হাবিবুর রহমান সোহান, নিউ হার্ড হিটার ইন দ্য টাউন

খুলনা টাইগার্সের সেই অর্থে ম্যাচটা জেতার কোনো আশাই ছিল না। পুরো টুর্নামেন্টে দল হিসেবে যে গতিতে এগিয়েছে তারা, তাতে তখন ২৪ বলে ৫৪ রানের সমীকরণ মেলানো তখন বড্ড কঠিন। এমনিতে একেবারেই গুরুত্বহীন একটা ম্যাচ। ম্যাচের ফলের উপর পরিস্থিতি পাল্টানোর কোনো সুযোগ নেই। তবে মিরপুরে এমন ঝিমিয়ে যাওয়া মুহূর্তে হঠাৎ উদয় হলেন অজানা, অখ্যাত এক ব্যাটার হাবিবুর রহমান সোহান।

হাবিবুর রহমান সোহান ক্রিজে আসলেন। অজানা এই ক্রিকেটারের বয়স নিয়ে ঠিক তখনই এক প্রকার বিভ্রান্তি শুরু হল। ধারাভাষ্যে থাকা আমীর সোহেল বলে উঠলেন, থার্টি ফাইভ ইয়ার্স ওল্ড ক্রিকেটার। কোন হাবিবের সাথে তিনি কোন হাবিবকে মিলিয়ে ফেললেন, ততক্ষণে ম্যাচের প্রতি অনাগ্রহের কারণে সেখান থেকে দৃষ্টি সরে গিয়েছে।

কিন্তু, পরের দৃশ্যপট একাই যেন তৈরি করলেন এই হাবিবুর রহমান সোহান। ৯ টা বল খেললেন। তাতেই ২ চার আর ৩ ছক্কায় ৩০ রান। ব্যস। ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে ওখানেই ম্যাচটা জিতে গিয়েছে খুলনা টাইগার্স।

আর এরপরেই জানা গেল, আমীর সোহেল তাঁকে যে হাবিবুর রহমান সোহান বলে পরিচিত করিয়েছেন তিনি সেই সোহান নন। তিনি ২১ বছর বয়সী আরেক হাবিবুর রহমান সোহান।

বাংলাদেশি এক ব্যাটারের ব্যাটে ৩৩৩.৩৩ স্ট্রাইকরেটে ম্যাচজয়ী ক্যামিও। এমন চিত্রের দেখা মেলে না বললেই চলে। তাই ম্যাচ শেষের পরে নিশ্চিতভাবেই আলোচনা কিংবা বিস্ময়- সব কিছুর কেন্দ্রে চলে এসেছেন সোহান। কে এই ওয়ান্ডার বয়?

লিস্ট এ কিংবা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট- কোনো টাতেই এখন পর্যন্ত পা পড়েনি সোহানে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও (ডিপিএল) সুযোগ আসেনি। একদম সরাসরি বিপিএলে সুযোগ প্রাপ্তি। যার পেছনে অবদানটা খুলনার কোচ খালেদ মাহমুদ সুজনের। হাবিবুর রহমানকে হঠাতই মনে ধরে যায় তাঁর। তাই কোনো রকম সময় বিলম্ব না করেই দলে যুক্ত করে নেন তিনি।

তবে সুজনের সুনজরে পড়ার কাজটা হাবিবুর রহমান সোহান অবশ্য নিজেই করেছেন। গেল বারের প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে মাত্র ৪ টা ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। তাতেই ১ সেঞ্চুরি এবং ২ হাফ সেঞ্চুরিতে করেছিলেন ২৫০ রান। সোহানের এই পরিসংখ্যান আপনাকে আরো বিস্ময়ে ভাসাতে পারে, যখন শুনবেন এটা টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের টুর্নামেন্ট ছিল।

যেহেতু সীমিত ওভারের ক্রিকেট, তাই স্ট্রাইক রেটটাও এখানে বিবেচ্য বিষয়। অবাক করার মত ব্যাপার হল,  ৬২.৫০ গড়ে ব্যাটিং করা এ ব্যাটারের স্ট্রাইক রেট ছিল প্রায় ১৯০!(১৮৯.৩৯)।

টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের পর প্রথম বিভাগ ওয়ানডে টুর্নামেন্টেও সোহান দেখিয়েছেন তাঁর ব্যাটিং দ্যুতি। ৬ ম্যাচের পাঁচটাতেই পেয়েছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংসের দেখা। তাতে ৬৬.৫০ গড়ে সোহানের রান ৩৯৯! আর তাতে ব্যাটিং স্ট্রাইকরেট প্রায় ১৪৪!

হাবিবুর রহমান সোহানের বেড়ে ওঠা সিরাজগঞ্জে। নিজের মারমুখী ব্যাটিং দিয়ে প্রথম নজরে পড়েন রাজশাহীর এক লোকাল টুর্নামেন্টে। স্থানীয় টুর্নামেন্ট হলেও সেখানে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা সেরা পারফর্মাররাই খেলেছিলেন। এমনকি বিদেশি কিছু ক্রিকেটারও সে টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিল। তবে সবাইকে ছাপিয়ে এ টুর্নামেন্টে ব্যাট হাতে আধিপত্য দেখিয়েছিলেন ২১ বছর বয়সী এ তরুণ ব্যাটার।

রাজশাহীর সে টুর্নামেন্টের পর নজরে আসলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে সুযোগ পাননি। সুযোগ আসতে শুরু করলো কর্পোরেট ক্রিকেটে। কি মনে করে, সোহান সেই সুযোগ লুফে নিলেন। কর্পোরেট ক্রিকেটে প্রচুর ম্যাচ। ম্যাচের অভাব নেই। আর সেই ম্যাচ খেলার প্রস্তুতিই যেন সোহানকে আরো শাণিত করে তুললো।

ম্যাচ টেম্পারমেন্ট বোঝা শুরু করলেন। আর সেটার প্রতিফলন দেখালেন এবার বড় মঞ্চে। যে সময়ে অন্য ব্যাটাররা স্নায়ুচাপে খেই হারিয়ে ফেললেন, ঠিক সেই সময়েই সোহান মাথা ঠান্ডা রেখে পাওয়ার হিটিং করলেন। সোহানকে দেখে বুঝার উপায় নেই, স্বীকৃত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এটি দিয়ে মাত্র তৃতীয় ম্যাচে খেলতে নেমেছেন তিনি!

খুলনার হয়ে এ ম্যাচে ৬ নম্বরে ব্যাটে নেমেছিলেন সোহান। কিন্তু তিনি মূলত একজন টপ অর্ডার ব্যাটার। দারুণ পাওয়ার হিটিং করতে পারেন। সেটা এখন আগ বাড়িয়ে না বললেও বোধহয় হচ্ছে। তবে সোহানের ব্যাটিং সামর্থ্যের রূপটা কিন্তু একজন সলিড ব্যাটারের মতই। অগোছালো কোনো শট তিনি খেলেন না।

বাউন্ডারি মারলেও তাঁর ব্যাটে সেটি নান্দনিকতা সৃষ্টি করে। পাওয়ার হিটিং করেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর মধ্যেও ব্যাটিং ব্যকরণের সব রসদে পূর্ণ থাকে। হাই ব্যাকলিফটে ব্যাট করে থাকেন। আর সব সময়ে ক্ল্যাসিক একটা মুভমেন্টে থাকেন। অন, অফ- সকল প্রান্তেই স্ট্রোক খেলতে পারেন। তাই নজরে পড়তে বেশি সময় লাগেনি।

ক্রিকেট নিয়ে সোহানের স্বপ্নটা আকাশসম। দেশের হয়ে খেলতে চান অন্তত চারটি বিশ্বকাপ। এর মধ্যে একটি খুব করে জিততে চান। বাংলাদেশি ক্রিকেটারের মুখে এমন নির্দিষ্ট একটি চাওয়ার কথা কবেই বা শোনা গিয়েছে। সোহান তাঁর ব্যাটিং এর মতই যেন অফ দ্য ফিল্ডেও বেশ পরিণত।

সোহান তাই তাঁর স্বপ্নের পথেই এগিয়ে যাক। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলুক তাঁর পথচলা। সমস্ত আগ্রাসন জিইয়ে রাখুক লাল সবুজের জার্সির জন্য। বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলে এমন আগ্রাসী সোহানদেরই তো প্রয়োজন।

 

 

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link