আর্জেন্টিনা এবং মেসি সেসময় পার করছেন জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। টানা চার ফাইনাল হেরে মানসিকভাবে বিধবস্ত মেসি তো একবার অবসরের ঘোষণাই দিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেই সময়টাতে ত্রাতারূপে তাঁর আবির্ভাব, মেসিকে ফেরালেন।
ফেরালেন পুরনো আর্জেন্টিনার স্মৃতি, এক সুতোয় গাঁথলেন পুরো দলটাকে। নির্ভার মেসি খেললেন ক্যারিয়ারের সেরাটা, তাতেই আট বছর বাদে বিশ্বকাপের শেষ চারে আলবিসেলেস্তেরা। মেসির সেরাটা বের করে আনার পেছনের কারিগর আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি।
২০১৮ সালে যখন দায়িত্ব পান তখন আর্জেন্টিনা পথ হারানো এক দল। দলের সেরা তারকা মেসি হারিয়ে খুঁজছেন নিজেকে। তিনি ইউরোপের আনাচে কানাচে খুঁজে বেরিয়ে একঝাঁক তরুণ ফুটবলার তুলে আনলেন। লিওনেল মেসিকে কেন্দ্র করে গড়ে তুললেন বিধ্বংসী এক দল।
৩৫ বছর বয়সী মেসির এটাই শেষ বিশ্বকাপ। কাতার বিশ্বকাপকে মাতিয়ে রাখতে তাই চেষ্টার কমতি রাখছেন না। নকআউট পর্বে গোল না করার রেকর্ডও ভেঙেছেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে অজিদের বিপক্ষে এগিয়ে দেয়ার পাশাপাশি কোয়ার্টারে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও বল জালে জড়িয়েছেন। এখনো পর্যন্ত পাঁচ ম্যাচে চার গোল করে গোল্ডেন বুট জেতার দৌড়ে আছেন ভালোভাবেই।
কেবল গোল করা নয়, আর্জেন্টিনার প্রতিটি গোলের পেছনেই আছে মেসির অবদান। দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি সুযোগ সৃষ্টি করার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি সেটপিসও আদায় করেছেন মেসি। পুরো বিশ্বকাপের দলগুলোর মাঝে সর্বোচ্চ ৩৯ শট নিয়েছেন ক্ষুদে জাদুকর।
কোয়ার্টার ফাইনালে ডাচদের বিপক্ষে নাহুলের মলিনার গোলের কথাই ধরুন না। চার ডিফেন্ডারের মাঝখান দিয়ে যে পাসটা বাড়ালেন মেসি সেটা কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব। এছাড়া অধিনায়কের আর্মব্যান্ড হাতে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন সামনে থেকেই।
টাইব্রেকারে প্রথম শটে গোল করে পুরো দলের জয়ের সুরটা বেঁধে দিয়েছিলেন মেসিই। দশ গোল করে যৌথভাবে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার সাথে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার পক্ষে সর্বোচ্চ গোলদাতা এখন মেসি। সেমিতে সুযোগ আছে বাতিস্তুতাকে ছাড়িয়ে যাবার!
লিওনেল স্কালোনি ধীরে ধীরে সময় নিয়ে গড়ে তুলেছেন এই আর্জেন্টিনাকে। খেলোয়াড়দের সুযোগ দিয়েছেন, সময় দিয়েছেন দলের সাথে মানিয়ে নেবার। কৃতিত্ব পাবে আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনও, শুরুর দিকে ব্যর্থতার পরও স্কালোনির উপর ভরসা করার জন্য। ইতোমধ্যে ২০২৬ বিশ্বকাপ পর্যন্ত তাঁর সাথে চুক্তি বাড়িয়েছে ফুটবল ফেডারেশন।
২০১৮ বিশ্বকাপ শেষে জর্জে সাম্পাওলি সরে দাঁড়ানোর পর ডিয়েগো সিমিওনে, মরিসিও পচেত্তিনো, মার্সেলো গ্যালার্দোরা প্রত্যাখ্যাত করেছিলেন আর্জেন্টিনার কোচের চেয়ারে বসার প্রস্তাব। স্কালোনি ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন, মেসির সেরাটা বের করে এনেছেন।
আর্জেন্টিনার দীর্ঘ ২৮ বছরের শিরোপা খরা কাটিয়েছেন। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকা জিতিয়েছেন দলকে। ইতালিতে ৩-০ গোলে রীতিমতো বিধ্ববস্ত করে আর্জেন্টিনা জিতেছে কোপা ফাইনালেসিমা। টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত ছিল আর্জেন্টিনা।
কিন্তু এবারের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের কাছে হেরে খাদের কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। এরপরই শুরু হয় স্কালোনি-মেসি জুটির চমক, ফাইনালে পরিণত হওয়া প্রতিটি ম্যাচেই জিতেছে আর্জেন্টিনা। শেষ চারে উঠার লড়াইয়ে শ্বাসরুদ্ধকর এক ম্যাচে নেদারল্যান্ডসকে টাইব্রেকারে হারিয়েছে আলবিসেলেস্তেরা। শেষ চারে তাঁদের প্রতিপক্ষ ব্রাজিলকে হারানো ক্রোয়েশিয়া। মেসি-স্কালোনি জুটি চাইবে নিজেদের শেষটা বিশ্বকাপ জিতেই শেষ করতে।