বাবর-রিজওয়ান জুটি কি ভাঙা উচিত?

একটা প্রশ্ন দিয়েই বরং শুরু করা যাক। একটা উদ্বোধনী জুটি গত দুই বছরে ৫০.৪৭ গড়ে ২০১৯ রান করেছে। এটা কি দলের জন্য ভালো?

আপনি নিয়মিত ক্রিকেটবোদ্ধা না হলে বলেই বসবেন আরে এত দুর্দান্ত। তবে একটু চালাক কেউ হলেই হয়তো বলে বসবেন টি- টোয়েন্টিতে কোনো জুটির ব্যাপারে মন্তব্য করতে আপনার আরও কিছু তথ্যের দরকার। 

যাই হোক স্ট্রাইকরেটের প্রসঙ্গটা একপাশে সরিয়ে রাখলেও, টি-টোয়েন্টিতে প্রতি ৫০ রান পর একটি উইকেটের পতন হওয়া খুব একটা সুবিধার কথা না। এর অর্থ হল আপনার ব্যাটসম্যানরা ঝুঁকি নিচ্ছে না বা তাঁরা খুব ধীরে খেলছে। টি -টোয়েন্টিতে প্রতি ওভারেই যেখানে থাকে একাধিক বাউন্ডারির চাহিদা, সেখানে ঝুঁকিহীন ব্যাটিং আশার কথা শোনায় না। 

কেবল জুটি নয়, কোনো ব্যাটসম্যান নিজেও যদি প্রায় ৫০ গড়ে টি -টোয়েন্টিতে রান করে তাঁর ব্যাপারেও একই প্রশ্ন প্রযোজ্য। টানা দুই বছর ধরে এই গড় বজায় রাখতে হলে আপনাকে হয়তো ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে থাকা লাগবে কিংবা হতে হবে টি- টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় মোহাম্মদ রিজওয়ান কিংবা বাবর আজম দুজনের কেউই টি- টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট নন।  

টি- টোয়েন্টিতে ব্যাটিং কিংবা বোলিং দুই ক্ষেত্রেই জুটি বেঁধে খেলাটা খুব জরুরি। কোনো স্পিনার যদি খুব আঁটসাঁট কোনো ওভার শেষ করেন, তাহলে তাঁর পরের ওভার করতে আসা বোলারকেও চাপটা ধরে রাখতে হবে। রান বিলিয়ে দিয়ে চাপ আলগা করা যাবে না।

একইভাবে পার্টটাইমার কাউকে দিয়ে মাঝের কোনো এক ওভার হয়তো করিয়ে নেয়া লাগবে। তেমনি ব্যাটিংয়েও জুটি বাঁধতে এমন দুজন দরকার যারা কিনা এঁকে অন্যের পরিপূরক। হতে পারে ডানহাতি-বা-ঁহাতি কম্বিনেশন, কিংবা একজন পেসে সাবলীল হলে অন্যজন স্পিনের বিপক্ষে স্বচ্ছন্দ্যে ব্যাট চালাতে জানেন।

এর পেছনের কারণটা হলো প্রতিপক্ষ যেন দুর্বলতা আন্দাজ করে টানা চাপ বজায় রাখতে পারে। গত বিশ্বকাপে ভারত ছিল এই ঘটনার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলি দুজনেই স্পিনের বিপক্ষে খানিকটা ধীরে খেলতে পছন্দ করেন। নিউজিল্যান্ড সেদিন ইশ সোধি এবং মিশেল স্যান্টনারকে দিয়ে রানের গতি একদম থামিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে তাঁদের দুজনে ভর করেই ম্যাচ জিতে নিয়েছিল কিউইরা।

বাবর এবং রিজওয়ান দুজনেই একই ঘরানার ব্যাটসম্যান। একই ধরনের বোলিংয়ের বিপক্ষে দুর্বলতার পাশাপাশি দুজনেই আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের চাইতে শুরুতে ক্রিজে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করেন। দুজনেই পাওয়ার প্লেতে ঝুঁকি নিতে ভালোবাসেন না, স্পিনে খানিকটা দুর্বল এবং ইনিংসের শুরুতে পেস বোলিংকে সমীহ করে চলেন। তাছাড়া দুজনেই ডানহাতি ব্যাটার হওয়াতে প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা করাতেও বেশ সুবিধা হয়। সব মিলিয়ে একটা প্রশ্নই বারবার ঘুরপাক খায় বলা, প্রচুর রান করা সত্ত্বেও বাবর-রিজওয়ান জুটি কি পাকিস্তানের জন্য মঙ্গলজনক?

বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচেই হেরে গ্রুপপর্ব থেকে বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পাকিস্তান। এমন না যে তাঁদের দুজনের জুটির কারণেই ম্যাচ হেরেছে পাকিস্তান, ভাগ্যের খানিকটা সহায়তা পেলে হয়তো দুটো ম্যাচেই জিততে পারতো তাঁরা। তবে একেবারেই দায় এড়াতে পারবেন না এ দুজন, বিশ্বকাপে অল্পতেই এই দুজন ফিরে যাওয়াতে চাপে পরে যাচ্ছে পাকিস্তানের মিডল অর্ডার। গত দুই বছরে তেমন একটা ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাননি মিডল অর্ডারের ব্যাটাররা, বিশ্বকাপের মত আসরে এসে নিজেদের নতুন ভূমিকায় মানিয়ে নিতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাঁদেরকে। 

তাছাড়া পাকিস্তান দলে কিন্তু ওপেনিং এ সফল একজন রয়েছেন, তিনি ফখর জামান। বাবর কিংবা রিজওয়ান একজন নিচে নেমে ফখরকে সুযোগ দিলে, পাকিস্তানের ওপেনিং এর অনেক সমস্যায় সমাধান হবার কথা।

ডানহাতি-বাঁ-হাতি কম্বিনেশনের পাশাপাশি অন্য দুজনের তুলনায় ফখর অনেকটা আগ্রাসী, ইনিংসের শুরু থেকেই ব্যাট চালিয়ে খেলতে পছন্দ করেন। তাছাড়া মিডল অর্ডারে নতুন ভূমিকায় তিনি রানও পাচ্ছেন না সেভাবে। তবে বাবর-রিজওয়ান এখনও ওপেনিং এ কেন? তাঁরা কি স্বার্থপরের মতো দলের চাইতে নিজেকে বড় করে দেখছেন?

এমন প্রশ্ন ওঠাটা আসলে অস্বাভাবিক না। এমনকি পিএসএলের এক কোচ এমনও বলেছেন করাচি কিংসের বিপক্ষে খেলার সময় তাঁরা চেষ্টা করেন বাবরকে আউট না করতে। বিশ্বজুড়ে এত সমালোচনা সত্ত্বেও পাকিস্তান টিম ম্যানেজমেন্ট আসলে কি চিন্তা করছে সেটা সত্যিই ভাবনার বিষয়।

পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচক মোহাম্মদ ওয়াসিম একবার বলেছিলেন তাঁরা মিডল অর্ডারকে খুব একটা ভরসা করেন না। কিংবা ফখর জামান তখনও হাঁটুর ইনজুরি থেকে তখনও পূর্ণদ্যমে ফেরেননি। পাকিস্তান সেই সময়ে তাই পরিকল্পনা সাজিয়েছে বাবর-রিজওয়ান জুটিকে কেন্দ্র করেই।

কিন্তু, বর্তমান সময়ে এই জুটি সাফল্যের চাইতে ব্যর্থতাই বেশি উপহার দিয়েছে। ফখর জামান কিংবা শান মাসুদকে ওপেনিং এ সুযোগ দেয়াটা তাই সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে পাকিস্তানের জন্য। 

এক সময়ে ভারত একই সমস্যায় ভুগলেও তাঁরা সমাধান বের করে নিয়েছেন। কোহলি কিংবা রাহুলের সাথে ব্যাট করার সময় অধিনায়ক রোহিত নিজেই আগ্রাসী ভূমিকা পালন করেন।  কিন্তু সেই একই ভূমিকা পাকিস্তানে পালন করার মত কেউই যেন নেই। নিজেদের প্রথম দুই ম্যাচ হেরে পাকিস্তানকে এখন তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে ভারতের দিকে। তবে ভারত তাঁদের কাজ করে দিলেও পাকিস্তানকে অন্তত তাঁদের নিজেদের হাতে থাকা ম্যাচগুলো জিততে।

আপাতদৃষ্টিতে ব্যাটিং নিয়ে নানা সমস্যায় জর্জরিত পাকিস্তান নিজেদের বাকি ম্যাচ গুলো জিতবে সেই পক্ষে বাজি ধরার লোক কমই। তবে দলের নামটা যেহেতু আনপ্রেডিক্টেবল পাকিস্তান, বাতিলের খাতায় না ফেলে তাই অপেক্ষা করাই যায় নতুন চমকের জন্য। কে বলতে পারে হয়তো পরের ম্যাচেই ওপেনিং এ নিজেদের ভুল শুধরে নতুন জুটিতে ভর করে পুরনো রূপে ফিরবে তাঁরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link