মিউনিখের আকাশে যখন সন্ধ্যার নীলচে রঙ কালো হয়ে আসে, এলিয়াঞ্জ এরেনার আলোয় প্রতিপক্ষ দুই শহরের স্বপ্ন। এক পাশে ইন্টার মিলান, শতাব্দী পেরনো আভিজাত্যের প্রতীক, গাঢ় নীল-কালো বর্মে সাজানো। পুরনো দিনের শিরোপার ঘ্রাণ মেখে নেওয়া এক জমিদার, যার হাতে বংশের ধন, যার পিঠে ইতিহাসের ভার।
অন্যপাশে প্যারিস সেইন্ট জার্মেই, নব্য অভ্যাগত, যার চোখে কেবলই শূন্যতার বেদনা। একবারও এই চূড়ায় পৌঁছাতে না পারার দীর্ঘশ্বাস। তারুণ্যের দাপট, ব্যর্থতার ক্ষতচিহ্ন, আর বুকের ভেতর নোনা জলের প্রতিজ্ঞা – ‘এবার, এবার আমাদের হবে।’
এ লড়াই শুধু ‘ফিয়ারলেস ফুটবল’ বনাম জমাট রক্ষণের নয়। এ লড়াই দর্শনের, আত্মার, ভাগ্যের। একপাশে অভিজ্ঞতার পাথর-দেয়াল, অন্যপাশে তারুণ্যের উন্মত্ত নদী। এই লড়াই স্বীকৃতির।
১২ মিনিট, ভিতিনহা থেকে দুয়ে। দুয়ের সেই পাস যেন কবির প্রথম কলি, আড়ষ্টতা ভেঙে, জালের ফাঁক গলে বল আলতো ছুঁয়ে যায় হাকিমির পায়ের ছোঁয়ায়। গোল! প্যারিসের গ্যালারিতে তখন থমকে থাকা নিঃশ্বাস, দপদপ করতে থাকা হৃদয়, কেউ গুনছে ঘড়ির কাঁটা, কেউ চেয়ে আছে আকাশে। এবার কি হবে?
তারপর আসে সেই ঝড়ের ক্ষণ, দেজিরে দুয়ে যেন বারুদের লাইন ছুঁইয়ে দেন। একবার! দু’বার! ইন্টার মিলানের রক্ষণভাগ তখন ধ্বংসস্তূপের শহর। যে শহর একদিন গর্বে ফেটে পড়ত, আজ সেখানে পায়ের শব্দে ধুলো উড়ছে। আদুল গায়ে ছুটছেন দেজিরে দুয়ে। কে যেন গেয়ে গেল, ঐ নতুনের কেতন উড়িয়ে আসছে ‘কিংস অব ইউরোপ।’ কে গাইলো? ইতিহাস নাকি সভ্যতা?
৩-০, ৪-০, ৫-০। এলিয়াঞ্জ এরেনার আকাশে তখন প্যারিসের পতাকা উড়ছে। আর ইন্টার মিলান? সে তখন এক বৃদ্ধ জমিদার। কাঁপা হাতে ধরা সোনার পাঞ্জা, চোখের কোণে একফোঁটা লজ্জা। নতুন যুগকে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার বেদনা। সে জানে, আজকের রাত ইতিহাসের পাতায় নতুন নাম লেখার।
পিএসজি, যাদের একদিন সমালোচনা করত পুরো ইউরোপ, ‘তোমরা কখনো পারবে না’ বলে তির্যক হাসি ছুঁড়ে দিত। আজ তারা সেই হাসির ওপরে দাঁড়িয়ে, অভিজাত ক্লাবগুলোর দেয়ালে নিজস্ব রাজমুকুট আঁকছে। মেসি-নেইমার-এমবাপ্পে যা পারেন নি, তাই করছে লুইস এনরিকের সিস্টেম। এরা তো নতুন সুরে বাঁধা, নতুন রক্তে রাঙানো, ক্লাস অব ২০২৫।
রাত শেষে যখন শিরোপা উঁচু হলো, প্যারিসের আকাশে আলোর ফুলকি ছুটলো, তখন মনে হলো, এ শুধু একটা ম্যাচ নয়, এ এক প্রজন্মের জন্ম। আর সেই জন্মের গান ইউরোপের বাতাসে বাজবে বহু বছর।