যে ছিল হৃদয়ের আঙিনায়

চাঁদের কলঙ্কের মতন স্পেনেও একটা কলঙ্ক আছে। সেটা হল রাউল গঞ্জালেজের কখনো ব্যালন ডি’অর জিততে না পারা। ১৬ বছর ধরে মাদ্রিদে খেলা এই ফুটবলারের কীর্তির শেষ নেই। মাদ্রিদের অন্য সেরারা ফিগো, জিদান, রোনালদো জিতে গেলেও ব্যালন ডি’অর স্পর্শ করা হয়নি রাউলের। কী সাংঘাতিক কলঙ্ক!

হয়তো কেউ না কেউ প্রত্যেকটা বছর রাউলের থেকে ব্যক্তিগতভাবে একটু বেশিই ভাল করে ফেলেছিল। এই সম্মানজনক অ্যাওয়ার্ডটা যদি পাঁচ বা দশ বছরে একবার করে দেয়া হত তাইলে রাউল গঞ্জালেজ ঠিকই জিততো। জোর করে পুরষ্কার দিয়ে দিচ্ছি আমি,না আমি কোনো মাদ্রিদ সমর্থক নই। নিতান্তই একজন ফুটবল উপভোগকারী। মাঝেমধ্যে এসব কলঙ্ক মুছে দিতে ইচ্ছে করে এই আর কি।

ফার্নান্দো হিয়েরো রাউলকে নিয়ে বলেছিল সে ফুটবলের প্রতিটা জায়গায় সাড়ে আট করে পাবে। রাউলের অদম্য ইচ্ছাশক্তি,হার না মানা মনোভাব এই সাড়ে আটকে দশে পরিণত করেছে নি:সন্দেহে। পরিসংখ্যান আমাকে অনেক বিরক্ত করে। তাও রাউলের জন্যে একটু খুঁজেছিলাম। রাউলের একটা কীর্তি আছে। সে ২০ গোল করে করেছিল ভিন্ন দশটি মৌসুমে।

ছয়টি লিগ, তিনটি চ্যাম্পিয়ন লিগ আর দুটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জয়ী রাউলের রিয়ালের হয়ে গোলসংখ্যা রেকর্ড ৩২৩ টি। যদিও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো নামক গোলদানব সেটি ভেঙে দেয়।

মানুষের জীবনটা আসলে বেশ অদ্ভুত। কখন যে কোনদিকে মোড় নিবে কেউ জানে না। এই যে রাউলের কথাই ধরুন। খেলেছিল রিয়ালের নগর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাটলেটিকোর যুবদলে। জাতীয় পর্যায়ে শিরোপাও আছে এদের হয়ে। কিন্তু অ্যাটলেটির তখনকার প্রেসিডেন্ট ক্লাবের খরচের পরিমান কমাতে ক্লাবের একাডেমি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সুযোগটা লুফে নেয় রিয়াল।

অ্যাটলেটিকো কেঁদেছে কি না পরবর্তীতে – সে বিষয়টা আন্দাজ করা যায়। রিয়ালের সি দলে শুরু হয় রাউলের রিয়াল ক্যারিয়ার। সাত ম্যাচে ১৬ গোল তাকে এনে দেয় ‘বি’ দলের ঠিকানা। এরপরে মূল দলেও আসা হয়ে গেল। বয়সটা তখনো তার ১৮ তে পৌঁছায়নি।

জারাগোজার বিরুদ্ধে অভিষেকে শূন্য হাতে ফিরতে হয় তাকে। কিন্তু, পরের ম্যাচেই অ্যাটলেটিকোকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কী ভুল করেছিল তারা। রাউলের গোল আর অ্যাসিস্টে রিয়ালের জয় ৪-২ এ। ফিরে তাকাতে হয়নি আর তাকে। জন্ম হয় নতুন এক তারকার।

ওই মৌসুমে ৩০ ম্যাচে ১০ গোল তাকে লা লিগার ব্রেকথ্রু স্টার বানিয়ে দিল। ১০ গোল বেশি কিছু মনে না হলেও তা কিন্তু মাদ্রিদকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল চার বছর ধরে লিগ শিরোপাকে নিজেদের করে নেয়া ক্রুইফের দল থেকে শিরোপা জেতাতে। স্টেফানোর আমলের পরে রিয়াল ভুলে গিয়েছিল ক্লাব ফুটবলের হলি গ্রেইল চ্যাম্পিয়ন লিগ জেতার কথা। ১৯৯৮ সালে রিয়াল আর রাউল সেটিও ছুঁয়ে ফেলে।

রিয়াল ছেড়ে শালকেতে চলে যায় রাউল। রিয়ালের হয়ে শেষ ম্যাচটাও খেলেছিলেন জারাগোজার বিপক্ষেই। ইনজুরিতে পুরো ম্যাচটা খেলা হয়ে উঠেনি সেদিন। ৫০ মিনিট খেলেছিলেন। রোনালদোকে দিয়ে গোল করিয়েছিলেন একটি। গোল নয় আসলে, মাদ্রিদের সম্মান হাতে দিয়ে গেলেন।

জার্মানিতে রাউল ছিলেন দু’বছর। বুড়ো হয়ে গেছেন বলে অনেকেই শোরগোল করেছিল। তাঁদেরকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে দুই মৌসুমে মোট ৪০ গোল করেন। ২০১০ থেকে ২০১২, দুই বছরের মধ্যেই গেলসেনকারচেনকে অনেক আপন করে নিয়েছিলেন।

বিদায়ের সময় ক্লাবও তাকে দিয়েছিল একেবারে দারুণ এক ফেয়ারওয়েল। রাউলের সম্মানে ক্লাবের সাত নাম্বার জার্সি তুলে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। অবশ্য পরবর্তীতে ২০১৩ সালে ম্যাক্স মায়ার নামক এক প্রডেজিকে রাউলের সাত নাম্বার জার্সি দেয় ক্লাব। কাতার-আমেরিকা হয়ে বুট জোড়া তুলে রেখেছেন ২০১৫ সালে।

অর্থনীতির জনক অ্যাডাম স্মিথ যখন ‘দ্য ওয়েলথ অফ ন্যাশন’ লিখেছিলেন তখন বইটি পাত্তা পায়নি কারো কাছেই।অথচ পরবর্তীতে এর প্রভাব সবার জীবনজুড়ে। ‘শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ যখন মুক্তি পেয়েছিল, ছবিটির স্থান হয়েছিল ফ্লপলিস্টে। এমনকি বলিউডের ‘শোলে’ ছবিটাই প্রথম সপ্তাহে হলে চলেনি। পরবর্তীতে সাফল্যের উচ্চপৃষ্ঠে উঠেছিল দু’টি ছবিই।

তেমনিও রাউল গঞ্জালেজের আমলে স্পেন জাতীয় দল তাদের সেরাটা কখনোই দিতে পারেনি। কিন্তু ২০০৬ বিশ্বকাপের পর থেকেই বিশ্ব ফুটবলে রাজত্ব করেছে স্পেনের টিকি-টাকা। অ্যাডাম স্মিথ-শশাঙ্ক রিডেম্পশন-শোলে-রাউল গঞ্জালেজরা আগেও সেরাই ছিলেন শুধুমাত্র সময়ের একটু হেরফের হয়েছিল। নাইলে জাভি-ইনিয়েস্তার সামনে খেলা রাউল করতেন অসম্ভব সবকিছুই।

আর্সেন আর আর্সেনাল ওয়েঙ্গার যেমন একই সূত্রে গাঁথা, তেমনি রাউল আর রিয়াল গঞ্জালেজও একই মায়ার বন্ধনে আটকে পড়া ভালোবাসা। রিয়ালকে রাউল থেকে কিংবা রাউলকে রিয়াল থেকে আলাদা করা অসম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link