অফসাইড নির্ণয়ের নয়া প্রযুক্তি

২০১০ সালের আফ্রিকা বিশ্বকাপে রেফারির ভুলে বাতিল হয়ে গিয়েছিল ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের গোল। জার্মানির বিপক্ষে সেই গোল বাতিল না হলে হয়তো সেই বিশ্বকাপেরই ঘটনা অন্যরকম হতে পারতো। এছাড়া সমালোচনা হয়েছিল রিকার্ডো কাকার বিরুদ্ধে দেয়া সেই লাল কার্ডের সিদ্ধান্ত নিয়েও। বাধ্য হয়েই নড়েচড়ে বসতে হয় ফিফাকে।

আর এরপরেই বিতর্ক এড়াতে ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপেই ফিফা নিয়ে এসেছিলো গোল লাইন টেকনোলজি (জিএলটি)। এখানেই শেষ নয়, ফুটবল ম্যাচ পরিচালনাকে আরো নির্ভুল করতে ২০১৮ সালে রাশিয়া ফুটবল বিশ্বকাপে পরিচয় ঘটে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি(ভার)। আর এবার ২০২২ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে সেমি-অটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তি নিয়ে আসছে ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

২০১৪ সালে জিএলটি বা ২০১৮ সালের ভার এর পরে এখন ফুটবলে আরো নির্ভুল সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করতে প্রযুক্তির আরেকটি ব্যবহার দেখতে যাচ্ছে ফুটবল বিশ্ব। অফসাইড নির্ণয়ের নতুন সিস্টেমটি ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি এবং মাঠের রেফারিদের দ্রুত, আরো সঠিক এবং নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।

২২ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে কাতার বিশ্বকাপে সেমি-অটোমেটেড অফসাইড টেকনোলজি প্রবর্তন করা হবে। এবং ফিফা আশাবাদী যে বিশ্বকাপের পরেও এটি ব্যবহার করা অব্যাহত থাকবে। ফিফার প্রযুক্তি বিষয়ক উপ-পরিচালক জোহানমস হোলজমুলার নতুন এই সিস্টেমটি উপস্থাপন করেছিলেন।

বিশ্বকাপের ম্যাচ চলাকালীন স্টেডিয়ামের ছাদের নীচে স্থাপিত বারোটি ক্যামেরা বলের গতিবিধি লক্ষ্য করবে। এছাড়া যেহেতু হাত দিয়ে গোল করা যায় না তাই প্রতিটি খেলোয়াড়দের হাত ব্যাতিত শরীরের বাকি অংশ থেকে প্রতি মূহুর্তে ২৯টি ডেটা পয়েন্ট ক্যাপচার করবে ক্যামেরাগুলো।

এরপর প্রতি সেকেন্ডে পঞ্চাশ বার মাঠে তাদের সঠিক অবস্থান ভিডিও অ্যাসিস্ট রেফারির কাছে প্রেরন করবে। সংগৃহীত ডেটাগুলো একটি অ্যাকাউন্টে নেওয়া হয় যা অফসাইড নির্ণয়ের সময় বিশ্লেষণ করা হবে।  সেমি-অটোমেটেড প্রযুক্তির সুবিধার্থে ম্যাচে ব্যবহৃত অ্যাডিডাস বলের কেন্দ্রে একটি সেন্সর লাগিয়ে রাখা হবে, যা ভিডিও রুমে প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ বার ডেটা পাঠাবে। এটি সঠিকভাবে বলটি আঘাত করার ঠিক মুহুর্তটি সনাক্ত করতে সক্ষম হবে৷

বলে লাগানো সেন্সর এবং স্টেডিয়ামে থাকা বিশেষধর্মী ১২টি ক্যামেরাই আসলে পুরো সিস্টেমটির মূল অংশ। এখান থেকেই মূল কার্যক্রমের সবকিছু শুরু হবে। খেলোয়াড় এবং বলের কাছ থেকে প্রাপ্ত লিম্ব-ট্র্যাকিং ডেটা বিশ্লেষণ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে, অটোমেটেড প্রযুক্তিটি অফসাইড হওয়া মাত্রই ভিডিও রুমে সেই সংকেত দিবে৷

মূল রেফারিকে রিপোর্ট করার আগে অবশ্য ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারিরা ম্যানুয়ালি প্রদত্ত সংকেত যাচাই করে দেখবেন। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় প্রয়োজন হয় আর তাই প্রক্রিয়াটি দ্রুত এবং আরও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।

সেমি-অটোমেটেড টেকনোলজির বার্তাগুলো অফসাইড হওয়ার ঠিক কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সিস্টেম অপারেটরের কাছে পৌঁছে যাবে৷ এরপর একটি কমলা পতাকা দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অফসাইডের সিদ্ধান্ত মাঠে প্রদর্শন করা হবে। ভিডিও অপারেটররা সেই মুহূর্ত থেকে সবকিছু পরীক্ষা করে অবিলম্বে মূল রেফারিকে অবহিত করবেন।

আগে অফসাইড নির্নয়ের গড় সময় ছিল ৭০ সেকেন্ড। এছাড়া প্রযুক্তির পাশাপাশি রেফারির দক্ষতার উপরও নির্ভর করতো অফসাইডের নির্ভুলতা। এখন এই জটিল প্রযুক্তিতে অফসাইড নির্ণয়ে মাত্র ২৫ সেকেন্ড সময়ের প্রয়োজন হবে। এছাড়া অধিক নির্ভুলতাও আছেই। আবার যখন রেফারি সিদ্ধান্ত নিবেন, তখন দর্শকদের সুবিধার্থে পুরো ঘটনাটির রিপ্লে থ্রিডি অ্যানিমেশনসহ স্টেডিয়ামের স্ক্রিনে দেখানো হবে। এটি টিভিতেও ব্রডকাস্ট করা হবে।

পরীক্ষামূলকভাবে এই সেমি-অটোমেটেড প্রযুক্তির প্রয়োগ ২০১৯ সালে শুরু হয়েছিল। তবে কোভিড চলাকালীন এটির বিকাশ বিলম্বিত হয়। ২০২১ সালে পূর্নাঙ্গভাবে এটির পরীক্ষা শুরু করতে সক্ষম হয়েছিল সংশ্লিষ্টরা। এরপরই বিশ্বকাপে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফিফা।

নতুন এই প্রযুক্তির ব্যবহারে অফসাইডের সিদ্ধান্তগুলো নিঃসন্দেহে আরো সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য হবে। তাছাড়া ২৫ সেকেন্ড সময়কে আরেকটু কমিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহন দ্রুততর করার কাজ এখনো চলমান আছে। সাধারণ দর্শক এমনকি খেলোয়াড়রাও নতুন এই প্রযুক্তি ভালভাবে দেখতে পাননি। একসাথে হয়তো বিশ্ব মঞ্চেই দেখা মিলবে এটির। তখনই বোঝা যাবে আসলে কতটা কার্যকর সেমি-অটোমেটেড টেকনোলজি।

অবশ্য মাঠের মূল সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রধান রেফারিদেরই। সেমি অটোমেটেড পদ্ধতি শুধুমাত্র তখনই ব্যবহার করা হবে যখন অফসাইডে থাকা একজন খেলোয়াড় বল স্পর্শ করবে। অফসাইড ছাড়া বাকি সব সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রেও আগের মত নিয়মই দেখা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link