ভারতের ফিনিক্স পাখি

১.

সাল ২০০৭। আইসিসি প্রথমবারের মত আয়োজন করছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা অংশ নিয়েছিল হার্শেল গিবস, গ্রায়েম স্মিথ, এবি ডি ভিলিয়ার্স,  মার্ক বাউচার,  শন পোলক, মাখায়া এনটিনি,মর্নে মরকেল, এলবি মরকেলের মত খেলোয়াড়দের নিয়ে। উড়ন্ত সেই স্বাগতিক প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ভারতীয় ক্রিকেট দল নামিয়ে দিল ২০ বছরের এক যুবককে। এমনিতেই টালমাতাল ভারতীয় ক্রিকেট তখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দল পাঠিয়েছিল এক রকম জোর করেই, নতুন অধিনায়কের কাঁধে দায়িত্ব দিয়ে। সেই দলেই প্রথম রোহিত শর্মার অন্তর্ভুক্তি।

দক্ষিণ  আফ্রিকার সাথে ম্যাচ চলছে। আজকের সেরা ওপেনার সে সময় অগাধ প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রথমবারের মত নীল জার্সিটা গায়ে চাপিয়ে ব্যাট হাতে নেমে পড়েছে পাঁচ নম্বরে। শুরুটা যে একেবারে মন্দ হয়েছিল তা বলার উপায় নেই, মহেন্দ্র সিং ধোনির সাথেই তো মহা গুরুত্বপূর্ণ এক জুটি তৈরিতে সঙ্গ দিয়েছিলেন সে সময়ের ২০ বছর বয়সী রোহিত।

আরো পড়ুন

এখন রোহিত শর্মাকে ব্যাট হাতে আমরা হয়তো উদ্ভাবনী সব শটে গ্যালারি মাতিয়ে রাখতে দেখি, শুরুটা কিন্তু এমন ছিল না মোটেও। উদ্ভাবনী তো নয়ই, বরং সেই ম্যাচে রোহিতের খেলা সবগুলো শটই ছিল বড্ড বেশি গতানুগতিক। তবে সেই ম্যাচেও মহারাষ্ট্রের ২০ বছর বয়সী তরুণ নজর কেড়েছিলেন অন্য জায়গাতে। একে তো অভিষেকের চাপ, তার ওপর নেমেছেন পাঁচ নম্বরে, উইকেটে তখন খোদ অধিনায়ক, তাতেও রোহিতের শরীরি ভাষায় চাপের লেশমাত্র বোঝা যাচ্ছিল না।

ঠাণ্ডা মাথায় গ্যাপ শট খেলে যেভাবে সিঙ্গেল নিচ্ছিলেন তিনি, উইকেটের অপর প্রান্তে মহেন্দ্র সিং ধোনিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি তার দলের নবাগত সদস্যের প্রতি ঠিক কতটা প্রসন্ন হচ্ছেন। মূলত এই সিঙ্গেলের ফোয়ারাতে ধোনির সাথে রোহিতের পার্টনারশিপই ভারতকে সম্মানজনক স্কোর গড়তে সাহায্য করেছিল।

 

২.

শুরুটা করেছিলেন পাঁচ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে, কিন্তু মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে মোটেই ধারাবাহিক হতে পারছিলেন না রোহিত। সুন্দর শুরুর পর হারিয়ে ফেলছিলেন খেই, নামের পাশে বড় অঙ্কের দেখা মিলছিল না। এই কম রান দিয়ে কি আর ‘ব্লুজ’ দের দলে থাকা যায়? ফলাফল- দল থেকে ছিটকে পড়েন রোহিত।

অমিত সম্ভাবনা নিয়ে যার নীল জার্সিতে আসা, অভিষেকেই যে ঠাণ্ডা মাথায় দলের রান সম্মানজনক স্কোরে বাড়িয়ে নিতে অধিনায়ককে সঙ্গ দিয়েছেন, ভারতীয় ক্রিকেটের সমস্ত বিশ্লেষক যাকে বলে দিয়েছেন ক্রিকেটের ‘নেক্সট বিগ থিং’ – সেই রোহিত শর্মার বাদ পড়তেও সময় লাগেনি! ক্রিকেট কতটা নিষ্ঠুর, তাই না?

তবে ক্রিকেট যদি এতটা নিষ্ঠুর হয়ে থাকে, রোহিত শর্মা ঠিক ততটাই স্নিগ্ধ হয়ে ফিরে এসেছেন, নক্ষত্র হতেই! তবে এবার আর মিডল অর্ডারে নয়, ওপেনিংয়ে।

সাল ২০১৩,  আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। শিখর ধাওয়ানের সাথে রোহিত শর্মাকে সেবার প্রথমবারের মত ওপেনিংয়ে পাঠানো হয়। ইংলিশ কন্ডিশনে পাঁচ ম্যাচ খেলে রোহিত করেছিলেন ১৭৭ রান, যার মধ্যে দুটি ছিল পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস।  সেই টুর্নামেন্টে রোহিত শর্মাকে যারা দেখেছিলেন, তারাই স্বীকার করে নিয়েছিলেন, ওপেনিংয়ে বড় কিছুর বার্তা দিচ্ছেন রোহিত, এই পজিশনটাই আসলে তার জন্যে, তার খেলার ধরণের জন্যে!

এক প্রান্তে শিখর ধাওয়ান স্কিল আর রানের ফোয়ারা ছুটিয়ে নিজের ভান্ডারে রাখা শট খেলছেন, অন্য প্রান্তের রোহিত তখন বলকে গ্যালারিতে পাঠিয়ে খুশির তুবড়ি ছোটাচ্ছেন। তখন না জানলেও আমরা এখন জানি, ওপেনিং জোড়া হিসেবে রোহিত শর্মা আর শিখর ধাওয়ান ভারতীয় ক্রিকেটকে তারপর আর কত অর্জনে ভাসাবেন!

৩.

২০১৩ এর অক্টোবর। অস্ট্রেলিয়ার সাথে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডে। জয়পুরে সে ম্যাচে টসে জিতে অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ব্যাট করে ভারতকে টার্গেট দিয়েছিল ৩৬০! অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া সেই পাহাড় ডিঙিয়ে ভারতকে জয়ের বন্দরে পৌছে দিয়েছিলেন রোহিত, করেছিলেন ১২৩ বলে ১৪৪ রান।  বিরাট কোহলিকে সাথে নিয়ে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন  ছয় ওভার আগেই , মাত্র এক উইকেট হারিয়ে!

অক্টোবরের সেই সিরিজেরই সাত নম্বর ওয়ানডে! এবার টসে জিতে ভারতকে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। বেঙ্গালুরুর মাঠে অস্ট্রেলিয়ার ওয়াটসন,কোল্টার-নাইল, ফকনারে সাজানো বোলিং লাইনআপকে এক রকম মাটিতে নামিয়ে এনে ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলেন রোহিত। ১৫৮ বল, ২০৯ রান, স্ট্রাইক রেট ১৩২!

৪.

সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বেশ ভাল সময় কাটছে তখন। কিন্তু সাদা পোশাকে থিতু হতে পারছিলেন না তিনি। কিন্তু রোহিত শর্মা পারেন না, এমন কি কিছু আছে? সাদা পোশাককেও ঠিকই নিজের বশে নিয়ে এলেন এরপর। এমনিতে এটুকু বলতে দ্বিধা নেই, রোহিত শর্মার যে ব্যাটিং স্ট্যান্স, মানসিকতা কোনকিছুই সাদা পোশাকের সাথে মানানসই না। কিন্তু এরপরও ভারত বিশাখাপত্তমের সে ম্যাচে রোহিতকে নামিয়েছিল ওপেনিংয়ে।

খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে হচ্ছিল, তিনি পারবেন না। অন্তত টেস্ট ওপেনিং টা তো এত সহজ কাজ নয়। কিন্তু সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সে ম্যাচে খেলে ফেলেন ১৭৬ রানের দুর্দান্ত ইনিংস! সাদা পোশাকে নিজের সক্ষমতার শেষ জানান তিনি দিয়েছেন এই কিছুদিন আগেই, ইংল্যান্ডের সাথে ১৬১ রান করে!

এখন এই যে রোহিত শর্মা কোনভাবে একটা একশো করে ফেললেই সেটাকে দেড়শোতে নিয়ে যান, আবার সীমিত ওভারের ক্রিকেটে একটা ডাবল সেঞ্চুরি করতেই যেখানে একজন ব্যাটসম্যানের নাভিশ্বাস উঠে যায়, রোহিত সেখানে করেছেন একাই তিনটে। ঠিক কোন জিনিসটা রোহিতকে এত অনন্য বানিয়েছে, সবার থেকে আলাদা করেছে?

৫.

রোহিত শর্মার আজকের সফলতার বীজ লুকিয়ে আছে তার শুরুর দিনগুলিতে। ম্যাচের পর ম্যাচ তিনি খেলেছেন মিডল অর্ডারে। হয়তো এই জায়গাতে তখন এখনকার মত ভাল পারফর্ম করেননি, কিন্তু এই মিডল অর্ডারে খেলাটা তাকে সাহায্য করেছে আজকের রোহিত শর্মা হতে। কিভাবে?

আপনি যদি রোহিতের খেলা মনোযোগ দিয়ে দেখে থাকেন, তবে খেয়াল করবেন তিনি ডট বল দিতে একদমই ইচ্ছুক নন। কোন একটি বলে হয়তো বাউন্ডারি নেওয়া যাচ্ছেনা, রোহিত শর্মা সেই বলটিকে নিতান্তই ‘আনপ্লেয়েবল’ না হলে ছেড়ে দেন না, ডিফেন্স ও করেননা। গ্যাপ খুঁজে সেই বল থেকে সিংগেল নেওয়ার চেষ্টা করেন। আবার তিনি কিন্তু নেমেই শটের ফুলঝুরি হাঁকিয়ে রানকে মোটাসোটা করতে চান না।

তিনি সময় নেন, তবে সেই সময়ে বল খরচ করেন না। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানেরা যেভাবে নেমেই প্রতিটি বল থেকে অন্তত সিঙ্গেল নেওয়ার চেষ্টা করেন, রোহিত শর্মা একজন ওপেনার হয়েও সেটি করেন। আর এরপর উইকেটে যখন তিনি টিকে যান, ক্রিকেট ব্যাকরণের সব কয়টি সূত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একের পর এক শট খেলে চলেন।  এই যে শুরুর দিকে ডট না দেওয়া আর সেট হয়ে উইকেটের চারপাশে শট খেলা- এটিই রোহিত শর্মাকে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অন্যতম সেরা বানিয়ে দিচ্ছে।

উদাহরণ হিসেবে ২০১৭ তে ফেরা যাক। শ্রীলঙ্কার সাথে যে ম্যাচটিতে রোহিত শর্মা ডাবল সেঞ্চুরি(২০৮) করেন, সে ম্যাচে প্রথম ১০০ রান আসে ১১৫ বলে,  যেখানে পরের ১০০ তে রোহিত বল খরচ করেছেন মাত্র ৩৮ টি – ভাবা যায়!

৬.

সাদা পোশাকেও কিন্তু একই আদলে ব্যাপারটা অন্যভাবে ঘটছে। আর যাই হোক, তিনি তো আর চেতেশ্বর পূজারা নন। তাই একেবারে সলিড ডিফেন্স তিনি খেলেন না। কিন্তু ঐ যে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তিনি প্রত্যেকটি বল ব্যাটে লাগাতে পারেন, সেটা তাকে সাদা পোশাকেও আত্মবিশ্বাসী করছে। তিনি হয়তো সীমিত ওভারের ক্রিকেটের মত বলে বলে সিঙ্গেল নিচ্ছেন না, কিন্তু একজন ব্যাটসম্যান যখন প্রতিটি বল ব্যাটে লাগাতে পারেন সেটা যে তাকে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এতে কি কারো কোন সন্দেহ আছে?

  • ৭.

রোহিত শর্মার দুর্বলতাও আছে। ইনিংসের শুরু থেকে তিনি নড়বড়ে থাকেন,  অফ সাইডের বলে ব্যাট বাড়িয়ে দেওয়ার অভ্যাস রোহিত শর্মাকে ভুগিয়েছে অনেকবার, স্লিপ কর্ডনে ক্যাচ দিয়ে তিনি ফিরে গেছেন প্যাভিলিয়নে। কিন্তু শুরুর এই সময়টা কাটিয়ে উঠলে, ম্যাচের সময় গড়ালে রোহিত শর্মার খেলার চিত্রটাও পাল্টাতে থাকে। অজানা কোন উপায়ে আত্মবিশ্বাস ভরত করতে থাকে রোহিতের ওপর, বলের সাথে রোহিতের ব্যাটকে মনে হয় অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ।

রোহিত শর্মারাই আসলে ক্রিকেটের সত্যিকার সৌন্দর্য। তিনি ওয়ানডে ক্রিকেটে শচীন টেন্ডুলকারের মত নন, টি-টোয়েন্টিতে আন্দ্রে রাসেলের মত নন, আবার টেস্ট ক্রিকেটে চেতেশ্বর পূজারাও নন। কিন্তু তবুও এই তিন ফরম্যাটেই রান করে যাচ্ছে, স্কোর গড়ে যাচ্ছেন। এটাই আসলে সত্যিকারের ক্রিকেট। নিজেকে ছাপিয়ে, নিজের চারপাশে সবাইকে ছাপিয়ে নিজের মত করে ফুটে ওঠা সত্যিকারের সৌন্দর্য!

 

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link