সেভাবে দেখতে গেলে বলা যায়, মৃত্যুর পরে লেগ্যাসিটা অ্যাকচুয়ালি শুরু হয়। কারণ আর কিছুই নয়, বিখ্যাত মানুষের মূর্তি তৈরিতে মনে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। আদতে অনেকেই মনে রাখে না। অথচ ভারতবর্ষের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে সুবিমল গোস্বামীকে সে যন্ত্রণা পোহাতে হয়নি।
তারা খসে পড়ার বহু আগে সে তারা উজ্জ্বল। সুবিমল গোস্বামী চাননি, চলে যাওয়ার পর তাঁর নশ্বর দেহ নিয়ে শোভাযাত্রা হোক। আর সেটা হয়ও নি। কোভিডে ছেয়ে যাওয়া সময়ের মাঝেই তাঁর নিশ্চুপ প্রস্থান। একেবারে সুপারস্টারের মতোই। সকালে আয়েসে চা পান করে রাতের মধ্যে ক্রিজ থেকে আউট! অভিনব বিদায়।
এবং তাই হওয়ার ছিল। সুবিমল গোস্বামী গোড়া থেকেই সুপারস্টার। অনেকে অনেক পরে এই আখ্যা পায়। চুনী গোস্বামী ওরফে সুবিমল গোস্বামী এগারো বছর বয়স থেকেই সুপারস্টার। তৎকালীন মোহনবাগান কোচ বলাইদাস চ্যাটার্জির হাতে তৈরি জিনিয়াস। মোহনবাগানের হয়ে সিনিয়র টিমে ডেবিউ করার আগেই জুনিয়র টিমে দাপিয়ে খেলেছেন এবং গোল করেছেন অগুনতি। এই পারফরমেন্স সিনিয়র টিমে জায়গা করার জন্য যথেষ্ট।
অথচ বলাইদাস চ্যাটার্জির ইশারায় চুনী গোস্বামী সিনিয়র টিমের জার্সি পরে বসেছিলেন, বদ্রু ব্যানার্জির জায়গায় খেলবেন বলে। তখন মোহনবাগান টিমের একটা সংস্কার ছিল, আগে বুট প’রে তারপর জার্সি গায়ে চড়ানো। সাবস্টিটিউশনের কোনও ব্যাপার ছিল না। সেখানে চুনী আগেই জার্সি প’রে বসে থাকায় কোচ বাধ্য হলেন বদ্রু ব্যানার্জির জায়গায় খেলাতে। চুনী খেললেন, এবং গোল করে দলকে জেতালেন।
অথচ এই সুপারস্টারের জন্ম আটকে যেত মুড়ির বাঁকা পথের পাশে থাকা খাদের তলায়। রামকৃষ্ণ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলতে যাওয়া চুনী এবং জামশেদপুরের একটি টিমের হয়ে খেলতে যাওয়া পিকে তখন একই সঙ্গে একটি বাসে মুড়ির পথে রওনা হয়েছেন। হঠাৎ বাসটা একটা পাথরে ধাক্কা মারে! ভারতের আকাশে সবেমাত্র উত্থান ঘটানো পিকে-চুনীর সেখানেই অন্ত ঘোষিত হতো, যদি বাসটা খাদের অতলে তলিয়ে যেত। বিধাতার অসীম করুণা, তা হয়নি। ভারতবর্ষের ফুটবল ইতিহাসে দুই কিংবদন্তীর জয়গাথা লেখার জন্যই সেদিন সবচেয়ে বড় অঘটনটা হতে হতেও, হয়নি।
এরপর চুনী দাপিয়ে খেলছেন মোহনবাগানে। গুণীজনেরা বারে বারে বহু পত্রপত্রিকায় মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করেছেন চুনীর ডান পা’টা নিয়ে। বিপক্ষের পায়ের জঙ্গলে মাঝেও তাঁর ডান পা ঠিক গ্যাপ খুঁজে নিত। এককথায়, জাদু ছিল তাঁর ডান পায়ে। বাঁ পায়ে হোল্ডিংয়ের প্রশ্নই নেই, সুতরাং জায়গা রাইট ইনে। সেন্টার মিডফিল্ডারের ডানপাশে একটু উপরে।
বল নিয়ে চমৎকার ড্রিবল করে বিপক্ষের বক্সে ঢুকে জালে জড়াতেন। এই অসাধারণ ফুটবলশৈলীর সবচেয়ে বড় প্রদর্শন ঘটল ১৯৬২’র জাকার্তা এশিয়াডে। যেখানে ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন চুনী, ভাইস ক্যাপ্টেন পিকে। সঙ্গে তুলসীদাস বলরাম, জার্নেল সিং, অরুময় নৈগম, প্রশান্ত সিনহা সহ গোলকিপার থঙ্গরাজ। ক্যাপ্টেন চুনীর অসাধারণ গেম প্লে এবং পিকের গোল, জার্নেল সিংয়ের ডিফেন্সিভ স্ক্রিন হিসেবে পারফরমেন্স গোটা ভারতীয় দলের মনোমুগ্ধকর জয়ের ইতিহাস।
চুনী গোস্বামীকে কোনও একটা প্যারামিটারে ফেলে মাপা যাবে না। আদতে ভারতবর্ষের ক্রীড়া ইতিহাসে এরকম ক্ষণজন্মা বোধহয় খুব কমই এসেছে। ফুটবল ছেড়ে ক্রিকেট, তারপর টেনিস, হকিতে বেটন কাপ। সব খেলেছেন চুটিয়ে। পিকে কোচ থাকাকালীন চুনী এসেছিলেন তাঁর শেষ ম্যাচ খেলতে। টিম মিটিংয়ে পিকে বলে দিচ্ছেন কোন পজিশনে কে খেলবে, ছক তৈরি চলছে।
চুনী ঢুকলেন এবং বললেন প্রথম থেকে খেলবেন। ফরোয়ার্ডে। পিকে অনিচ্ছা সত্বেও নামালেন। প্রথমার্ধ যখন শেষের দিকে, তখন রাইট উইং থেকে মাঝখানে একটা বল পেলেন চুনী, এবং দুটো ফুলব্যাকের মাঝখান থেকে শটটা মারলেন। অবধারিত গোল। মাঠ থেকে ফিরে বন্ধুকে বললেন, ‘কী বলেছিলাম?’
এই পিকেই ৬২’র ক্যাম্পে রাতে হাঁটতে হাঁটতে চুনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘তুই ক্যাপ্টেন হয়েছিস, আমি ভীষণ খুশি।’ আসলে পিকের ক্যাপ্টেন হওয়ার স্বপ্ন ঘুচে গিয়েছিল আজন্ম ইস্টার্ন রেলে খেলার দৌলতে। তখন একটি অলিখিত প্রথা ছিল, ভারতবর্ষের প্রথিতযশা ক্লাবে না খেললে জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন হওয়া যাবে না।
মোহনবাগানের হয়ে খেলার সুবাদে এই সুযোগটা চুনী পেয়েছিলেন। প্রথমচোটে অখুশী হয়েও পরে প্রিয়তম বন্ধুকে তাই জড়িয়ে ধরেছিলেন পিকে। জাকার্তা এশিয়াডের পর রহিম সাহেবের চলে যাওয়া অনেকটা নড়িয়ে দিয়েছিল ভারতীয় ফুটবলকে। ধীরে ধীরে খেলা ছেড়ে দিলেন দুই বন্ধু। চুনী অবশ্য অনেকটাই আগে। মন দিলেন ক্রিকেটে। একবার পতৌদি বলেছিলেন, ‘চুনী তোমার ডান পা এখনও যথেষ্ট স্টেবল্। ফুটবলটা এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলেন কেন?’ উত্তরে চুনী বলেছিলেন, ‘আমার ডান পা’টা স্টেবল্ ঠিকই। কিন্তু এখন সে আর কথা বলে না আগের মতো।’
অবশ্য ফুটবল ছাড়ার পর ক্রিকেটেও বাংলার হয়ে একের পর এক অবিস্মরণীয় পারফরমেন্স আছে। এশিয়াড জেতার ছ’মাস পরে ইডেন গার্ডেন্সে ব্যাট হাতে চুনী নামছেন হায়দ্রাবাদের বিরুদ্ধে, গোটা স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। হায়দ্রাবাদের ক্যাপ্টেন তখন এম এল জয়সীমা।
দলের আগুনে ফাস্ট বোলার রয় গিলক্রিস্ট ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়ে বললেন, ‘এর জন্য এত হাততালি কীসের?’ জয়সীমা জবাবে বলেন, ‘ইনি ভারতীয় ফুটবলের একজন আইকন।’ রয় গিলক্রিস্ট ততোধিক রেগে বলেন, ‘এই আইকনকে আমি বাউন্সারে বিট করছি।’
প্রথম বলটাই কথামত বাউন্সারে। মাথা পিছনে হেলিয়ে কোনওমতে রক্ষা করলেন চুনী। এরপর গিলক্রিস্টকে সামলে সে ম্যাচে ৪১টা রান করলেন, সেকেন্ড ইনিংসে বল হাতে তিনটে উইকেটও নিলেন। গোটা স্টেডিয়ামে জয়ধ্বনি উঠল চুনীর নামে। ফলত রঞ্জি ট্রফিতে চান্সের পর সেখানেও ব্যাট-বল হাতে এল কিছু অনবদ্য পারফরমেন্স।
চুনী গোস্বামী ভারতবর্ষের ক্রীড়া ইতিহাসে একচ্ছত্র একজন সম্রাট। বাংলার বুকে জন্মে যাওয়া এক ক্ষণজন্মা। শৈল্পিক ভঙ্গির ফুটবল এবং দুর্দান্ত ম্যাচ রিডিংয়ের অধিকারী। কোচিং করাতে যাননি জীবনে। তার থেকে প্রেস ক্লাবে বসে মদ খাওয়াটাকে প্রাধান্য দিয়েছেন বেশি। সে স্বভাবটা ছিল শেষদিন পর্যন্ত। ‘ওসব মাস্ক পরে কিস্যু হবে না, একটা বল আসবে, এজ লাগলেই কট বিহাইন্ড।’
হলও তাই। ৩০ মে, ২০২০। বন্ধু পিকের চলে যাওয়ার ঠিক দেড় মাস পর হঠাৎ চলে আসা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট নামক বাউন্সারটা আর সামলাতে পারেন নি। রবীন্দসদন, মোহনবাগান ক্লাব, ইডেন গার্ডেন্স— কোথাও তার নশ্বর দেহকে শায়িত রাখা হয়নি। চুনী যদিও এটাই চেয়েছিলেন। ছেলেকে বলা ছিল, ১মরে গেলে স্ট্রেট শ্মশানে। কোত্থাও রাখবি না আমার দেহ।’
আসলে ভেতরে থাকা সুপারস্টারটি চাননি তাঁকে শুয়ে থাকতে দেখুক গোটা কলকাতা। এভাবে তিনি তো কখনও থাকেননি। ব্যাট হাতে স্কোয়্যার কাটে বা ফুটবলে শরীরের মোচড়ে ডিফেন্ডার ছিটকে দেওয়া ক্ষণজন্মাটি চুপ করে শুয়ে আছে, কলকাতার সাবেক তরুণরা, যারা এখন বার্ধক্যের ছায়ায়, তারা মানতে পারতেন না।
ষাটের দশকের গোড়ায় যখন অলিম্পিকসে ছুটছেন মিলখা সিং, ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া সফর করছেন পতৌদি-বাপু নাদকার্নিরা, তখন চুনী ভারতকে পৌঁছে দিচ্ছেন জগতসভার শ্রেষ্ঠ আসনে। উত্তম কুমার পর্যন্ত বলেছিলেন, ‘তুই তো আমার চেয়ে বেশি ফেমাস হয়ে গেছিস রে! আর হবি নাই বা কেন, আমাদের দেশকে সর্বোচ্চ আসনে তো বসিয়ে এসেছিস।’
চুনী গোস্বামী আসলে পারফেকশনে অন্য নাম। যখন সময় আসবে, তখন ছেড়ে দেব সবকিছু। ফিরেও তাকাব না। তাই করেছেন আজীবন। ডোভার লেন থেকে যোধপুর পার্কে ঠিকানা বদলালেও, বদলায়নি এই জীবনদর্শন।
চুনী গোস্বামী, পারফেকশনকে জীবনের সাথে জড়িয়ে ফেলা এক ক্ষণজন্মার নাম।