অতিমানবীয় সেই অমর বুড়ো

আরেকবার মাঠে তিনি প্রথম বলে আউট হয়েও মাঠ ছাড়ছেন না। এটা দেখে ফিল্ডিং দলের খেলোয়াড়েরা বললো তুমি আউট হয়ে গিয়েছ। তখন গ্রেস বলেছিলেন, ‘লোকজন গাটের পয়সা খরচ করে আমার ব্যাটিং দেখতে এসেছে, তোমার বোলিং নয়’। কথাটা খুব একটা ভুল বলেননি কারণ টিকিটের বিজ্ঞাপনে লেখা থাকতো টিকিটের দাম ৬ শিলিং, আর যদি গ্রেস খেলে তাহলে ১ পাউন্ড ।

তাঁর আত্বীয়দের মধ্যে দাদা, বাবা, মামা সবাই ক্রিকেটার ছিলেন । তার তিন বড় ভাইও ক্রিকেটার ছিলেন । তবে, বাকি সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শুধু পরিবারের সবাইকেই নয়, ক্রিকেটের ইতিহাসেও অন্যতম সর্বোচ্চ আসনে ঠাঁই হয়েছে তাঁর। তিনি উইলিয়াম গিলবার্ট গ্রেস। সংক্ষেপে ডব্লিউ জি গ্রেস।

জন্ম ১৮৪৮ সালের ১৮ জুলাই। উইলিয়াম গিলবার্ট গ্রেস পেশায় একজন ডাক্তার, আবার একজন অ্যাথলেটও। তাকে ক্রিকেটের অমর বুড়ো বলে আখ্যা দেওয়া হয়। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা একজন আইকনিক খেলোয়াড়।

তার মা মার্থা গ্রেস ‘অল ইংল্যান্ড ইলেভেন’-এর জর্জ পার কে লেখা এক চিঠিতে তার ছেলে ই.এম.গ্রেসকে দলে নেওয়ার অনুরোধ করেন। চিঠিতে এটাও উল্লেখ করেছিলেন যে আমার অন্য আর এক ছেলে আছে যার বয়স ১২, সে সময়ের সাথে সাথে তার দাদার থেকে আরও বড় খেলোয়াড় হবে । কারন সে ব্যাকে খুব ভালো খেলে এবং সবসময় সোজা ব্যাটে খেলে।

সেই ছেলে গ্রেস ১৮৬৩ সালে মাঠে নেমে জেন্টলম্যান অফ সমারসেটের বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৫১ ও ১ রান করেন । বল হাতে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট এবং ফিল্ডিংয়ে ধরেছিলেন ১টা ক্যাচ । তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। ১৮৬৬ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি ইংল্যান্ড দলের হয়ে সারের বিপক্ষে অপরাজিত ২২৪ রানের ইনিংস খেলেন।

তাঁর ক্যারিয়ার স্থায়ী হয়েছিল প্রায় ৪০ বছর। ১৮৬৮ থেকে ১৮৭৭ সাল এই ১০ বছরে তার এবং অন্যান্য বাকি ব্যাটসম্যানের মধ্যে ছিল বিরাট পার্থক্য। প্রতি বছর তিনি ব্যাটিং গড়ের দিক থেকে সবসময় উপরে থাকতেন। বাকি ব্যাটসম্যানরা গড়ের দিক দিয়ে তার অর্ধেকও করতে পারতো না। এর ব্যত্যয় ঘটেছিল শুধুমাত্র ১৮৭৫ সালে। সেবার তিনি দ্বিতীয় হয়েছিলেন।

১৮৭১ সালে ২৩ বছর বয়সে তিনি ৭৮.২৫ গড়ে ২৭৩৯ রান করেছিলেন। এর পরের সর্বোচ্চ ছিল রিচার্ড ডাফটের তিনি ৩৭.৬৬ গড়ে করেছিলেন ৫৬৫ রান। গ্রেস এই সময় ১০ টি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। দ্বিতীয় সেরা যে ছিল সে হাঁকিয়েছিল মাত্র দুটো।

১৮৭৬ সালের ১১ আগস্ট থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত তিনি এক মিরাকল পারফরম্যান্স করেছিলেন। এমসিসির হয়ে ক্যানটারবারিতে ৩৪৪ ক্লিফটনে ১৭৭ এবং চেল্টেনহ্যাম গ্লৌচেস্টারশায়ারের হয়ে তিনি অপরাজিত ৩১৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন।

২৮টি মৌসুমে তিনি প্রতিবারই ১০০০ এর উপরে রান এবং ৫ মৌসুমে তিনি ২০০০ এর উপরে রান করেছিলেন। রাউন্ড আর্ম বোলিং অ্যাকশনে বল করে তিনি ৯ মৌসুমে ১০০ এর উপরে উইকেট শিকার করেছিলেন। ১৮৭৪,৭৫ এবং ৭৭ সালে তিনি সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হয়েছিলেন। তিনি ৩৯.২৫ গড়ে সর্বমোট ৫৪,২১১ রান সংগ্রহ করেছেন। এবং ৮৭০ ম্যাচে বোলিংয়ে ১৮.১৪ গড়ে সর্বমোট ২৮০৯ টি উইকেট শিকার করেন। এর মধ্যে ২৪০ বার তিনি ৫ উইকেট এবং ৬৪ টি বার ১০ উইকেট পেয়েছিলেন।

১৮৭৭ সালে নটিংহ্যামশায়ার বিপক্ষে ১৭ উইকেট পেয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৭ বলে কোন রান না দিয়েই পেয়েছিলেন ৭ উইকেট। ১৮৯৫ সালে ৪৭ বছর বয়সেও তিনি অসাধারণ একটা সিজন কাটিয়েছিলেন। তিনি ফিল্ডার হিসেবেও ছিলেন দুর্দান্ত।

১৮৮০ সালে তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে মাঠে নেমেই ১৫২ রানের ইনিংস খেলেন। এটা ছিল তার ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরি। দ্বিতীয় বার সেঞ্চুরি করেন ১৮৮৬ সালে এবার তিনি করেন ১৭০ রান।

তিনি ছিলেন একজন চমৎকার অলরাউন্ডার। বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান এবং রাউন্ড আর্ম স্লো মিডিয়াম বোলার। তিনি আরও বেশি পরিচিত তার বিখ্যাত দাঁড়ির জন্য। গ্রেস ক্রিকেট খেলায় ছিলেন অনেক প্রথমের সাক্ষী।

  • ১৮৭৬ সালে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে তিনিই প্রথম দুটো ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছিলেন।
  • প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে এক মৌসুমে ২০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন।
  • ১৮৭১ সালের এক মৌসুমে তিনি ২৭৩৯ রান করেছিলেন।
  • তিনিই প্রথম এবং একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে ১৮৯৫ সালের মে মাসে তিনি ১০০০ রান করেছিলেন।

তিনি একবার বোল্ড আউট হয়েও সেই বেলটা পরিবর্তন করে আরেকটা বেল লাগিয়ে তার ব্যাটিং চালিয়ে গিয়েছিলেন। এ বিষয়ে তার বক্তব্য ছিল আজকে প্রচুর বাতাস হচ্ছে, তাই বেলটা মাটিতে পরে গেছে। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫০ হাজার রান এবং ১০০ সেঞ্চুরি করেছিলেন।

ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরির মালিক তিনি। এবং ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষেক মাচেও সেঞ্চুরি করার রেকর্ড তার দখলে। ১৮৮০ সালের দ্য ওভালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৫২ রান করেছিলেন। এবং একই মাঠে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ১৮৮৬ সালে ১৭০ রান করেছিলেন।

তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে ২২ টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন, যার মধ্যে ১৩ টেস্টেই তিনি ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যেদিন তার দ্বিতীয় পুত্র সন্তান জন্ম নিল সেদিনও তিনি ৪০০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন।

ক্রিকেট মাঠে খেলার সময় তাকে নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে।

একবার শোনা যায় ম্যাচে দিনের শেষ বলে এক ব্যাটসম্যান আউট হলেও কেউ আবেদন করেননি । ব্যাটসম্যান মাঠ থেকে বেরোতে বেরোতে হাসতে হাসতে ডব্লু জি কে জানায় বিষয়টি । পরের দিন প্রথম বলেই আউটের আবেদন করে বসেন গ্রেস । আম্পায়ার আউট দিয়ে দেয় (এখন আর এই নিয়ম নেই ) ।

আরেকবার মাঠে তিনি প্রথম বলে আউট হয়েও মাঠ ছাড়ছেন না। এটা দেখে ফিল্ডিং দলের খেলোয়াড়েরা বললো তুমি আউট হয়ে গিয়েছ। তখন গ্রেস বলেছিলেন, ‘লোকজন গাটের পয়সা খরচ করে আমার ব্যাটিং দেখতে এসেছে, তোমার বোলিং নয়’। কথাটা খুব একটা ভুল বলেননি কারণ টিকিটের বিজ্ঞাপনে লেখা থাকতো টিকিটের দাম ৬ শিলিং, আর যদি গ্রেস খেলে তাহলে ১ পাউন্ড ।

ক্রিকেট খেলায় একবার ডব্লিউ জি গ্রেস ৯৯ রানে ব্যাট করছেন। বোলার যখন বল ছুড়লেন তিনি স্ট্যাম্প থেকে সরে গেলেন। ফলাফল বোল্ড আউট। তো অন্য খেলোয়াড়েরা যখন জিজ্ঞাসা করলেন এ কাজ কেন করলে? ডব্লিউ জি গ্রেস জবাব দেন এর আগে আমি ৮২ টা সেঞ্চুরি করেছি কিন্তু কখনো ৯৯ রানে আউট হইনি। তাই আজকে ৯৯ রানে আউট হয়ে দেখলাম কেমন লাগে।

এর পরে একবার তিনি যখন ৯৩ রানে অপরাজিত তখন তিনি ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেন। এমন করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন ০ থেকে ১০০ সব রানই করেছি, কিন্তু ৯৩ কখনই করিনি। সেই জন্য এই কাজ করেছি।

ক্লিফটনে সারের বিপক্ষে খেলার সময় তিনি একটি শট খেললেন। সেই শটটা ফিল্ডার ধরে থ্রো করলে বলটা গ্রেসের জামার পকেটে ঢুকে যায়। তবুও তিনি দৌড়ে ৬ রান নিয়ে নেন। শেষে ফিল্ডাররা ধরে তাঁকে থামায়। এর পরে তারা নিয়ম করে যে বল ব্যাটসম্যানের পকেটে বল ঢুকলে তা ডেড বল ঘোষণা করা হবে।

ইএসপিএন ক্রিকইনফোর তথ্যানুযায়ী জানা যায়, ডব্লিউ জি গ্রেস ক্যারিয়ারে টেস্ট খেলেছেন ২২ টি, রান করেছেন ১০৯৮ রান, ২ টা সেঞ্চুরি, উইকেট ৯টা । সর্বোচ্চ ১৭০ রান । প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলেছেন ৮৭০ টি ম্যাচ । রান করেছেন ৫৪,২১১। শতক হাকিয়েছেন ১২৪ টি ,অর্ধশত রান করেছেন ২৫৪ টি । সর্বোচ্চ ৩৪৪ রান। উইকেট পেয়েছেন ২৮০৯ টি । ৫ উইকেট (ইনিংসে) ২৪০ বার। ১০ উইকেট (ম্যাচে)-৬৪বার। সেরা বোলিং ৪৯ রানে ১০ উইকেট (ইনিংসে) ।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...