ক’দিন আগেই গণমাধ্যমের সামনে তিনি বললেন, ‘কাজ না করলে আমি পাগল হয়ে যাব।’
হ্যাঁ। ঠিক তাই। সাকিব আল হাসান তাঁর কাজ নিয়ে সব সময় ওয়াকিবহাল থাকেন। মাঠের ক্রিকেট কিংবা ব্র্যান্ড এন্ডোর্সমেন্ট- সাকিবের বিচরণ সবখানে। তবে কাজ অন্তঃপ্রাণ সাকিবের মূল কাজটাই যে বাইশ গজে, সেটি তিনি আবারো প্রমাণ করলেন মিরপুর টেস্টে। খেললেন ৮৭ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস। আর সেই ইনিংসেই ঘুরে দাঁড়াল বাংলাদেশ।
আগের দিন আইরিশদের ইনিংসের সময় বল হাতে তুলে নিয়েছিলেন ৬৬ তম ওভারে। লাল বলের ক্রিকেট ইতিহাসের বাংলাদেশের সেরা বোলার। তিনি কিনা গোটা এক ইনিংসে বল করলেন মাত্র ৩ ওভার! বল করা নিয়ে কেন এত কৃপণতা, তা নিয়ে কৌতূহল ছিল সবারই। আর নামটা যখন সাকিব, তখন অন্তরালের ঘটনা নিয়ে জল্পনা কল্পনা তুঙ্গে থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক।
তাইজুলের কন্ঠে একটা যুক্তি মিলল অবশ্য, ‘আমাদের তেমন কোনো কারণ বলেননি। হয়তোবা আমাদের দিয়ে বেশি বোলিং করানোর ইচ্ছা ছিল। আমরা খারাপ করলে হয়তো তিনি আসতেন।’
এই যে খারাপ করলে তিনি আসতেন – এখানেই যেন সব যৌক্তিকতা। দিনশেষে তা নির্জলা সত্যও বটে। আয়ারল্যান্ডের ২১৪ রানের বিপরীতে বাংলাদেশের শুরুটা হলো বড্ড মলিন। দ্বিতীয় দিনের সকালের শুরুতেই আবার মমিনুল হক আউট হয়ে ফিরে গেলেন। টপ অর্ডারদের হারিয়ে বাংলাদেশের স্কোর তখন ৩ উইকেটে ৪০!
ধুঁকতে থাকা এমন বাংলাদেশকে প্রাণ ফেরালেন সেই সাকিবই। আগের দিন দিন আলোচনায় ছিলেন মাঠে নিরব থাকা নিয়ে। এবার তিনি আলোচনার খোরাক মেটালেন ব্যাট হাতে সরব সাকিবের প্রত্যাবর্তনে।
প্রত্যাবর্তন কেন? ভারতের বিপক্ষে টেস্টেই তো একটা ফিফটি পেয়েছিলেন। প্রত্যাবর্তন এই অর্থে, আগের দিনে বল হাতে নিরব সাকিব এ দিন নিরবতা ভাঙলেন নিজের দুর্দান্ত ব্যাটিং দিয়ে। নির্লিপ্ত সাকিবের বিপ্লবী সুর এবার ভেসে আসলো নিজের উইলোর মাধ্যমে।
সময়ের ব্যবধানে টেস্ট ক্রিকেটের রঙ পাল্টে গিয়েছে। সেকেলে অ্যাপ্রোচের ব্যাটিংয়ের কার্যকারিতা এখন নেই বললেই চলে। যারা সফল হচ্ছেন তারা আক্রমণাত্বক মানসিকতাতেই দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ব্যাটারই তেমন সেই সংজ্ঞাটা মেনে চলেন না। বাস্তবতার বেড়াজালে, তাই কেউ দুরন্ত গতিতে ছুটতেও পারেন না। বিচ্ছিন্ন কিছু অর্জন, ঐ যা সাফল্য আরকি।
কিন্তু সাকিব তো বরাবরই ভিন্ন। স্রোতের প্রতিকূলে ভাসতে ভালোবাসেন। বিশ্ব ক্রিকেটের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাট হাতে নামার পরে সেই পথেই হাঁটলেন তিনি।
দল ৪০ রানে তিন উইকেট হারিয়ে তখন ব্যাটিং বিপর্যয়ে। কিন্তু সাকিব প্রতিরোধের জন্য বেছে নিলেন পাল্টা আক্রমণ। শুরু থেকেই নজর দিলে স্ট্রাইক রোটেশনের দিকে। এরপর কিছু সময় বাদে স্কোয়ার কাট, কাভার ড্রাইভ, পুল শটের মূর্ছনায় বাংলাদেশের ইনিংসে একটা গতি এনে দিলেন। নিজেও পৌঁছে গেলেন ক্যারিয়ারের ৩১ তম অর্ধ-শতকে।
ফিফটি পূরণ করলেন মাত্র ৪৫ বলে। এরপর সাকিবের সাবলীল ব্যাটে বাংলাদেশের ইনিংসও বেশ সংহত হলো। সাকিবও দুরন্ত গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন শতকের পথে। ২০১৭ এর পর আবারো টেস্টে সেঞ্চুরির একটা সম্ভাবনাও জাগিয়েছিলেন। কিন্তু, মিরপুরের গ্যালারিতে শেষ পর্যন্ত একটা আক্ষেপের গল্প লিখলেন সাকিব। এমন আক্ষেপে সাকিবকে যতটা না পোড়ায়, সম্ভবত তার চেয়ে বেশি সমর্থকদের আফসোসে ভাসায়।
ম্যাকব্রাইনের বলে উইকেটরক্ষকের কাছে ক্যাচ দিয়ে ৮৭ রানে ফেরেন সাকিব। সাকিবকে নিয়ে আক্ষেপে পুড়লেও বাংলাদেশের ইনিংসের ভিত্তি ততক্ষণে গড়ে দিয়েছেন সাকিব। এরই মাঝে আয়ারল্যান্ডের প্রথম ইনিংসের সংগ্রহ টপকানো হয়ে গিয়েছে। লিডের পথে পা দিয়েছে বাংলাদেশ।
সাকিবের স্বার্থকতা সম্ভবত এখানেই। তিন অঙ্কের ম্যাজিকাল ফিগার হয়তো ছুঁতে পারেননি। কিন্তু সাকিবের ঐ ইনিংসেই বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ধরে যার ছোঁয়ায় বাংলাদেশ দল এগিয়েছে, তার কাছে এ আর নতুন কি!
তবে সাকিবের এই ইনিংসটা একটা জবাবই দিল বটে। আগের দিনে অনেকের কাছেই বিস্ময়ের কারণ হয়েছেন, সমালোচিতও হয়েছেন টুকটাক। তবে এ দিনে এসে আরো একবার বিস্ময়ের জন্ম দিলেন। অফমুডে থাকা সাকিবের হঠাতই মুড অন! বল হাতে নিষ্ক্রিয় সাকিবের ব্যাট হাতে আগ্রাসন।
সাকিব পারেন বটে! এক দিনের ব্যবধানে সমালোচকদের ভাবনার পরিবর্তন আনতে পারেন। আবার হতশ্রী অবস্থা থেকে দলের চেহারাও বদলে ফেলতে পারেন। সেঞ্চুরি পেলে হয়তো একটা পূর্ণতা আসতো। তবে এটাই কি, নির্লিপ্ত সাকিবের বিপ্লবী প্রয়াস নয়? সাকিবের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়েই তো আইরিশরা খেই হারিয়েছে। হয়তো অধিনায়ক অ্যান্ড্রু বালবার্নির বাবা অ্যাশলি বালবার্নির মতো এখন তাদের মাঝে সেই একই আক্ষেপ, ইশ! সাকিবকে যদি দলে পেতাম!