গিলের ব্যাকফুট রহস্য

গ্যাবা টেস্টের পঞ্চম দিন। মিশেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্স কিংবা জশ হ্যাজেলউড এক বিন্দুও ছাড় দিচ্ছেন না। ডেলিভারি না, যেন ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিতে একেকটা আগুনের গোলা ধেয়ে আসছে। পরিস্কার বোঝা গেল, অজি পেসাররা দুই ভারতীয় ব্যাটসম্যান শুভমান গিল ও চেতেশ্বর পূজারার শরীর লক্ষ্য করে বল ছুড়ছেন।

সাহসী যোদ্ধা পূজারা একের পর এক আঘাত সামলালেন, এক-দুইটা নয় ১১ বার বল তাঁর শরীরে লাগলো। কামিন্সের বাউন্সার লাগলো হেলমেটে। খানিক বাদে আরেকটি বাউন্সার, এবার নেক প্রোটেক্টরটা ছিটকে গেল। বোলার এবার জশ হ্যাজেলউড।

মনে হচ্ছিল, সেটাই ম্যাচের সবচেয়ে বড় মোড় ঘুরানোর মুহূর্ত। আঘাতটা তখন পূজারার চাহনীতে স্পষ্ট। ব্যাটটা ছুড়ে মেরে, হেলমেট খুলে তিনি বসে পড়লেন মাঠে। এই সময় যে কেউ হাল ছেড়ে দেয়, কিন্তু তিনি তো পূজারা। মাঝপথে হাল ছাড়ার শিক্ষা তাঁর নেই। বিনা যুদ্ধে প্রাণ তিনি দিবেন না।

অন্য প্রান্তে গিল খুবই আরামসে মারাত্মক এই শর্টবলগুলো সামলে গেলেন। স্টার্কের একটা ওভারে ২০ রান তুললেন। বার্তাটা পরিস্কার, তুমি ইট মারলে পাটকেল হজম করার ঝুঁকি থাকবেই। পুল করলেন, হুক করলেন, কাট করলেন, ব্যাক ফুটে গিয়ে পাঞ্চ করলেন গিল।

মেলবোর্নে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অভিষেকের পর থেকেই গিলের ব্যাকফুটে এই দক্ষতা খুব প্রশংসিত হচ্ছে। ব্যাকফুট পাঞ্চটা তাঁর সিগনেচার শট। দেখে মনে হয় বলটাকে দেখে শুনে খেলতে তিনি একটু বাড়তি সময় পাচ্ছেন। আপার কাট কিংবা পুল – স্কয়ার অব দ্য উইকেটে গিলের যেকোনো শট দেখলেই মনে হয় যেন তিনি ক্রিকেট ডিকশনারির পাতা থেকে উঠে এসেছেন। পুরো সিরিজে যে তিনি ৫০-এর ওপর গড় নিয়ে ব্যাট করেছেন – তাতে এই ব্যাকফুটের অবদান কম নয়।

ব্যাকফুটে এই সাফল্যের রহস্যটা কি? জানালেন বাবা ও গিলের প্রথম কোচ লক্ষ্মীন্দর সিং। তিনি পেশাদার ক্রিকেটার ছিলেন না, তবে তাঁর ক্রিকেট জ্ঞান একালের যেকোনো নামকরা ক্রিকেট কোচের চেয়ে কম নয়।

তিনি বলেন, ‘শুভমান খুব তরুণ বয়স থেকে ক্রিকেটে আগ্রহী। এমনকি একদম ছোট বয়সে ওর প্রিয় খেলনা ছিল প্লাস্টিকের ক্রিকেট ব্যাট। ওর ক্রিকেটে আগ্রহ দেখে আমি নিজেই ওকে ক্রিকেট খেলাটা শেখাই।’

পাঞ্জাবের  ফাজিলকা জেলার ছোট্ট গ্রাম চাক খেরে ওয়ালাতে বড় হয়েছেন গিল। লক্ষ্মীন্দর নিজেও একটা সময় ক্রিকেটার হতে চাইতেন। কিন্তু, ছোট্ট গ্রাম থেকে দেখা তাঁর বড় স্বপ্ন পূর্ণতা পায়নি।

শুভগান গিলের জন্যও একই কারণে এই স্বপ্নপূরণ সহজ ছিল না। বাবা লক্ষ্মীন্দর বলেন, ‘আমাদের গ্রামটা মোহালি থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে। তাই, ওর জন্য আমরা মোহালিতে চলে আসি, যাতে ও ক্রিকেট খেলার সুযোগ পায়।’

শুভমানকে মোহালি ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করা হয়। যদিও, বাবা বসে থাকেননি। তিনি ছেলেন ফাস্ট বোলিং খেলার দক্ষতা বাড়ানোর চন্য নানা রকম কৌশল অবলম্বন করতে থাকেন। বিশেষ করে শর্ট বোলিং খেলতে ছেলে যেন সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন – এটায় ছিল তাঁর বিশেষ নজর।

তিনি বলেন, ‘ওর বয়স যখন নয় বছর তখন থেকে দিনে কমপক্ষে ১৫০০ শর্ট বল খেলতে দেই। আমি একটা চারপায়া ব্যবহার করতাম। ওটার ওপরে বলটা দিলে সেটার গতি বাড়তো, স্কিড করতো। মাঝে মাঝে ওকে শুধু একটা স্ট্যাম্প দিয়ে ব্যাটিং করতে দিতাম, এটাতে ওর জন্য ব্যাটের মাঝে বলের সাথে সংযোগ ঘটানো সহজ হত। এরপর ম্যাটিং উইকেটে আমরা অনেক সময় দিয়েছি। এই উইকেটে অনেক বেশি বাউন্স হয়। ম্যাটিং উইকেটে খেলতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে ব্যাকফুটে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলা সহজ হয়।’

আর একই সাথে মোহালি ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে পাঞ্জাবের সেরা পেসারদের মোকাবেলা করার সুযোগ পান গিল। সাথে বাড়িতে বাবা তো ছিলেন। এই দুই মিলেই তো আজকের গিল তৈরি হয়েছেন, যুব ক্রিকেট হয়ে এখন তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতের বড় সম্পদ হওয়ার পথে আছেন।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link