অনুজ্জ্বল এক ক্রিকেট ভ্রমণ

করাচির মাঠের গ্যালারি একেবারে ঠাসা। মানুষের যেন পা ফেলার জায়গা নেই। কানায় কানায় পূর্ণ বলতে যা বোঝায় আরকি। তখন পাকিস্তানের ক্রিকেট হতো নিয়মিত। আর ম্যাচটা ছিল ভারত-পাকিস্তানের। তা অবশ্য এক যুগেরও বেশি আগের কথা। ২০০৪ সালের ১৩ মার্চের কথা। ভারত ব্যাটিং এ। বীরেন্দ্র শেবাগ দারুণ ফর্মে।

ইনিংসের শুরু থেকেই তুলো-ধুনো করছিলেন পাকিস্তানের গতি দানব শোয়েব আখতার থেকে শুরু করে মোহাম্মদ সামি ও রানা নাভিদ-উল-হাসানদের। কোন কিছুতেই যেন দমানো যাচ্ছিল না শেবাগকে। রান রেট দশের ঘর ছাড়িয়েছে।

পঞ্চাদশতম ওভারের দ্বিতীয় বলে নাভিদ-উল-হাসান নিজের ঝুলির এক মারণাস্ত্র দিয়ে কাবু করলেন শেবাগকে। স্লোয়ার বল। অসাধারণ স্লোয়ার বল। কিছুটা রুম বানিয়ে খেলতে গিয়ে বলের গতিতে পরাস্ত হয়ে সাজঘরে ফিরলেন বোল্ড হয়ে। কি বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং।

তবে এমন বুদ্ধিদীপ্ত বোলারের খেলোয়াড়ী জীবনটা আক্ষেপে ভরা। সংক্ষিপ্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ক্যারিয়ারে ক্রিকেট খেলবার শখ মিটিয়েছেন যাযাবর হয়ে। বছর কয়েক আগেও বিশ্বের নানা প্রান্তের ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট নিয়মিত খেলতে দেখা যেত নাভিদ-উল-হাসানকে।

১৯৯৩ সালের বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ হয়ে যখন পাকিস্তান ক্রিকেটের টালমাটাল এক পরিস্থিতি চলমান থাকা অবস্থায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন নাভিদ। ওয়াসিম আকরাম এবং ওয়াকার ইউনুসরা যখন অবসর নিয়ে নিলেন তখন গিয়ে দলে সুযোগ পেলেন নাভিদ। কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তাঁকে দারুণ এক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

বরাবরের মতোই পাকিস্তান ক্রিকেটের দ্রুত গতির পেস বোলারের অভাব কখনোই দেখা দেয়নি। অপরদিকে, খুব কার্যকরী স্লোয়ার অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও সেই দ্রুত গতিটা ছিল না নাভিদের। তাই হয়ত জাতীয় দলে আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে দিন পার করেছেন তিনি। থিতু হতে পারেননি কখনোই।

যদিও নাভিদের জাতীয় দলে থিতু হতে না পারার পেছনের অন্যতম কারণ হতে পারে তাঁর খরুচে স্বভাব। বেশ রান খরচা করতে তিনি নিজের ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে। তবে স্লোয়ারের পাশাপাশি দুই পাশে সুইং করাতেও নাভিদ ছিলেন বেশ পারদর্শী।

এছাড়া পুরান বলে রিভার্স সুইংটাও করাতে পারতেন নাভিদ। কিন্তু প্রতিযোগিতা ছাড়াও তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার খুব বেশি লম্বা না হওয়ার প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে উ-শৃঙ্খল আচারণ। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করাও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে তাঁর ক্যারিয়ারকে।

দলে আসা যাওয়ার মাঝেও ২০০৫-০৬ সালে বেশ কয়েকটা ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন নাভিদ। তবে সেখানেও কৃতিত্ব রয়েছে বাকিদের অফ ফর্ম কিংবা ইনজুরির। তবে বিশ ম্যাচের বেশ লম্বা একটা স্প্যানে তিনি গড়েছিলেন এক কীর্তি।

টানা ১৯ ম্যাচে এক কিংবা ততোধিক উইকেট নিয়েছেন এক নাগাড়ে। সেই সময়ে তাঁর ক্যারিয়ারের উইকেটের পরিসংখ্যানে এসেছে বড় পরিবর্তন। নিয়েছিলেন ৪৬টি উইকেট। যেখানে তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের উইকেট সংখ্যা ১১০। কিন্তু লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে তাঁর রয়েছে ২৮৭ উইকেট।

ওয়ানডেতে সুযোগ পেয়েছেন, খরুচে হলেও উইকেট নিয়েছেন। কিন্তু টেস্টে নাভিদের ক্যারিয়ার যেন একটা প্যামফ্লেটের সমান। মাত্র নয়টি টেস্টে পাকিস্তানকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। এত ক্ষুদ্র টেস্ট ক্যারিয়ার হবার কারণও বেশ যুক্তি সংগত।

টেস্টে খুব বেশি কার্যকরী ছিলেন না নাভিদ। ৫৮ গড়ে মাত্র ১৮ উইকেট নেওয়া বোলারকে তো আর দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ দেওয়া চলে না। এত সব নেতিবাচকতার ভীরে, সবচেয়ে ইতিবাচক দিক ছিল নাভিদের বোলিং অ্যাকশন। মসৃণ, নিখুঁত বোলিং অ্যাকশনের জন্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন তিনি।

ক্যারিয়ারের শেষ দিকে নাভিদ খেলেছেন বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) থেকে শুরু করে বিগ ব্যাশের মতো জনপ্রিয় টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টেও খেলেছেন তিনি। অথচ নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মোটে চারটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছিলেন নাভিদ।

সেখানে বিশের গড়ে নিয়েছিলেন মাত্র পাঁচটি উইকেট। অন্যদিকে, বিভিন্ন ঘরোয়া লিগে ১২৬ ম্যাচে নাভিদের উইকেট সংখ্যা ১৫৩টি। সেই বিশের গড়, ইকোনমি রেট সাতের ঘরের।

২০০৭ বিশ্বকাপে খারাপ খেলার পাশাপাশি ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগের খেলার জন্য দুই এক বছর করে দুইবার নিষেধাজ্ঞার মুখেও পড়েছিলেন নাভিদ। সব মিলিয়ে তাঁর ক্যারিয়ারটা হয়নি সুদীর্ঘ। তবে তিনি খেলেছেন ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস, ডার্বিশায়ার, সাসেক্স, ইয়োর্কশায়ার, তাসমানিয়া এ সকল কাউন্টি, বিপিএল, বিগ ব্যাশ দলে খেলছেন নাভিদ।

তবে প্রতিভাবান এই খেলোয়াড়ের সুদীর্ঘ হতে পারত আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। বিতর্ক এড়িয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার গুণাবলী তাঁকে একজন কিংবদন্তি বোলারে পরিণত করতে পারত। কিন্তু তিনি যে একজন উইকেট শিকারী বোলার ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে,  লম্বা দৌড়ের ঘোড়া হতে পারেননি।

একাই তো একবার গুড়িয়ে দিয়েছিলেন ভারতের ব্যাটিং লাইন আপকে। ২৭ রানে দিয়ে ছয় উইকেট শিকারই তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সেরা। নিভু নিভু করে জ্বলতে থাকা ক্যারিয়ারকে আর জ্বালানি সরবরাহ করতে না পেরে ভ্রমণকারী হয়েই  নিজের ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ার শেষ করলেন রানা নাভিদ-উল-হাসান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link