ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে সেরা উইকেটরক্ষকের তালিকা করলে সবার উপরের দিকেই থাকবেন রিডলি জ্যাকবস। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী সময়ে উইকেটের পেছনে দলকে লম্বা সময় সার্ভিস দিয়েছেন তিনি। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই কিংবদন্তি উইকেটরক্ষকই কিনা একসময় নিজের টেকনিক আর কিপিং দক্ষতার কারণে ছিলেন উপেক্ষিত। আর এই উপেক্ষার কারণেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা দিতে পেরেছিলেন ২৭ বছর বয়সে এসে!
তর্কসাপেক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বকালের সেরা উইকেটকিপার জেফ ডুজন। এই ডুজনের অবসরের পর কিপিং কোটাটা কাকে দিয়ে পূরণ করা যায় সে নিয়েই ভাবনা-চিন্তায় ছিলেন নির্বাচকরা। অনেকের মুখেই একটি নাম শোনা গেলো। হ্যাঁ, রিডলি জ্যাকবস। ঘরোয়াতে তখন বেশ ভালোই খেলছিলেন তিনি। মনে মনে স্বপ্নও দেখছিলেন শূন্য কোটা পূরণ করে খেলবেন জাতীয় দলে। কিন্তু নির্বাচকদের মনে জায়গা করতে পারলেন না জ্যাকবস।
কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্ট জ্যাকবসকে দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘তাঁর ক্যাচ ধরার স্টাইল আনকোড় আর ব্যাটিং টেকনিক তো সবচেয়ে বাজে। একে দিয়ে চলবে না।’ সুযোগ পাননি জ্যাকবস। আরও দুই তরুন কোর্টনি ব্রাউন ও জুনিয়র মারেকে আনা হল শূন্য কোটা পূরনে। অনেকের মতেই জ্যাকবসের টেকনিক সবচেয়ে বেশি যেত বেসবল খেলার সাথে।
অন্য সব বাবা-মায়ের মতই জ্যাকবের মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে বড় কিছুই হবে। পাড়ার ক্রিকেটে বড়দের সাথে খেলার টুকটাক সুযোগ পেতেন, সেই সাথে নিজেও করতেন অনুশীলন। তবে কিপিং গ্লাভসটা পেয়েছিলেন আকস্মিক ভাবেই। প্রতিদিন স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে বিকেলে মাঠে অনুশীলনে যেতেন জ্যাকবস। সিনিয়রদের সাথে খেলতেনও মাঝেমধ্যে। বয়স তখন ১৭। একদিন সিনিয়রদের সাথে খেলায় সুযোগ পেলেন কিপিং করার। এরপর থেকে গ্লাভসকে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার সিঁড়ি হিসেবে নেন জ্যাকবস।
১৯৯২ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। এরপর চার বছর কেটে যায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা দিতে। একের পর এক প্রহর গুনেছেন জ্যাকবস। ২৯ বছর বয়সে এসে দেখা পান সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। ১৯৯৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষিক্ত হন তিনি।
সিরিজের চার ওয়ানডে খেললেও ব্যাট হাতে ছিলেন চরম ব্যর্থ। এরপর দু’জনের বছরের জন্য দল থেকে বাদ পড়লেন! ৩১ বছর বয়সে আবারও ফিরলেন রঙিন জার্সিতে। শুধু তাই নয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হলেন টেস্ট অভিষেক। যে সময়টা একজন ক্রিকেটার থাকেন নিজের প্রাইম টাইমে, সেখানে জ্যাকবস তখন মাত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন এক মুখ।
দেরীতে অভিষেক হলেও উইকেটের পেছনে দ্রুতই নিজের সামর্থ্যে দেখাতে শুরু করেন জ্যাকবস। ৯৯ এর বিশ্বকাপে করেছিলেন নজরকাঁড়া পারফরম্যান্স। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে দাঁড়াতেই পারছিলেন না ক্যারিবীয় ব্যাটাররা। সেই ম্যাচে ১৪৯ বলে ৪৯ রানের ধৈর্য্যশীল এক ইনিংস খেলেন তিনি। প্রথম ব্যাটার হিসেবে বিশ্বকাপে পুরো ইনিংসে ব্যাট করার কীর্তি গড়েন তিনি। ইতিহাসের চতুর্থ ব্যাটার হিসেবে এমন কীর্তিতে নাম লেখান জ্যাকবস।
২০০০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেলবোর্নে এক ইনিংসে সাত ক্যাচ শিকার করেন জ্যাকবস। টেস্টে ইতিহাসে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ক্যাচ শিকারে ওয়াসিম বারি, বব টেলর ও ইয়ান স্মিথের সাথে শীর্ষে আছেন জ্যাকবস। পরবর্তী বছর ২০০১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে শন পোলক, মাখায়া এনটিনি, অ্যালান ডোনাল্ডের সামনে ক্যারিয়ারে মেইডেন টেস্ট সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি।
২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রায়ান লারার সেই ঐতিহাসিক ৪০০ রানের ইনিংসে ৬ষ্ঠ উইকেটে জ্যাকবসের সাথে ২৮২ রানের জুটি গড়েন লারা। ওই জুটির পথে লারা দেখা পান ঐতিহাসিক ৪০০ ও জ্যাকবস গড়েন অসাধারণ এক সেঞ্চুরি।
এরপরই গুঞ্জন উঠছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড (ডব্লিউআইসি) চায় তরুণ কাউকে নিয়োগ দিতে। জ্যাকবসের বয়স তখন ৩৭! ব্যাট হাতে তখনও বেশ ভাল সাপোর্টই দিচ্ছিলেন দলকে। কিপিংয়েও ছিলেন অসাধারণ। তবে বোঝাই যাচ্ছিল এক সিরিজ খারাপ করলেই দল থেকে কাটা পড়বেন জ্যাকবস। ২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে হতাশাজনক পারফরম্যান্স তাঁর ক্যারিয়ারে ইতি টেনে দেয়। ওই বছরই বাদ পড়েন ওয়ানডে থেকেও।
৬৫ টেস্টে ২৮.৩১ গড়ে রান করেছেন ২৫৭৭। ১২ স্টাম্পিংয়ের সাথে ২০৭ ক্যাচও ধরেছেন নিজের ঝুলিতে। ১৪ হাফ সেঞ্চুরি আর ৩ সেঞ্চুরিও আছে জ্যাকবসের নামে। দেরীতে অভিষেক হলেও আট বছর ধরে ছিলেন দলের নিয়মিত মুখ। ১৪৭ ওয়ানডেতে ২৩.৩১ গড়ে ১৮৬৫ রান করেছেন তিনি। করেছেন ৯টি হাফ সেঞ্চুরি। গ্লাভস হাতে ১৬০ ক্যাচ আর ২৯ স্টাম্পিংস করেছেন জ্যাকবস। জেফ ডুজনের পরে দ্বিতীয় উইকেটরক্ষক হিসেবে টেস্টে ২০০ ডিসমিসাল করেছেন জ্যাকবস।
গড় বিবেচনায় নিলে তিনি যে খুব বিরাট কিছু করে ফেলেছেন এমনটা নয়। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপদের সময়ই ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ রান করেছেন জ্যাকবস। বিপদের দিনে তাঁর ব্যাট সব সময়ই ঢাল হিসেবে কাজ করেছে।