‘কুৎসিৎ দর্শন খেলোয়াড়কে কখনো দলে নেয় না রিয়াল মাদ্রিদ’ – ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের রিজেকশন পেয়েছেন বহু বহু প্রথিতযশা খেলোয়াড়। কিন্তু অপমান সহ্য করতে হয়েছিল ব্রাজিলের পোর্তো আলেগ্রি শহরের দাঁতউঁচু ছেলেটাকে। ছাইচাপা আগুনকে উশকে দিয়ে যে ভুল পেরেজ করলেন তা হয়ত মাদ্রিদদূর্গের বড় এক ফাটলের বীজ বুনে দিয়েছিল। রোনালদিনহো গাউচো সংহার করলেন বার্নাব্যুতে, ভবিষ্যতে নিজের অসমাপ্ত কাজের ভার দিয়ে গেলেন রোজারিওর ছোট্ট লিওনেল মেসিকে।
সালটা ২০০৫। বিশ্বফুটবলে মেসি-রোনালদো যুগ শুরু হয় নি তখনও। আপামর ফুটবলপ্রেমী তখন মজে আছেন কাকা-জিদান-বেকহ্যামের স্কিলে। এদিকে ফুটবল দুনিয়ায় একচ্ছত্র রাজত্বের লক্ষ্য নিয়ে তখন দল গোছাতে শুরু করেছেন স্পেনের অন্যতম শক্তিধর ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের মালিক ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ।
দুরন্ত গ্যালিকটিকোসের লক্ষ্যে তিনি দলে সই করাতে লাগলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের। এই তালিকায় ঢুকে পড়লেন রোনালদো নাজারিও, রাউল, রবিনহো, রবার্তো কার্লোস, জিনেদিন জিদান সহ অনেকেই। কিন্তু, সারাবিশ্ব যখন অপেক্ষায় ছিল ব্রাজিলিয়ান জাদুকর রোনালদিনহোর মাদ্রিদে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে।
সে সময়ে পেরেজ শুধুমাত্র ‘আগলি লুকিং প্লেয়ার’ এই অজুহাতে তাঁর বদলে ডেভিড বেকহ্যামকে দলে নিলেন। এই ঘটনার পর মাদ্রিদের প্রবলতম প্রতিপক্ষ কাতালান ক্লাব বার্সেলোনা কিনে নেয় রোনালদিনহোকে। মাদ্রিদের অপমানের জবাব দিতে যেন একটা মঞ্চ খুঁজছিলেন তিনি, ১৯ নভেম্বর এল সেই সুযোগ।
লিগের ম্যাচে মাদ্রিদের দুর্গ স্যান্তিয়েগো বার্নাব্যুতে মুখোমুখি হল রিয়াল ও বার্সা। রিয়ালের অপরাজেয় দলে চাঁদের হাট। সেই তুলনায় সদ্য লা মাসিয়া একাডেমি থেকে উঠে আসা মেসি-ইনিয়েস্তা-জাভি দের নিয়ে গড়া তরুণ বার্সা ব্রিগেড ছিল কিছুটা ব্যাকফুটে।
আক্রমণভাগে অভিজ্ঞ স্যামুয়েল ইতো আর রোনালদিনহোকে রেখেই দল সাজিয়েছিলেন বার্সার ডাচ কোচ রাইকার্ড। ম্যাচের শুরু থেকেই আক্রমণের ঝড় তোলার চেষ্টা করে মাদ্রিদের জিদান-রোনালদো-বেকহ্যাম সম্বৃদ্ধ আক্রমণভাগ। অভিজ্ঞ কার্লোস পুয়োলের দক্ষতায় রক্ষণে লড়াই চালাতে থাকে কাতালান দলটি।
কিন্তু, ম্যাচের ১৫ মিনিটেই খেলার বিপরীতে ইতোর ডানপায়ের শটে মাদ্রিদের জালে বল জড়িয়ে যায়। বার্ণাবিউতে নিজেদের সম্মান রক্ষার পণ করে ফের আক্রমণে ঝাঁঝ বাড়ায় রিয়াল। এবার ম্যাচে নাটকীয়ভাবে রঙ বদলাতে শুরু করেন লাতিন আমেরিকার যুবরাজ রোনালদিনহো।
ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে রিয়ালের বিখ্যাত গ্যালাকটিকোসকে নিয়ে কার্যত ছেলেখেলা শুরু করেন তিনি। গাউচোর দুরন্ত স্কিলে ধরাশায়ী হতে থাকেন রামোস-কার্লোসের মতো কিংবদন্তি ডিফেন্ডাররা। ম্যাচের ৬০ মিনিটে এক দুরন্ত একক দৌড়ে মাদ্রিদ রক্ষণকে তছনছ করে নিজের প্রথম গোল করলেন তিনি – এই গোলের দৌড় যেন ছিল পৃথিবীর সমস্ত অপমানিত মানুষের হয়ে রোনালদিনহোর প্রতিশোধের দৌড়।
এরপর ৭০ মিনিটে মাদ্রিদ ডিফেন্সকে আরু একবার বোকা বানিয়ে নিজের দ্বিতীয় গোল করার পরই লেখা হল নতুন ইতিহাস। যে মাদ্রিদ একদিন কুৎসিত অপবাদে তাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁকে সেই মাদ্রিদের খাসতালুকেই ৮০ হাজার দর্শক দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালেন বিশ্ব ফুটবলের এই কিংবদন্তিকে।
আসলে রোনালদিনহোর সমস্ত নান্দনিকতা যেন দুপায়ের রঙিন তুলি দিয়ে সেদিন লেখা হয়েছিল বার্নাব্যুর সবুজ ঘাসে। মাদ্রিদ দম্ভে গাউচোর শিল্প হয়েছিল বার্সার ব্রহ্মাস্ত্র। নিজের ট্রেডমার্ক স্টাইলে তিনি ধ্বংস করলেন গ্যালাকটিকোসকে। বুঝিয়ে দিলেন গাউচোরা এ পৃথিবীতে বারে বারে ফিরে আসেন শিল্প আর ভালবাসার পসরা নিয়ে।