ভারতের ক্রিকেট আঙ্গিনায় রীতিমতো হইচই ছড়িয়েই আবির্ভাব তাঁর। মুম্বাইয়ের অলিগলিতে রটে গিয়েছিল ফিরে এসেছেন শচীন। স্কুল ক্রিকেটে খেলেছিলেন ৫৪৬ রানের ইনিংস যা কিনা ১৯০১ সালের পর স্বীকৃত ম্যাচে ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।
কিন্তু, জাতীয় দলের পথচলাটা এতটা সহজ হয়নি, অভিষেকটা দ্রুত হলেও মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখতেও সময় লাগেনি। তবে এত সহজে হার মানবার পাত্র নন তিনি, লড়াই চালাচ্ছেন পুনরায় নীল জার্সিটা নিজের করে নেয়ার। তিনি পৃথ্বী শ, ওপেনিং এ ভারতের নতুন মোড়কে পুরনো আশা।
২০২০ সালে অ্যাডিলেডে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির ম্যাচেই শেষবারের মত ভারতের হয়ে লাল বলের ক্রিকেটে মাঠে নামেন শ। প্রথম বলের পরেই ধারাভাষ্যে থাকা রিকি পন্টিং খুঁত ধরেছিলেন শ’য়ের টেকনিকে, ‘কব্জির মোচড়ে শট খেলার সময় শ’র ব্যাট এবং প্যাডের মাঝে বেশ জায়গা রয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ান পেসাররা ওই ফাঁকা জায়গাকে টার্গেট করতে পারে।’
কমেন্ট্রি বক্সে পন্টিং কথা শেষ করার বলেই ঠিক একই ভঙ্গিমায় শ’র অফস্ট্যাম্প উড়িয়ে দেন মিশেল স্টার্ক। দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম বলে লেগগ্ল্যান্স করে অবশ্য উইকেটের প্রান্তবদল করেন শ। কামিন্সের এক বলে লং অফে ঠেলে নিয়েছিলেন তিন রানও। কিন্তু কামিন্সের চতুর্থ বলটাতে আর পারেননি, তাঁর ডিফেন্স ভেঙে স্ট্যাম্প গুড়িয়ে দেয় স্ট্যাম্প।
কোনো সন্দেহ ছাড়াই বিশ্বের অন্যতম সেরা পেসারদের তালিকায় উপরের দিকেই থাকবে কামিন্স-স্টার্কের নাম। তাঁর উপর নিজেদের পরিচিত কন্ডিশনে এই দুই পেসার হয়ে উঠতে পারেন অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু আপনি যদি সেরা হতে চান তবে তো সেরাদের সামলেই হতে হবে, তাই না?
অথচ ভারতের হয়ে কি অসাধারণ শুরুই না করেছিলেন শ। শুরুর তিন ইনিংসেই দেখা পেয়ে গিয়েছিলেন সেঞ্চুরি এবং হাফ সেঞ্চুরির। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই সিরিজের আগে নিউজিল্যান্ডের মাটিতেও ছিলেন দুরন্ত ফর্মে। ২৪.৫০ গড়ে এক ফিফটিতে সেই সফরে করেছিলেন ৯৮ রান। পরিসংখ্যান বিবেচনায় আহামরি মনে না হলেও আপনি চমকে যাবেন যখন জানবেন সেই সিরিজে মাত্র একবার ২০০ রান পার করতে পেরেছিল ভারত।
কিউইদের বিপক্ষে সেই সফরে একদিনের ক্রিকেটেও অভিষেক ঘটে তাঁর। প্রায় একশ ছুঁই ছুঁই স্ট্রাইক রেটে খেলেছিলেন ২০, ২৪ এবং ৪০ রানের কার্যকরী কিছু ইনিংস। এছাড়া শ্রীলংকা সফরকারী ভারতীয় দলের অংশ ছিলেন শ। মূল দল ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজে ব্যস্ত থাকায় সেবার লংকাপুরীতে দ্বিতীয় সারির দল পাঠিয়েছিল ভারত। ৪৩, ১৩ এবং ৪৯ রানের তিন ইনিংসে সেবার শেষ করেন লংকা সফর।
বিশেষ করে মনে রাখতে হবে প্রথম ম্যাচের কথা, ২৬৩ রান তাড়া করতে নেমে আক্রমণাত্নক ব্যাটিংয়ে লংকান বোলারদের এলোমেলো করে দিয়ে ভারতের জয়ের সুরটা বেঁধে দিয়েছিলেন তিনিই। ২৪ বলে ৪৩ রান করার পথে হাঁকিয়েছিলেন নয়টি চার। শিখর ধাওয়ান কিংবা ইশান কিষাণ তাঁর চেয়ে সে ম্যাচে বেশি রান করলেও ম্যাচসেরা হয়েছিলেন শ’ই। এ যেন এলেন, দেখলেন, জয় করলেন।
জাতীয় দলে আগমণের আগে থেকেই ঘরোয়া ক্রিকেটে রান বন্যা বইয়ে দেন শ। বিজয় হাজারে ট্রফিতে মুম্বাইকে ট্রফি জেতাতে ভূমিকা রাখেন সামনে থেকে। তাঁর করা এক আসরে ৮২৭ রানের রেকর্ড এখনও ভাঙতে পারেনি কেউই। আরেকটু পেছনে ফিরলে দেখা যায়, অনুর্ধব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে ভারতের জেতান ছোটদের বিশ্বসেরার খেতাব। কিন্তু পৃথিবীর পুরনো পথের রেখার মত, শ’য়ের ফর্মটাও ম্রিয়মান হয়েছে সময়ের সাথে সাথে। সমালোচকদের তীরে বিদ্ধ শ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিলেন জাতীয় দলের দৃশ্যপট থেকে।
এই সময়টাতে শ শরণাপন্ন হন দিল্লী ক্যাপিটালসের সহকারি কোচ প্রভীন আমরের, যিনি ছিলেন রিকি পন্টিংয়ের ডেপুটি। আমরের পূর্বের রেকর্ডও দুর্দান্ত, আজিংকা রাহানে থেকে রবিন উথাপ্পা সহ বহু ক্রিকেটারই দু:সময় কাটিয়ে উঠেছিলেন তাঁর আনুগত্যে। তিনি এবং ক্যাপিটালসের স্ট্রেংথ এন্ড কন্ডিশনিং কোচ রজনীকান্ত শিভাগনাম বুঝতে পেরেছিলেন শ’র সমস্যা, শুরুতে তাই কেবল তাঁর জন্য পাঁচ দিনের পরিকল্পনা সাজান সাদা বলের ক্রিকেটকে সামনে রেখে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিডিও বিশ্লেষণ করে বের করেন শ’র ফুটওয়ার্ক এবং শর্ট বলের দুর্বলতা। এরপর শুরু কঠোর ট্রেনিং, সকাল-বিকাল ফিটনেস ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি সারাদিন নেটে চলে ব্যাটিং প্রাকটিস। ফলশ্রুতিতে দ্রুতই পুরনো রূপে ফিরেছেন শ, ফিরেছেন আরও পরিণত, অভিজ্ঞ এবং বিধ্বংসী রূপেই।
২০২১ এবং ২০২২ আইপিএলে পাওয়ার প্লেতে দেখিয়েছেন ধবংসাত্নক ব্যাটিঙয়ের অসাধারণ চিত্রায়ণ। ১৫৭ স্ট্রাইকরেটে ব্যাট করে প্রতিপক্ষ বোলারদের উপর রীতিমতো ঝড় বইয়ে দিয়েছেন। কমপক্ষে ৫০০ বল খেলা ক্রিকেটারদের মাঝে আইপিএলে তাঁর স্ট্রাইক রেটই সর্বোচ্চ। রঞ্জি এবং দুলিপ ট্রফিতেও ছড়িয়েছেন রানের ফুলঝরি, ৫১ গড় আর ৮৬ স্ট্রাইক রেটে সংগ্রহ করেছেন ৬৭০ রান।
এই সময়টাতে লিস্ট এ ক্রিকেটে প্রায় ৫৬ গড়ে করেছেন প্রায় আড়াই হাজার রান। ক্রিকেট ইতিহাসে ৫০ এর বেশি গড় নিয়ে তাঁর চেয়ে দ্রুত গতিতে রান তুলেছেন মাত্র এক জন ব্যাটসম্যান, প্রোটিয়া কিংবদন্তি এবি ডি ভিলিয়ার্স। ফলে জাতীয় দলের দরজাটা আর দূরের পথ মন হচ্ছে না শ’য়ের জন্য। সামনের সিরিজগুলোতেই হয়তো ফিরবেন শ, ফিরবেন স্বরূপেই। নতুন শচীন নামের যথার্থতা তখনো তখনই প্রমাণ করবেন তিনি।