সাকিব আল হাসানের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়ে অনিশ্চয়তা আর টানাপোড়েনের শেষটা যেভাবে হলো (যদি নতুন কোনো মোড় না নেয় আর কী), ক্রিকেটীয় সমীকরণের বাইরেও সেটির আরেকটি দিক আছে। আমাদের মতো দেশে, মেন্টাল হেলথ বা এই সংক্রান্ত ভাবনা-আলোচনা যেখানে বিশাল ট্যাবু, এটাকে যেভাবে হেসে উড়িয়ে দেওয়া হয়, সেটিই হয়তো আরও প্রতিষ্ঠিত হল।
মেন্টাল হেলথ ব্যাপারটি নিয়ে যারা হাসি-তামাশা করেন, ফালতু মনে করেন, তারা নতুন উপকরণ পেয়ে গেলেন। সাকিব ব্যাপারটিকে স্রেফ একটা কৌতুকে পরিণত করলেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) অপেশাদারিত্ব নিয়ে তো নতুন করে কিছু বলার নেই। দিনের পর দিন বলে আসছি। এবারের ঘটনায়ও হাজার হাজার শব্দ লেখা যায়। কিন্তু সাকিবের মতো একজন মহাতারকা, শুধু ক্রিকেট বা খেলাধুলা নয়, সব ক্ষেত্র মিলিয়েই হয়তো দেশের সবচেয়ে বড় তারকা ও একজন আইকন যখন ব্যাপারটিকে ছেলেখেলার পর্যায়ে নিয়ে যান, মেন্টাল হেলথ ব্যাপারটি তখন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে যায়। যাদের কাছে এটা ফাজলামো, তাদের জন্য পোয়াবারো।
গত বছর এপ্রিলে সাকিব ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) খেলতে যাওয়ার পর যখন কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন, তখন তার একটি ইন্টারভিউ করতে পেরেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, কোয়ারেন্টিনের বদ্ধ জীবনে থেকে তিনি ডিপ্রেশনে পড়ে গিয়েছিলেন। সেটির মাত্রা এতটা তীব্র ছিল যে মানুষ কোন পর্যায়ে গেলে আত্মহত্যা করে, সেটিও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি। এবং সেখানে হাস্যকর কোনো ব্যাপার ছিল না। মেন্টাল হেলথ ব্যাপারটি আসলেই এতটা গুরুতর ও গুরুত্বপূর্ণ।
সেই সাকিব যখন বলেন, শারীরিক ও মানসিকভাবে তিনি খেলার মতো অবস্থায় নেই, মাঠে তার নিজেকে প্যাঞ্জোর মনে হয়েছে এবং এই অবস্থায় মাঠে নামলে দেশের সঙ্গে গাদ্দারি ও সতীর্থদের সঙ্গে প্রতারণা হবে, তখন সেসব কথাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। যদিও দুনিয়াজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় পড়া অন্য বেশির ভাগ ক্রিকেটার ওই সময়টায় যেভাবে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন, একটা গন্ডিতে আবদ্ধ রেখেছেন, সবকিছুর আড়ালে চলে গেছেন, সাকিবের ক্ষেত্রে তেমন হয়নি।
তাঁর মানসিক অবস্থার প্রতিফলন অন্যান্য ক্ষেত্রে পড়েনি, মোহামেডানের প্রোগ্রামে যাওয়া, বিজ্ঞাপন, মাঠের বাইরের অন্যান্য অনেক কিছুই দৃশ্যত ছিল স্বাভাবিক। তবু মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তার দাবিকে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণ নেই। কারণ মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি বা ঘাটতির নানা প্রকারভেদ আছে। যার সমস্যা, কেবল তিনিই তা অনুভব করতে পারেন। হতে পারে, তার অন্য সবকিছুতে সমস্যা হচ্ছে না, মানসিক সমস্যা কেবল ক্রিকেট মাঠেই। হতেই পারে, কত রকমের মানসিক সমস্যাই তো আছে।
কিন্তু দুবাই থেকে দিন চারেক পর ফিরেই যদি তিনি বলেন, খেলতে কোনো সমস্যা নাই, তাহলে কিন্তু বড় সমস্যা! রোববার তিনি প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কথা বলেছেন, সপ্তাহ না ঘুরতেই এবার বলছেন, ‘আমি ভালো ভালো অবস্থায় আছি’, তখন আসলে মেন্টাল হেলথ ব্যাপারটি এই দেশে আরও হাসির খোরাক হয়ে ওঠে। এটা আর বিশ্বাসযোগ্য কিছু থাকে না। ভবিষ্যতে তিনি বা অন্য কোনো ক্রিকেটার সমস্যায় পড়লেও তখন বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাবে।
আসলেই তিনি কতটা স্বতস্ফূর্তভাবে খেলতে চেয়েছেন এই সফরে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। যদিও দুবাই থেকে বৃহস্পতিবার রাতে ফিরেই বোর্ডপ্রধানের সঙ্গে দেখা করা, পরদিন আবার ফোনালাপ এবং এবার বোর্ডে আরেক দফা সভা, সব কিছুতে বোঝা যাচ্ছে, সাকিব দক্ষিণ আফ্রিকায় যেতে মরিয়া এবং প্রবল তাড়না অনুভব করছেন।
কিন্তু তিনি যখন বললেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাছে গেলে হয়তো আরও তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে….’ এখানে প্রচ্ছন্ন খোঁচা বা কৌতুক যেমন আছে, তেমনি নানা ইঙ্গিতও আছে। কাজেই কতটা স্বেচ্ছায় তিনি যাচ্ছেন, সেই সংশয় থাকছেই।
এখানে সতিক্যারে তাড়না কতটা আছে, কতটা জোরাজুরির ব্যাপার আছে, ফেসবুকের ভাষায় চিপায় বা বাটে ফেলে দিয়ে রাজি করানোর ব্যাপার কতটা আছে কিংবা মোহামেডানের এক-দেড় কোটি টাকার হাতছানি কতটা আছে, অনুমাননির্ভর সেই সমীকরণে যেতে চাচ্ছি না। তিনি পেশাদার ক্রিকেটার, টাকা-বিজ্ঞাপন তার নিজের ব্যাপার। কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত, সাকিবের এই ঘটনায় মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব ব্যাপারটি প্রচণ্ড চোট পেল এবং স্রেফ খেলো হয়ে গেল।