ে যান লিলি।

‘ওভারটা শেষ হোক, তারপর দেখছি।’ বলে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েন ডিকি।

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ওভারের শেষ দুটো বল অফ স্পিন করেন লিলি। ওনার বক্তব্য পরিষ্কার – একজন ব্যাটসম্যানের ব্যাটে কোনো ধরনের সমস্যা হলে সেটা তৎক্ষণাৎ পরিবর্তন করে নিতে পারে ব্যাটসম্যান। সেই অধিকার বোলারের থাকবে না কেন?

লিলির করা সেই দুটি অফ স্পিন বলের ভিডিও দেখেছি। সেখানেও দেখা যাচ্ছে বল করার পর উইকেট পাওয়ার আশায় আকাশের দিকে দুই হাত তুলে ফলো থ্রুতে এগিয়ে যাচ্ছেন লিলি।

করলেনই বা অফ স্পিন – তবুও তিনি লিলি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...