ওয়ানডে অভিষেক ঘাঁটলে উজ্জ্বলতাই ছড়াবে। দূর আকাশে জ্বলজ্বল করা তারার চেয়ে কোনো অংশেই কম না হওয়ার বার্তা দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের মাঠে। সাজঘর থেকে মাঠ পর্যন্ত পথ পাড়ি দিয়ে, দ্রুতগতির ইনিংস শেষে অপরাজিত মাঠ ছাড়া পর্যন্ত, সকল গতিবিধি লক্ষ করলে একটা শব্দই উচ্চারিত হয় — ‘ড্যাশিং’।
দলে টি-টোয়েন্টিতে ভরসা দেওয়ার মত ব্যাটসম্যান নেই, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) বদৌলতে সাব্বিরকে চিনলো সমর্থকদের মত নির্বাচকরাও। আগ্রাসী রূপেই এই ফরম্যাটের স্পেশালিষ্ট হিসেবেই তার আগমন দলে। টি-টোয়েন্টি অভিষেকের দিন ব্যাটিং বিপর্যয় সামলে নিতে দলের সংগ্রহ বাড়াতে তার ব্যাটিং ছিলো কচ্ছপ গতির। যদিও, দিনশেষে শেষ হাসিটা দলের কপালে না জুটলেও, সাব্বিরের ব্যাটিং কাজে দিয়েছিল।
এতো বললাম সাব্বিরের উঠে আসার গল্প। কিন্তু, পর্দার আড়ালে নিজের প্রতি নিজের অবহেলায় গেল কয়েকবছরে দেখা মিলেছে এক অচেনা সাব্বিরের। যার ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের ক্রিকেট থেকে দূরে আর কাছে আছেন জেলাভিত্তিক খ্যাপ ক্রিকেটে। ক্রিকেটেই ধ্যান-জ্ঞান তাই যেকোনো প্রান্তেই খেলতে যেতেই পারেন ক্রিকেট। আসল প্রশ্ন হলো — যার মূল ঠিকানা জাতীয় দল, সে কেন নিজেকে অবহেলায় ঠেলে দেয় খ্যাপ ক্রিকেটে?
২০১৬ এশিয়া কাপ সাব্বিরের ক্যারিয়ারের সেরা সময় নিঃসন্দেহে। দূর্দান্ত খেলে ভিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, তিলকারত্নে দিলশান, শহীদ আফ্রিদি ও শোয়েব মালিকদের পেছনে ফেলে হয়েছিলেন টূর্ণামেন্ট সেরা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫৪ বলে ৮০ রানের ইনিংসে যেন স্বপ্নেই বিভোর হয়েছিল দেশীয় সমর্থকরা। টি-টোয়েন্টিতে এমন চার-ছয়ের বৃষ্টি পূর্বে দেখাতে পারেনি বাংলাদেশ ক্রিকেটে আর কেউই।
দু:খের বিষয় — সাব্বির কোনো ফরম্যাটেই ধারাবাহিক ছিলেন না। হতাশ করেছেন বারংবার। তবুও, তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়া লোকের ঘাটতি নেই। এশিয়া কাপের ইনিংসের পর, ভারতের সাংবাদিকরা রীতিমত উঠেপড়ে লেগেছিল — সাব্বিরের মাঝে আইপিএল নিয়ে কোনো ভাবনা আছে কিনা তা জানতে। সাব্বির তখন মোটামুটি সাবলিল ছিলেন বলা চলে। আড়ালে করতে সফল হন নিজের আবেগকে। তারকা খ্যাতি গায়ে লাগলেও উত্তেজনা ধরা পড়েনি তখনও। তাই সাব্বিরকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা মানুষের তালিকাও হতে থাকে দীর্ঘ।
এসব তো গেল আলোর গল্প। আলোর পেছনে যে অন্ধকার থাকে, সে অন্ধকারে গা ঢাকা যায় সাব্বিরের। গায়ে রঙিন পোশাক আর চোখে রোদ-চশমা পরেও আর অন্ধকার ঠেলে আলোতে আসতে পারেননা। ব্যক্তিজীবন নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন, বিতর্ক ও অভিযোগ। জাতীয় দলের ক্রিকেটার বলেই কি ব্যক্তিজীবনে এমন স্বেচ্ছাচারিতায় ব্যস্ত ছিলেন অপার সম্ভাবনা জাগিয়ে দলে আসা সাব্বির?
এশিয়া কাপের পর বিপিএলে দূর্দান্ত এক শতক হাঁকিয়ে তাক লাগিয়ে দিলেও, এটাই ছিল প্রত্যাশিত। বিপত্তি ঘটালেন বিপিএল চলাকালীন নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে। বিপাকে ফেললেন ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদেরও। গুণতে হয় জরিমানা। যার পরিমাণ ১২ লক্ষ টাকা। এরপর অবশ্য সাব্বির ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় অস্বীকার করেন এবং ক্ষমাও চান। সে ঘটনা দ্রুতই আড়ালে চলে যায়। বিপিএল পরবর্তী কিউইদের মাঠে টি-টোয়েন্টিতে সাব্বিরের কোনো ঝলক দেখতে পায়নি বাংলাদেশ। তারপরেও আশা কমেনি সাব্বিরের উপর।
পরের বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চট্টগ্রামে দ্বিতীয় টেস্টে সাব্বিরের ১১৩ বলে ৬৬ রানের ইনিংস তাকে নিয়ে যায় দাঁড় করায় অনন্য উচ্চতায়। উপমা যোগ করে বললে — পরিস্থিতির চাহিদা মেটানো ব্যাটিং করেন সেদিন সাব্বির। দিনশেষে সাব্বিরের সুনাম করে নাথান লিঁও বলেন — ‘সাব্বির পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে ব্যাটিং করেছে, একদম ভিরাট কোহলির মত।’ সাব্বিরের গুণ গাইতে একবিন্দুও আপষ করেননি সেদিন নাথান লায়ন। সাব্বিরের খ্যাতি ছড়াতে শুরু করে দিগ্বিদিক। আর তাতেই ঘটে মূল বিপত্তি।
খ্যাতির ভার বইতে না পেরে নিজ কাঁধে বয়ে আনেন বিপদ। পতিত হন খ্যাতির বিড়ম্বনার ফাঁদে। অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপনে একের পর এক কুকীর্তির ইতিহাস বের হতে শুরু করে। নারী কেলেঙ্কারি ঘটনা ফলাও করে সামনে আসতে শুরু করে। ক্রিকেটাররা অল্পবয়সেই পেয়ে যান তারকাখ্যাতি। তাই আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা পেশাদারিত্বের অংশ। আবেগের বশীভূত হয়ে পড়লে হুমকির মুখে পড়তে পারে ক্যারিয়ার। সাব্বির পারেননি বলেই হুমকির ছাপ এখন পর্যন্ত লেগেই আছে।
তরুণ বয়সে ডিপিএলে সাব্বির নাকি সানিয়া মির্জাকেও গ্যালারিতে উত্যক্ত করেছিলেন ডিপিএল চলাকালীন। মোহামেডানের হয়ে খেলতে আসা সানিয়ার স্বামী শোয়েব মালিকের লিখিত অভিযোগে সাব্বিরকে পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করা হলেও, তিনদফা চিঠি দেওয়ার পর সাব্বির ধরা দেয় শুনানিতে। যেখানেও তার আচরণ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে সিসিডিএম। বলা চলে, আচরণে অসংযত সাব্বিরের বহু আগের বৈশিষ্ট্য। পরেরবছর ভিক্টোরিয়ার হয়ে ডিপিএল খেলতে এলে সাব্বির সমঝোতা করে নেন শোয়েব মালিকের সাথে।
বিতর্ক সাব্বিরের পিছু ছাড়েনা তাই সাব্বিরের গাড়ির ড্রাইভার দেন সাব্বিরের কুকীর্তির ব্যাপারে সাক্ষী। রাত করে বাড়ি ফেরা এবং ভিন্ন ভিন্ন নারী নিয়ে চলাচল। এক পর্যায়ে বাঁধা দিলে সেই ড্রাইভারের গায়েই হাত তোলেন সাব্বির। সবকিছুই অকপটে সাংবাদিকের ক্যামেরার সামনে স্বীকার করেন সাব্বিরের গাড়ির ড্রাইভার।
দর্শকদের চোখ বাঁকা হতে শুরু করে সাব্বিরের দিকে। ক্রমেই বনে যান বাংলাদেশ ক্রিকেটের ব্যাড বয়। আর সাদা বিড়ালের ন্যায় চোখেই সবকিছু ঘটিয়েও সমালোচনার জবাব দিয়ে শুধরানোর বুলি শোনাতে থাকেন সাব্বির। মাঠের বাইরে তার এমন উশৃংখল জীবনের প্রভাব মাঠে পড়েছে বহুবার। তাইতো অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলের জবাব দিতে ভড়কে যান। স্কয়ার কাট করতে গিয়ে ব্যাট হয়ে যায় স্লাইস। তাতেই ক্যাচ উঠে ছাড়তে হয় মাঠ।
ক্রিকেট গুরু নাজমুল আবেদীন ফাহিমও বলেছিলেন, ‘নিয়ন্ত্রণ না থাকলে বিপদ হবে। সাব্বিরের জীবন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় তার প্রভাব নিয়মিতই পড়ছে তার মাঠের পারফরম্যান্সে, একইসাথে দলও ভোগ করেছে।’
২০১৮ সালের শুরুতে জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ত্রি-দেশীয় সিরিজের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দশ উইকেটের পরাজয়ে বাকিদের কপালে যখন দুশ্চিন্তার ভাঁজ। তখনও খামখেয়ালিপনায় ব্যস্ত সাব্বির। রাত জেগে মেয়েদের ফেসবুকে গ্রুপে লাইভে এসে জবাব দিলেন ব্যক্তিজীবনের নারী বান্ধবী সংখ্যার।
ফিল্ডিংয়েই অফ-ফর্ম আসেনি কখনও সাব্বির। নইলে ব্যাটিংয়ের সময় স্লটে বল না পেলে ঝামেলা পোহাতে হয়। বিতর্ক পিছু ছাড়েনা, সেভাবেই পিছু ছাড়েনা অফ-ফর্মের মৌসুমও। ফর্মে ফেরার তাগিদ দিয়ে ঘরোয়া লীগে ফেরেন, সেখানেও আবার জন্ম দেন নতুন বিতর্কের। গ্যালারি থেকে এক শিশু ‘ক্যাটস আই’ বলে ডাক দিলে গ্যালারির পেছনে নিয়ে তাকে বেধড়ক মারধোর করেন। শিশুর গায়ে হাত তুলে বনে যান সারা দেশের কাছে ভিলেন। পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেন দেশের মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা।
ত্রিশ গজের ভেতরে মিড উইকেটে ফিল্ডার রেখে বাউন্সার করলে তাতেই কাটা পড়েন সাব্বির। ২০১৮ তে ঘরের মাঠে ত্রিদেশীয় সিরিজে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই আছে সে উদাহরণ। মাঠে নামেন বীরদর্পে আর আউট হয়ে ফিরে যান ব্যর্থ সৈনিকের বেশে। সাব্বিরের ক্রিকেটীয় কৌশল নিয়ে দ্বিমত নেই। কতশত পরিশ্রম সাব্বির করেন ফিরে আসার, কিন্তু সবকিছুই যায় নিস্ফলে। ফলাফল নেই, তাই সাব্বিরেরও দেখা নেই ২০১৯ এর পর জাতীয় দলে।
জাতীয় ছয়মাসের নিষেধাজ্ঞায় পড়েছিলেন। গুঞ্জন উঠে ড্রেসিংরুমে মিরাজকে চড়া লাগানোরও। বিতর্ক আর সাব্বির যেন হাতে হাত রেখে চলে প্রতিদিন। প্রাপ্তির খাতায় শুধরানোর সুযোগের পাল্লা ভারি। নেই পরিবর্তনের চিহ্ন। বারবার আশ্বাস দেন নতুন শুরুর কিংবা বদলে যাবার। কিন্তু, সাব্বির বদালননি। বেপরোয়া হয়েছেন দিনের পর দিন। অধিনায়কের চাওয়াতেই শাস্তি শিথিল হয় ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে। এবারের ডিপিএলে ইলিয়াস সানির প্রতি বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগে জরিমানা গুনেন আরেকবার। জাতীয় দলে না থাকলেও সাব্বিরের নামের সাথে বিতর্ক আর অফ-ফর্ম হাতে হাত রেখেই চলছে।
সাব্বিরকে টি-টোয়েন্টি স্পেশালিষ্ট বলায় একবার সাকিবই মুচকি হেসে বলেন — ‘ওর রেকর্ড তো বলেনা টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট।’ মুচকি হেসে সাকিব সত্য বলেছিলেন। সাব্বিরকে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে দলের সবচেয়ে দামি জায়গা ৩ নম্বরে ব্যাট করার সুযোগ দেওয়া হলেও ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হন।
আপাতত কেবল সাকিব নন! সাব্বিরের পারফরম্যান্সে অসন্তুষ্ট ভক্তকূলের সবাই। তাই দলের বাইরে অবস্থান করলেও তাকে মিস করেন খুব কম। তবে আক্ষেপের কমতি নেই সাব্বিরের জন্য। দেশের ক্রিকেটের বৃহৎ স্বার্থ বিবেচনায় আক্ষেপটা খুবই স্বাভাবিক। সাব্বির হওয়ার কথা ছিল দলের নির্ভরতার প্রতীক, সে সাব্বির করলেন নিজ প্রতিভার অপচয়। ক্যারিয়ারের শেষপ্রান্তে এখনও এসে না পৌঁছালেও, এভাবেই যদি থেকে যান তবে পারফরম্যান্সে নয় সাব্বির ড্যাশিং থাকবেন শুধুমাত্র তাঁর চেহারার জন্য।