কাব্যিক ও বিতর্কিত এক আগ্রাসন

তাঁকে বলা হয় অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের প্রথম গতিতারকা। ছিলেন সত্তর-আশির দশকের আইকনিক পেসার। সত্তর দশকের শুরুতে তরুণ ধ্বংসাত্মক ফাস্ট বোলার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল ছেলেটির। দুর্দান্ত রিদমিক রান আপ থেকে শুরু করে ফলো-থ্রু পর্যন্ত ছিলো একেকটি কাব্যিক আর আগ্রাসী ব্যাপার! ঝলমলে লম্বা চুল, গোঁফ, সোনার চেইন আর সুদর্শন চেহারার ছেলেটির ২২ গজে বল হাতে আক্রমণাত্মক চরিত্র ব্যাটসম্যানদের ঘুম হারাম করার জন্য ছিলো যথেষ্ট।

তাঁকে বলা হয় অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের প্রথম গতিতারকা। ছিলেন সত্তর-আশির দশকের আইকনিক পেসার। সত্তর দশকের শুরুতে তরুণ ধ্বংসাত্মক ফাস্ট বোলার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল ছেলেটির। দুর্দান্ত রিদমিক রান আপ থেকে শুরু করে ফলো-থ্রু পর্যন্ত ছিলো একেকটি কাব্যিক আর আগ্রাসী ব্যাপার! ঝলমলে লম্বা চুল, গোঁফ, সোনার চেইন আর সুদর্শন চেহারার ছেলেটির ২২ গজে বল হাতে আক্রমণাত্মক চরিত্র ব্যাটসম্যানদের ঘুম হারাম করার জন্য ছিলো যথেষ্ট।

আবার কখনোবা ক্রিকেট মাঠেই মেজাজ হারিয়ে সাক্ষী হয়েছেন নানান বিতর্কের। আচ্ছা, আজকের আয়োজন কাকে নিয়ে? এতোকিছু জানা হলো কিন্তু সেই মানুষটির নামটিই তো জানা হলোনা। আমার এই অধৈর্য্য মন বারবার জানতে চাইছে এই মানুষটিকে। অবশেষে আমি যাকে পেলাম সে তো কোটি তরুণের আইডল। তিনি অস্ট্রেলিয়ার সাবেক তারকা ক্রিকেটার ডেনিস লিলি।

বল হাতে দুর্দান্ত গতির সাথে ছিলো দারুণ ছন্দ, আগ্রাসন আর নিয়ন্ত্রণ। এই তিনের মিশ্রনে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের থাকতে হয়েছিল আতঙ্কে। কিছু কিছু ক্রিকেটারের চোখের ঘুম কেড়ে নেওয়া ছিলো লিলির কাছে মামুলি বিষয়। যদিও লিলির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল পিঠের ব্যথা। যেটি লিলিকে বোলিং অ্যাকশন বদলাতে বাধ্য করেছিলো। কিন্তু লিলি হারিয়ে যায়নি, ফিরেছেন নতুন রূপে, লড়াই করেছেন ২২ গজে। নিজের নামটি নিয়েছেন সেরাদের কাতারে। শুধু তাই নয়, লিলিকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ‘নো-বল’ করতে দেখা যায়নি কখনো। এই কারণে তাকে অনেকে ‘ডিসিপ্লিনড’ বোলার হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন।

অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে লিলির সাদা পোশাকের শুরুটা হয়েছিল রাজকীয়। অ্যাডিলেডে নিজের অভিষেক ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়ে নজরে এসেছিলেন, জানিয়ে দিয়েছিলেন ‘বিশ্ব তুমি তৈরি হও – লিলির রাজত্ব দেখতে!’ হ্যাঁ, পরবর্তী সময়ে লিলির রাজত্ব চলেছে ২২ গজে। যেই রাজত্বের খাতায় যুক্ত হয়েছে অসংখ্য রেকর্ড। অবশ্য ক্রিকেট মাঠে লিলির পারফরম্যান্সের থেকে মেজাজ হারিয়ে বিতর্কের ঘটনাগুলোই তাঁকে মনে করিয়ে দেয় বারবার।

এসবের বাহিরে যদি কিছু বলতে যাই তাহলে সবার প্রথমে আসবে লিলি-ভিভের ২২ গজে ব্যাট-বলের যুদ্ধের গল্প-কাহিনী। সেটির জন্য ফিরে যেতে হবে আশির দশকে। লিলি-ভিভ দু’জন দুজনের মুখোমুখি হয়েছিলো ১৯৭৫ সালে। সেবার বল হাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানদের সামনে লিলি চালিয়েছিলো বোলিং তাণ্ডব।

পকেটে পুড়েছিল ২৭ টি উইকেট। এখানে সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল সেই সিরিজে ভিভ রিচার্ডসকে ৫ বার আউট করেছিলো লিলি। এখানেই শেষ নয়, এরপর ১৯৭৭ সালে হওয়া ক্যারি প্যাকার সিরিজে লিলি বল হাতে ভিভকে ৮ বার পুড়েছিলেন পকেটে। এছাড়াও মুখোমুখি লড়াইয়ে প্রায় ভিভকে শিকারে পরিণত করায় ভিভ বলেছিলো, ‘ক্রিকেট ক্যারিয়ারে একমাত্র লিলিই আমার রাতের ঘুম কাড়তে পেরেছিল।’

যাকগে, এবার একটু মেজাজ হারিয়ে ফেলা লিলিকে জানি। ক্রিকেট মাঠে দুর্দান্ত আগ্রাসন লিলি মেজাজ হারিয়েছেন কয়েকবার। একবার তো ভারতীয় ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কারের অধিনায়কত্বও নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছিলো এই লিলির কারণে। এখানেই শেষ হয়, একবার তো মিয়াঁদাদ-লিলি মাঠেই মারামারি লাগতে যাচ্ছিলো! আচ্ছা সেই ঘটনা একটু জানি।

পাকিস্তানের সামনে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫৪৩ রানের। এমন রানের বোঝা মাথায় নিয়ে ব্যাট করতে আসা মিয়াঁদাদ অল্পতেই তেড়েফুঁড়ে এসেছিলো সেদিন। আর এটার সুত্রপাত ঘটেছিলো লিলির ইনসুইঙ্গার বল লেগ সাইডে খেলে রান নিতে গিয়ে লিলির সাথে ধাক্কা লাগার মধ্য দিয়ে। সেদিন মাঠে উপস্থিত দর্শকদের খোলা চোখে মনে হয়েছিলো সবচেয়ে বেশী দোষ লিলির কিন্তু মাঠে ঘটেছিল অন্যটা।

সেদিন মেজাজ হারিয়ে লিলি মিয়াঁদাদকে লাথি মেরে বসে! ব্যস, মিয়াঁদাদও মেজাজ হারিয়ে ব্যাট দিয়ে মারতে যায় লিলিকে। এরই সাথে দাগ লেগে গিয়েছিল ক্রিকেট ইতিহাসে। এই ঘটনার অবশ্য পার পাননি লিলি, তাঁকে গুনতে হয়েছিলো ২০০ ডলার জরিমানা।

এছাড়াও অ্যালুমিনিয়াম ব্যাট ব্যবহার করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন লিলি। কিন্তু এইসব বিতর্ক ছাপিয়ে গেছেন ২২ গজে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সাদা পোশাকে ৭০ ম্যাচে ২৩ গড়ে পকেটে পুড়েছেন ৩৫৫ উইকেট। যেখানে সেরা বোলিং ৮৩ রানে ৭ উইকেট। ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেন ২৩ বার এবং ম্যাচে ১০ উইকেট শিকার করেন ৭ বার।

শুধু তাই নয়, রঙিন পোশাকের ৬৩ ম্যাচে ১০৩ উইকেট শিকার করেছেন লিলি। এই পারফরম্যান্স গুলো তাকে নিয়ে গেছে অনেক উপরে। কিছু জরিপে দেখা যায় স্টেইন, রবার্টস, হোল্ডিং, ম্যাকগ্রা, আকরামদের থেকেও সেরা লিলি!
কে সেরা সেই গল্প না হয় অন্য একদিন শুনবো। আজ লিলির ক্রিকেট মাঠে কিছু পারফরম্যান্স চোখ বুলিয়ে দেখা যাক।

  • অভিষেক টেস্টে ৫ উইকেট

আজকের দিনগুলোতে ৫ উইকেট খুব বেশি শিকার করা এক প্রকার নিত্যদিনের ঘটনার মতো। কিন্তু ১৯৭১ সালের সময়টায় ৫ উইকেট শিকার করা ছিলো দারুণ ব্যাপার। আর সেটা যদি হয় অভিষেক ম্যাচে তাহলে তো সেটির মজা আরো বেড়ে যায়! নিজের অভিষেক ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৮৪ রানে ৫ উইকেট শিকার করে নজরে এসেছিলেন লিলি।

  • প্রথমবার ১০ উইকেট শিকার

লিলি তখন সবে মাত্র ৬ টি ম্যাচ খেলা শেষ করে সপ্তম ম্যাচ মাঠে নেমেছেন। প্রতিপক্ষে সেই ইংল্যান্ড। সেবার বল হাতে দুই ইনিংসেই চালিয়েছিলেন তাণ্ডব। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৫+৫ তথা ১০ উইকেট শিকার করে নিজের ক্যারিয়ারে যুক্ত করেছিলেন নতুন পাতা।

  • ৮৩ রানে ৭ উইকেট

সময়টা ১৯৮১ সাল! লিলি তখন প্রতিপক্ষের সামনে এক আতঙ্কের নাম। কেননা সেই সময়ে নিজেকে দারুণ ভাবে মেলে ধরেছিলেন বল হাতে। সেদিন প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাত্র ৮৩ রানে ৭ উইকেট শিকার করেছিলেন লিলি। যেটি ছিলো টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ফিগার।

এখানেই শেষ নয় লিলির সাফল্যের গল্প, আরো আছে।

এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে মাত্র ১৩ ম্যাচে ৮৫ উইকেট শিকার করেছেন লিলি। সবচেয়ে কম গড়ে উইকেট শিকারী বোলারের তালিকায় ৫৪ নাম্বারে আছেন লিলি। টেস্ট ক্যারিয়ারে ম্যাচে ১০ উইকেট শিকার করেছেন সাত বার। সবচেয়ে বেশী ১০ উইকেট শিকারী বোলারের তালিকায় লিলি আছেন ৯ নাম্বারে।

টেস্ট ক্যারিয়ারে ইনিংসে ২৩ বার ৫ কিংবা তাঁর বেশি উইকেট শিকার করে ইনিংসে সবচেয়ে বেশী ৫ উইকেট শিকারের তালিকায় আছে ১৬ নম্বরে। টেস্ট ক্যারিয়ারে ৩৫৫ উইকেট শিকার করে সর্ব্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলারের তালিকায় লিলি আছেন ২৪ নাম্বারে।

টেস্ট ক্যারিয়ারে টানা চার ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেছেন লিলি। টেস্ট ক্রিকেটে লিলি ব্যাটসম্যানদের ক্যাচে পরিণত করেছেন ১৪২ বার।

এমন অনেক রেকর্ডের সাক্ষী হয়ে আছেন লিলি। তবে একটা রেকর্ডের গল্প আমাদের সবার জানা উচিত। ক্রিকেট মাঠে ওপেনিং ব্যাটিং বা বোলিং জুটির গল্পতো অনেক শোনা যায়! কিন্তু বোলিং-কিপিংয়ের রেকর্ড ক’জনই বা জানি? এই জানা-অজানা গল্পে লিলি-মার্শ রয়েছে সবার উপরে। ক্রিকেট মাঠে লিলির বলের বিপক্ষে কিপিংয়ে দাঁড়িয়ে সর্ব্বোচ্চ ৯৫ টি ক্যাচ নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার উইকেটরক্ষক মার্শ। এই জুটির আরেকটি মজার গল্প রয়েছে। সেটি হলো লিলি তার টেস্ট ক্যারিয়ারে শিকার করেছেন ৩৫৫ টি উইকেট অপরদিকে মার্শ কিপিংয়ে ঠিক ৩৫৫ টি ডিসমিসাল করেছেন টেস্ট ক্যারিয়ারে!

অনেকতো হলো, এবার শেষ করি। শেষ করার আগে ফিরে যাবো প্রথমের দিকে। যেখানে বলেছিলাম ২২ গজে লিলির ছিলো ছন্দ, আগ্রাসন আর নিয়ন্ত্রণ! উপরের এতোকিছু জানার পর এই তিনটি কথার সাথে ডেনিস লিলির নাম জুড়ে দেয়া যায় অনায়াসেই। সবমিলিয়ে বলা যায় লিলি ছিলেন গ্রেট একজন বোলারের নাম।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...