১৯৯০ সাল। বাবার চাকরি সুত্রে তখন ধানবাদে থাকি। সবে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছি। একদিন শুনলাম ধানবাদের কাছে ডিগবাডিহ স্টেডিয়ামে কপিল, শচীন সহ বেশ কয়েকজন ভারতীয় ক্রিকেটার একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে আসছে। ধানবাদ তো আর কলকাতা নয় যেখানে বছর বছর আন্তর্জাতিক ম্যাচ হবে। ওখানে এই ধরনের সুযোগ কালেভদ্রে আসে। তাই আমরা অর্থাৎ ক্রিকেট প্রেমী ছেলে-ছোকরারা বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। কিন্তু টিকিট কেটে ম্যাচ দেখতে যাবো – এইকথা তখন চিন্তাও করতে পারতাম না।
কিন্তু কপাল ভাল। জানতে পারলাম আমাদের প্রতিবেশী ভদ্রলোক স্পোর্টসের সঙ্গে যুক্ত কোনো ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন। মায়ের কাছে আমার উৎসাহের কথা জানতে পেরে কাকিমা একটা টিকিট জোগাড় করে দিলেন। খবরটা বন্ধুদের জানাবার জন্য ছুট দিলাম। দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কোনো বন্ধু টিকিট জোগাড় করে উঠতে পারলো না। কিন্তু এ তো কিছুই না। আসল দুর্ভাগ্য এই যে ম্যাচের আগের দিন রাত্রে আকাশ কালো করে ঝমাঝম বৃষ্টি নামল।
তার সঙ্গে মেঘের গর্জন। চেনাশোনা দেবদেবীদের প্রচুর ডাকলাম, কিন্তু কিচ্ছু ফল পেলাম না। শেষে নাস্তিক হওয়ার থ্রেট অব্দি দিলাম, তাতেও ভগবানেরা তেমন গা করলেন না। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বৃষ্টি বন্ধ হলেও আকাশের মুখ এখনও থমথমে। এবং পথ ঘাট কাদায় ভর্তি। কিন্তু টিকিট যখন আছে, মাঠে যাবোই। সঙ্গে ছাতাও নিলাম।
মাঠে গিয়ে দেখি বৃষ্টি, মেঘ, কাদা ইত্যাদি উপেক্ষা করেও গ্যালারি ভর্তি লোক এসেছে। এত মানুষ দেখে একটু ভরসা হোল। এতজনের আকুতি কি আর বরুণদেব উপেক্ষা করবেন? কিন্তু, মাঠের অবস্থা একেবারেই ভালো নয়। এই মাঠে পাড়ার ফুটবল খেলা যেতে পারে, ক্রিকেট কখনই নয়। তবে আশার কথা এই যে মেঘের পেছন থেকে সূর্যদেব মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে টুকি খেলছেন।
অবশেষে ঘোষণা হল যে ‘খেলা হবে’। তবে দুটো টিমের মধ্যে ম্যাচ হবে না, প্লেয়ারদের মধ্যে একটা সিঙ্গল উইকেট প্রতিযোগিতা হবে। চার ওভারে যে সবচেয়ে বেশি রান করতে পারবে সে জিতবে। আর প্রত্যেক বার আউট হলে সাত রান করে বাদ যাবে।
তাই সই। দর্শকদের তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ক্রিকেটাররা মাঠে ঢুকলেন। কপিল দেব, শচীন টেন্ডুলকার ছাড়াও রয়েছেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকর, যিনি কয়েক মাস আগে পাকিস্তানের মাটিতে অসাধারণ পারফর্ম করে গাভাস্কারের উত্তরসূরি রূপে চিহ্নিত হয়েছেন, এবং উইকেটকিপার কিরণ মোরে। তা এই মোরেও মাঝে মধ্যে একদিনের ম্যাচে ধুমধাড়াক্কা ‘ক্যামিও’ খেলার জন্যে বিখ্যাত ছিলেন। এদের সঙ্গে কিছু রঞ্জি স্তরের প্লেয়ার ছিল।
প্রথমে মাঞ্জরেকর নামলেন। শাস্ত্রসম্মত ব্যাটিং করে ইনি চার ওভারে ২৮ রান করলেন, একবারও আউট না হয়ে। তখনকার দিনে খুব খারাপ স্কোর নয়। কিন্তু তারপর কিরণ মোরে নেমে এই বেঞ্চমার্ক এক ধাক্কায় অনেকটা তুলে দিলেন। তিনি সম্ভবত বুঝে গেছিলেন কাদা মাঠে গ্রাউন্ড স্ট্রোক খেলে লাভ নেই। তাই তিনি ছক্কা মারার দিকে মন দিলেন এবং মাঠ ছোট হওয়ায় বেশ কয়েকটা মাঠের বাইরে গিয়ে পড়ল।
মোরে যখন ব্যাট ছাড়লেন তখন তার স্কোর ৬৩। অবশ্য একবার আউট হওয়ায় নেট স্কোর কমে দাঁড়ালো ৫৬। তবু চার ওভারের পক্ষে বিশাল স্কোর। শচীনের বলে স্ট্যাম্পড আউট হয়েছিলেন মোরে। মোরের ব্যাটিঙের সময় কপিল কিপিং করছিলেন। স্ট্যাম্পড আউট করার পর শচীন আর কপিলের যৌথ উল্লাস দেখে আমরা খুব আমোদ বোধ করলাম।
তবে বোলিং খুব একটা সিরিয়াসলি করছে না কেউ। কপিল পর্যন্ত মাত্র তিন চার পা ছুটে এসে হাফ ভলি দিচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছে বিনোদনই মুখ্য উদ্দেশ্য। অবশ্য ভেজা মাঠে ফুল রান আপ নিয়ে ছোটাও রিস্কি ছিল।
মোরের পর এবার শচীন নামলেন। ছোটখাটো চেহারার মৃদুভাষী এই ক্রিকেটার যে অলরেডি সাংঘাতিক জনপ্রিয় তা দর্শকদের হই হল্লা শুনে বোঝা গেল।
আগামী দিনে এই জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁবে। এতটাই যে ওপেনারদ্বয় বা রাহুল দ্রাবিড় আউট হলে দর্শকদের আনন্দের বহর দেখে বোঝা মুশকিল হবে যে খেলাটা কোন দেশের মাঠে হচ্ছে, দর্শকরাই বা কোন দলকে সমর্থন করছেন। শচীন ব্যাট করার সময় পথঘাট খালি হয়ে যাবে। এ বস্তু শেষ দেখা গেছিল দূরদর্শনে রামায়ন – মহাভারত সিরিয়াল চলাকালীন।
কয়েক মাস আগে কাদিরকে ঠেঙ্গানো যে ফ্লুক ছিল না তার প্রমান অচিরেই পাওয়া গেল। উইকেটের চতুর্দিকে স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছোটালেন সচিন। বেশ কয়েকটি ছক্কা গিয়ে পড়ল স্ট্যান্ডের মধ্যে। স্বীকার করতেই হোল ছোকরার রিষ্টের জোর আছে! শচীনের চতুর্থ অর্থাৎ শেষ ওভারে কপিল বল করতে এলেন। একটু আঁটসাঁট বোলিং করলে এখনও মোরে জিতে যেতে পারে। আমি মনে প্রানে চাইছিলাম আরও একটু ছুটে এসে কয়েকটি ইয়র্কার দিন কপিল। কপিল বনাম শচীনের লড়াইয়ের তবে না মজা!
অবশ্য সেরকম কিছু ঘটল না। উল্টে পরপর চারবার কপিলকে সীমানার ওপারে ফেললেন শচীন। চার ওভার শেষে তার স্কোর দাঁড়াল ৬৯। এখনও অব্দি লিডিং স্কোরার। তাতে আমার কিছু যায় আসে না, কিন্তু কপিলের এই হেনস্থায় বেশ মুষড়ে পড়লাম।
তবে কপিল নামতে বাকি ছিলেন। যে সময়ের কথা বলছি তখন তার সঙ্গে জনপ্রিয়তায় একমাত্র মুম্বাইয়ের জনৈক এংগ্রি ইয়ং ম্যান (তখন অবশ্য নট সো এংগ্রি এন্ড টায়ার্ড লুকিং মিডল এজেড ম্যান) পাল্লা দিতে পারতেন। আমাদের হৈ হল্লার মধ্যে শেষ অব্দি ৮৯ রান করে প্রতিযোগিতা জেতেন কপিল। আমি যে দারুণ খুশি সেটা আমার হাবভাবে প্রকাশ হয়ে থাকবে। বেরোবার পথে এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক আমার কাঁধে হাত রাখলেন, ‘উস ছোকরে পার ধ্যান রখনা। সিরফ সাত্রহ সাল মে হি সব কো হিলা দে রাহা হ্যায়।’
আমি ভাবলাম, দূর সাত্রহ সাল! সতের বছর তো কী হয়েছে? আগে দশ বছর খেলুক তারপর দেখব। আসলে তখন আমিও সতের। আরও একটা সতের বছরের ছেলেকে নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি সহ্য হচ্ছিল না।
এরপর অবশ্য শুধু আমিই নয়, পুরো বিশ্বক্রিকেট সেই ছোকরার দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়েছিল এবং সে আগামী কুড়ি-একুশ বছর ধরে সবাইকে হিলিয়ে অর্থাৎ নড়িয়ে দেওয়া জারি রেখেছিল। সুনীল গাভাস্কার এবং কপিলদেবের পাশে জায়গা করে নিয়েছিল ভারতের চিরশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার হওয়ার দৌড়ে।
এবং ব্রায়ান লারার পাশে সেই প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানের প্রতিযোগিতায়। একটা প্রজন্ম যাদের কাছে পরীক্ষায় সাফল্য নেই, চাকরী নেই, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ নেই, অলিম্পিকে মেডেল নেই, দুরন্ত ফাস্ট বোলার নেই, বিশ্বমানের স্পিনার নেই – তাদের সে বলার সুযোগ করে দিয়েছিল, অনেকটা সেই ‘মেরে পাস মা হ্যায়’র মতো – হামারে পাস শচীন হ্যায়।