ইকার ক্যাসিয়াসের অবসরের পর স্পেন জাতীয় দলে অধিনায়কের দরকার পড়েছিল। যদিও টিম ম্যানেজমেন্টকে ভাবতে হয়নি, দলে যে একজন সার্জিও রামোস ছিলেন। সহজাত নেতৃত্বগুণ এবং আক্রমণাত্নক মানসিকতার সুবাদে যিনি স্পেনের ফুটবলকে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়। কার্লোস পুয়োলের অবসরের পরের এক যুগে স্পেনের রক্ষণভাগের দায়িত্বটা রামোস সামলেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়।
জাতীয় দলের হয়ে অবশ্য সম্ভাব্য সকল ট্রফিই জিতেছেন রামোস। ২০০৮ সালের ইউরো দিয়ে শুরু, এরপর একে একে জিতেছেন ২০১০ বিশ্বকাপ ফুটবল এবং ২০১২ ইউরোর শিরোপা। স্পেনের সোনালি প্রজন্মের স্বর্ণালী সেই দিনগুলোতে তিনিই রক্ষণভাগ সামলেছেন।
বয়সভিত্তিক দল দিয়ে শুরু, অনুর্ধব-১৯ দলের হয়ে ২০০৪ সালে জেতেন ছোটদের ইউরো। সেবারে ইউক্রেনের বিপক্ষে টাইব্রেকারে শেষ শটটা জালে জড়িয়ে জয়ের নায়ক ছিলেন তিনি। এরপরের বছরই চীনের বিপক্ষে ৩-০ গোলে জয়ের ম্যাচে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক রামোসের। সেস্ক ফ্যাব্রেগাস রেকর্ডটা ভাঙার আগে তিনিই ছিলেন জাতীয় দলের সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার।
শুরুতেই অবশ্য জাতীয় দলে থিতু হতে পারেননি। ২০০৬ সালে মাইকেল সালগাদো জাতীয় দল থেকে অবসর নিলে রাইটব্যাক হিসেবে খেলতে শুরু করেন তিনি। রিয়াল মাদ্রিদে চার নম্বর জার্সি পরলেও জাতীয় দলের হয়ে সবসময় ১৫ নম্বর জার্সি পরতেন বন্ধু পুয়ের্তার স্মরণে। পুয়ের্তা ছিলেন সেভিয়ার একাডেমি থেকে উঠে আসা স্প্যানিশ ফুটবলার, যিনি কিনা স্পেন জাতীয় দলেও খেলেছেন। কিন্তু ২০০৭ সালে অকালে মারা যান এই তারকা। বন্ধুর স্মৃতিকে ধরে রাখতেই তাঁর রেখে যাওয়া ১৫ নম্বর জার্সি পরতেন রামোস।
২০০৮ ইউরো ছিল রামোস এবং স্পেনের জন্য নিজের সামর্থ্য জানান দেবার আসর। অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ডের সেই আসরে গোল সামলানোর পাশাপাশি প্রতিপক্ষের জালে দুবার বল পাঠান এই তারকা। ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে ১-০ গোলে জিতে প্রথমবারের মতো মহাদেশ সেরা হওয়ার খেতাব অর্জন করে লা রোহারা। গ্রুপপর্বে গ্রীসের বিপক্ষে ম্যাচ বাদে প্রতি ম্যাচেই মাঠে নামেন রামোস।
২০০৯ কনফেডারেশন্স কাপটা অবশ্য বাজে কাটে রামোসের জন্য। স্পেনও দলগতভাবে ভালো করতে পারেনি, শেষ করে তৃতীয় স্থানে থেকে। তবে রামোস বোধহয় নিজের সেরাটা জমিয়ে রেখেছিলেন ২০১০ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের জন্য। সেবারে রাইটব্যাক হিসেবে স্পেনের হয়ে প্রতিটা মিনিট মাঠে ছিলেন এই তারকা। সাত ম্যাচে স্পেনের পাঁচ ক্লিনশিট রাখার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল তাঁর।
রাইটব্যাক হিসেবে খেললেও টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ৩১ বার সলো রান নিয়েছিলেন তিনি। মিডফিল্ড নির্ভর স্পেনের ডানপ্রান্তের প্রাণ ছিলেন রামোস। ফাইনালে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার গোলে স্পেন জয় পেলেও ডাচদের ১২০ মিনিট আটকে রাখার কৃতিত্ব রামোসের। তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অর্জন ২০১০ সালের বিশ্বকাপ জয়।
এরপর ২০১২ ইউরো স্পেন খেলতে গিয়েছিল ফেবারিট হিসেবেই। সেমিফাইনালে পর্তুগালের বিপক্ষে টাইব্রেকারে শেষ শটটা জালে জড়িয়ে দলকে জয় এনে দেন তিনি। এরপর ফাইনালে তো ইতালিয়ানদের অসহায় আত্নসমর্পন, ৪-০ গোলে জিতে টানা দ্বিতীয় জয়ের আনন্দে মাতেন স্প্যানিশরা। গোটা টুর্নামেন্টে দারুণ পারফর্ম করার সুবাদে টুর্নামেন্টের সেরা একাদশে জায়গা করে নেন তিনি।
এরপরই নিজেদের ইতিহাসের সেরা তারকাদের বিদায়ে খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়ে স্পেন জাতীয় দল। যদিও রক্ষণভাগের নেতৃত্বটা তখনো সামলাচ্ছেন রামোস। কিন্তু চূড়ান্ত অঘটনটা ঘটে যায় ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে, ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলতে এসে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেন রামোসরা। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৫-১ গোলে লজ্জার হারের পাশাপাশি চিলিও সাথেও হারতে হয় ২-০ ব্যবধানে। স্পেনের শেষের শুরুটা সেখান থেকেই।
এরপর ইউরো ২০১৬ কিংবা ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপ – সবখানেই স্পেন গিয়েছে অন্যতম ফেবারিট হিসেবে। কিন্তু শেষটা ফেবারিটের মতো হয়নি, প্রতিবারই বিদায় নিতে হয়েছে শেষ ষোল থেকেই। রামোস রক্ষণে অসহায় সেনানীর মতো চেষ্টা করে গেছেন, কিন্তু দলগত খেলা ফুটবলে কি আর একজনের চেষ্টায় হয়!
২০১৯ সালে লুইস এনরিকে কোচ হয়ে আসার পর অধিনায়কের বাহুবন্ধনীটা তুলে দেন রামোসের হাতেই। যদিও গ্রুপপর্বে দ্বিতীয় হওয়ার কারণে সেবার ফাইনাল খেলা হয়নি লা রোহাদের। এছাড়া ২০২০ ইউরোর বাছাইপর্বের ম্যাচগুলোতেও তিনি ছিলেন একাদশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ২০১৯ সালে ইকার ক্যাসিয়াসকে ছাপিয়ে তিনি বনে যান জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা ফুটবলার।
কিন্তু ২০২০ ইউরোর ঠিক আগে ইনজুরিতে পড়ে ছিটকে যান টুর্নামেন্ট থেকে। যদিও রামোসের দাবি ছিল তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন, কিন্তু কোচ এনরিকে ঝুঁকি নিতে চাননি। ২০০৪ সালের পর সেবারই প্রথম কোনো বড় টুর্নামেন্টে তাঁকে ছাড়া মাঠে নামে স্পেন। এরপর ২০২২ কাতার বিশ্বকাপগামী দলেও তাঁকে রাখেননি কোচ এনরিকে। ফলে ২০২১ সালে কসোভোর বিপক্ষে ম্যাচটাই হয়ে আছে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। ২০২৩ সালে জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন এই ডিফেন্ডার।
জাতীয় দলের হয়ে ১৮০ ম্যাচে মাঠে নেমেছেন। কেবল রক্ষণ সামলানো নয়, গোল করাতেও সমান পটু এই ডিফেন্ডার। লা রোহাদের হয়ে ২৩টি আন্তর্জাতিক গোল আছে তাঁর। স্পেনের হয়ে তাঁর চেয়ে বেশি ম্যাচে মাঠে নামেননি আর কেউই।
কেবল মাঠের ফুটবল নয়, স্পেন জাতীয় দলে রামোস স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর অদম্য মানসিকতার জন্য। ক্যারিয়ারের শুরুটা যতটা মসৃণ গতিতে এগিয়েছে, শেষভাগে ততটাই কঠিন হয়েছে। কিন্তু রামোস হাল ছাড়েননি, তিনি লড়ে গেছেন নিজের সবটুকু দিয়ে ঠিক প্রথম দিনটার মতোই।