শচীন টেন্ডুলকার দলের জন্য খেলেন না, রেকর্ডের জন্য খেলেন! সেঞ্চুরি করেছে ঠিকই, কিন্তু দলকে জিতিয়েছেন কয় ম্যাচে? – কথাগুলো প্রায়শই শোনা যায় বিভিন্ন ক্রিকেট আলোচনায়! শচীনকে আবার অনেকেই সেরা না মানার পক্ষে এই যুক্তিগুলো তুলে ধরেন।
এই অভিযোগ আর তার বাস্তবতার কথা ব্যাখ্যা করবো। সেঞ্চুরি করেও ভারতকে কেন জেতাতে পারেননি, অথবা হেরে যাবার পেছনে শচীন কতটা দায়ী সেটার কিছুটা ধারনা থাকবে নিচের আলোচনায়। আলোচনার ক্ষেত্র কেবলই ওয়ানডে ক্রিকেট।
একদিনের ক্রিকেটে শচীনের সেঞ্চুরি সংখ্যা ৪৯ টি। এর ভেতর ভারত ম্যাচ জিতেছে ৩৩ টি, হেরেছে ১৪ টি, বাকি দুটির ১ টি টাই এবং অন্যটি ড্র হয়েছে।
চলুন দেখে নেই, হেরে যাওয়া ১৪টি ম্যাচের সংক্ষিপ্ত চিত্র।
- প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা, ১৯৯৬ বিশ্বকাপ
প্রথমে ব্যাট করে ভারতের সংগ্রহ ছিল ২৭১/৩। শচীন করেছিলেন ১৩৭ বলে ১৩৭। অন্য ব্যাটসম্যানদের ভেতর শুধু আজাহারউদ্দিন ৫০ পেরিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কা ৪৯ তম ওভারেই তাড়া করে ফেলে। মনোজ প্রভাকর ৪ ওভারে ৪৭ রান দিয়ে উইকেট শুন্য থাকেন। অবশ্য ওপেন করতে নেমেও ৩৬ বলে ৭ রান করেছিলেন তিনি।
- প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, এপ্রিল ১৯৯৬
ভেন্যু ছিল সিঙ্গাপুরে। ১১১ বলে ১০০ করে শচীন যখন আউট হন তখন ভারতের রান ১৮৬/৪। এরপরও ভারত অলআউট হয় ৪৭তম ওভারে। রেইন ল তে পাকিস্তানের টার্গেট ছিল ৩৩ ওভারে ১৮৭, সহজেই তাড়া করে তাঁরা।
- প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা, আগস্ট ১৯৯৬
শচীন করেছিলেন ১৩৮ বলে ১১০। কিছুটা স্লো, তবে আজাহারের মত নয় নিশ্চয়ই। ৯৯ বলে ৫৮ রান করে মূলত আজাহারই রান রেটের রাশ টেনে রেখেছিলেন। ভারতের সংগ্রহ ছিল ২২৬/৫! ৪৫ তম ওভারেই সেটা চেইজ করে ফেলে লংকানরা মাত্র ১ উইকেট হারিয়ে। দলের পক্ষে দ্বিতীয় সেরা ইকোনমি নিয়ে বল করে সেই একমাত্র উইকেটটিও দখল করেন শচীন।
- প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, শারজাহ, ১৯৯৮
টার্গেট ছিল ২৭৬, ভারত শেষ করে ২৫০/৫! শচীন আউট হবার পর, শেষ ৩ ওভারে মাত্র ৮ রান করতে পেরেছিল ব্যাটসম্যানরা! ২৫০ এর ভেতর একাই ১৪৩, সেটাও ১৩১ বলে!
- প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা, অক্টোবর ২০০০
ভারত শেষ করে ২২৪/৮। একাই টেনেছেন শচীন, ১৪০ বলে ১০১ রানের পেছনে যুক্তি ছিল সাপোর্টের অভাব। অন্য কেউ ৫০ টাচ করেনি। শ্রীলঙ্কা সহজেই টপকে যায় এই টার্গেট। দলের দ্বিতীয় সেরা ইকোনমিক বোলার ছিলেন শচীন।
- প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে, ডিসেম্বর ২০০০
শচীন যখন আউট হন তখন ভারতের রান ২৩৫/৮। শচীনের নামের পাশে ১৪৬, বল খেলেছিলেন ১৫৩ টি। জহির খানের ক্যামিওতে ভারত ২৮৩ রানে পৌছে। জিম্বাবুয়ে ম্যাচ জিতে নেয় শেষ ওভারে ১ উইকেটে। শেষ ওভারে বল করেছিলেন কুম্বলে। ম্যাচে শচীনের ঝুলিতে ছিল একটি উইকেট।
- প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা, জোহানেসবার্গ ২০০১
শচীন যখন আউট হন তখন ভারতের রান ২৬৩। খেলেছিলেন ১২৯ বলে ১০১ রানের ইনিংস। ভারত থামে ২৭৯/৫। ম্যাচে তান্ডব চালিয়েছিলেন গাঙ্গুলি, ১২৬ বলে ১২৭! ৪৯ তম ওভারেই চেজ করে ফেলে সাউথ আফ্রিকা। আগারকারের পরে ইকনমির দিক থেকে শচীনই সেরা ছিলেন সেই ম্যাচে।
- প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, রাওয়ালপিন্ডি, মার্চ ২০০৪
ভারত ৩২৯ রান চেইজ করছিল সেদিন। ১৩৫ বলে ১৪১ করে শচীন যখন আউট হন তখন ভারতের প্রয়োজন ছিল ৬৮ বলে ৮৫, হাতে উইকেট ছিল ৬টি। ৮ বল হাতে রেখেই অলআউট হয় ভারত! অন্য কোন ব্যাটসম্যানই পঞ্চাশের দেখা পান নাই।
- প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, আহমেদাবাদ, এপ্রিল ২০০৫
৪৮ ওভারের ম্যাচে ভারতের সংগ্রহ ছিল ৩১৫/৬। শচীনের ১৩৯ বলে ১২৩, যথারীতি অন্য কোন ব্যাটসম্যান পঞ্চাশ স্পর্শ করেননি। পাকিস্তান সেটা চেজ করে ফেলে শেষ বলে। তিন পেসার মিলে ২৬ ওভারে দিয়েছিলেন ১৮৮ রান। শেষ ওভারে ৪ রান ডিফেন্ড করতে বল হাতে নিয়েছিলেন শচীন, শেষ বলে চার মেরে ম্যাচ জেতায় ইনজামাম।
- প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, পেশোয়ার, ফেব্রুয়ারি ২০০৬
শচীন যখন ১১৩ বলে ১০০ করে আউট হন তখন ভারতের স্কোর ছিল ৪৫ ওভারে ৩০৫/৫। সেখান থেকে ভারত অলআউট হয় ৩২৮ রানে! বৃষ্টির কারনে খেলা বন্ধ হবার সময়ে পাকিস্তানের সংগ্রহ ছিল ৪৭ ওভারে ৩১১/৭। খেলা আর মাঠে গড়ায়নি, ডিএল মেথডে জয়ী হয় পাকিস্তান!
- প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ, মালোয়েশিয়া, ২০০৬
শচীনের অপরাজিত ১৪১ রানে ভর করে ভারতের পুজি ছিল ৩০৫/৫। জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২০ ওভারে ১৪১/২ রানে থাকা অবস্থায় বৃষ্টি নামে! খেলা আর মাঠে না গড়ানোয় ডিএল মেথডে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।
- প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, হায়দ্রাবাদ ২০০৯
৩৫১ রান তাড়া করতে নেমে ভারত ম্যাচ হারে ৩ রানে। ১৪১ বলে ১৭৫ রান করে সব ধরনের চেস্টাই করেছিলেন শচীন। বাকি ব্যাটসম্যানরা ব্যস্ত ছিল শচীনের ব্যাটিং উপভোগ করাতে!
- প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা, নাগপুর ২০১১
ভারত অলআউট হয় ২৯৬ রানে। শচীন করেছিলেন ১০১ বলে ১১১ রান! ভারত শেষ ৩০ রানে ৯ উইকেট হারায়! দক্ষিণ আফ্রিকা তাড়া করে সহজেই।
- প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ, মিরপুর ২০১২
১৪৭ বলে ১১৪ রান করে আউট হন শচীন। ভারতের সংগ্রহ ছিল ২৮৯! পাঠান, অশোক ডিন্ডা, প্রবীন কুমারকে দিয়ে সাজানো বোলিং এটাককে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ ম্যাচ জিতে নেয় সহজেই। শততম সেঞ্চুরির ম্যাচে স্লো ব্যাটিংয়ের জন্য সমালোচিত হন শচীন, কিন্তু বোলারদের ব্যর্থতার কথা উঠে আসেনি সেভাবে!
ক্রিকেটে এমন সময় আসে, যখন একা হাতেই দলের জন্য প্রয়োজনীয় জয়টা তুলে আনা যায়। কিন্তু দিনশেষে এটি টিম গেইম! একা হাতের লড়াই তাই অনেক ক্ষেত্রেই সাফল্যের মুখ দেখে না। শচীনের সেঞ্চুরির ম্যাচে হেরে যাওয়াটা তাই বিস্ময়ের কিছু নয়, আবার জয়ী ম্যাচে তাঁর সেঞ্চুরিও একক অবদানের নয়। ভুলে গেলে চলবে না, একটা সময় ছিল যখন শচীনই ছিল ভারতীয় ব্যাটিংয়ের শেষ কথা। ক্রিজে তার উপস্থিতি ছিল ১০০ কোটি ভক্তের ভরসা, অপর প্রান্তের পার্টনারের জন্য অনুপ্রেরণা, ড্রেসিংরুমে বসে থাকা বাকি নয় জনের জন্য সাহস!
শেষ করছি লন্ডন টাইমসের জন উডককের একটি উক্তি দিয়ে, ‘আমি যাদের দেখেছি এই জীবনে, তাঁদের মধ্যে ওই সেরা। আর তোমরা অনেকেই যেটা পারোনি সেটা আমি পেরেছি, আমি ব্র্যাডম্যানকে দেখেছি।’