শ্যামসুন্দর মিত্র ও বঞ্চনার গল্প

অভিমানেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক। পরের বছর শ্যামসুন্দর মিত্র প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন। মোহন বাগানের হয়ে আরও বছর কয়েক অবশ্য খেলেছিলেন। মেন্টর হিসাবে শ্যামসুন্দর মিত্রের থেকে ভালো আর তো কেউ হয় না। তাঁকে দেখেই জুনিয়ররা ম্যাচে ব্যাটিং-এর অআকখ শিখে ফেলতে পারতেন। মিতভাষী শ্যামসুন্দর মিত্র নিজে থেকে যে কাউকে দেখাতে যেতেন তাও না। তবে ক্রিকেট মনন অসম্ভব ভালো ছিল। ফলে কেউ তাঁর কাছে সাহায্য চাইলে চট করে দেখিয়ে দিতে পারতেন। পরবর্তীকালে বাংলার নির্বাচক হিসাবেও কাজ করেছেন অন্তরালে থাকতে ভালবাসা এই ক্রিকেট মহীরুহ।

প্রাক্তন বাংলা ক্রিকেটার রাজু মুখার্জী শুরুতেই বললেন, ‘লিখো, শ্যামসুন্দর মিত্র বাংলা ক্রিকেটের একলব্য। কার্তিক বসুর কাছে তাঁর আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়ির নেটে যেতেন বটে, কিন্তু প্র্যাকটিসের সুযোগ পেতেন না খুব একটা। ভবানীপুরের নর্দার্ন পার্কের বালক সংঘের কংক্রিট উইকেটে প্র্যাকটিস করে করে উঠেছেন তিনি’। শ্যামসুন্দর মিত্র, বাংলা ক্রিকেটের দুই অর্জুন পঙ্কজ রায় এবং সৌরভ গাঙ্গুলির মাঝের সময়ের একলব্য, বাংলার অন্যতম সেরা ব্যাট শ্যামসুন্দর মিত্র।

খেলতে শুরু করেছিলেন কলকাতা ময়দানে ওই ৫৭-৫৮ থেকেই, স্পোর্টিং ইউনিয়নে। মিডিয়াম পেস বল আর মিডল অর্ডারে ব্যাট। যা হয় আর কি, মূলত বোলার হিসাবে দলে থাকার জন্য ব্যাট পেতেন না বিশেষ। স্পোর্টিং ইউনিয়ন চালাচ্ছেন তখন দোর্দণ্ড প্রতাপী মণীন্দ্র দত্ত রায়, তিনি একাধারে বাংলা এবং জাতীয় দলের নির্বাচকও। পঙ্কজ রায় থেকে শুরু করে বাঘা বাঘা খেলোয়াড়রা তখন স্পোর্টিং-এ বোলার হলেও ভালো ব্যাট করেন, একটা কাজ মন দিয়ে করুন। বাংলা দলে সুযোগ এলো বটে ৫৯-৬০তে কিন্তু ব্যাটিং-এর সুযোগ তো সেভাবে আসে না। রঞ্জির প্রথম সেঞ্চুরি পেতে পেতে ১৯৬১-৬২ রঞ্জি সেমিফাইনাল। প্রথম ইনিংসে রাজস্থানের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি এবং দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ৭৯ও বাংলাকে ফাইনালে তুলতে পারেনি।

তবে তিনি দাঁড়িয়ে গেছেন তদ্দিনে। এরই মধ্যে মোহন বাগানে চলে এসেছেন ১৯৫৯-৬০তে। পরপর দু’বার লিগ আর নকআউট জিতে ১৯৬১-৬২ সিজনটায় কোনও ট্রফি লাভ হল না। পরের বছর শ্যামসুন্দর মিত্র রুশি মোদীর ডাকে এরিয়ান ক্লাবে খেলতে গেলেন। টাটাতে চাকরি করতেন, রুশি মোদী টাটার সিএমডি, ডাক ফেরাতে পারেননি।

তবু সবুজ মেরুনের টান। দূরে সরে থাকতে পারেননি তিনি। পরের বছরই ফিরে আসেন প্রিয় দলে। তারপর সারা ক্রিকেট জীবন টানা ছিলেন তিনি মোহন বাগানের সঙ্গে।

ধীরে ধীরে ময়দানে লেজেন্ডের জায়গা নিচ্ছেন। মোহন বাগানের খেলা ঘেরা মাঠ বা খোলা মাঠ যেখানেই থাকত, সমর্থক অসমর্থক, ক্রিকেট প্রেমীরা ভিড় জমাতেন শ্যামসুন্দর মিত্রর ব্যাটিং দেখতে। সে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃষ্টিনন্দন কাব্যিক ব্যাটিং। সামান্য শর্ট অব লেন্থে ব্যাক অ্যান্ড অ্যাক্রস গিয়ে কভার আর পয়েন্টের মাঝখান দিয়ে ঠেলে রান অথবা উইকেটের বল মিড অন থেকে ফাইনলেগের যে কোনও জায়গায় ঋজুসৌন্দর্যে পাঠিয়ে ইচ্ছামত ছুটে নিয়ে নিচ্ছেন রান। চার ছয় না মেরেও যে এক অদ্ভুত নন্দন কাব্য রচনা করা যায় তা শ্যামসুন্দর মিত্রকে না দেখলে বোঝা যেত না।

৬৩র রঞ্জি কোয়ার্টার ফাইনাল হায়দ্রাবাদের বিরুদ্ধে। হায়দ্রাবাদে তখন রয় গিলক্রিস্ট, বিখ্যাত ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস বোলার খেলছেন। সেই ভয়ঙ্কর পেস বোলিঙের বিরুদ্ধে অবলীলায় ৯৮। ভারতীয়দের পেস বোলিং খেলা উন্নত করার জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের চার পেস বোলার এসেছিলেন চারটি জোনে খেলার জন্য। হায়দ্রাবাদে গিলক্রিস্ট, বাংলায় লেসটার কিং, বোম্বেতে চার্লি স্টেয়ার্স আর দিল্লির হয়ে চেষ্টার ওয়াটসন। ১৯৬১তে একটি অন্য ম্যাচে এই গিলক্রিস্টের বলেই কবজি ভেঙেছিল কিন্তু শ্যামসুন্দর মিত্রের। এই ৬৩-৬৪তেই দলীপ ট্রফিতে মধ্যাঞ্চলের বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে পঞ্চাশ ছিল।

৬৬-৬৭তে কোয়ার্টার ফাইনালে রেলওয়েজের বিরুদ্ধে ৯১ আর ১৪৭। ৬৭-৬৮র সেমিফাইনালে প্রথম ইনিংসে বোম্বের থেকে পিছিয়ে থাকার কারণে হেরে যাওয়া ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরি করলেন শ্যামসুন্দর। কেরিয়ারের মধ্যগগনে তিনি তখন। সুনীল গাভাসকারও পরবর্তী সময়ে লিখেছিলেন সেই সময় শ্যামসুন্দর মিত্রের ব্যাটিং-এর কথা। একজন জুনিয়র ক্রিকেটারের কাছে উদাহরণ ছিল শ্যামসুন্দর মিত্রের ব্যাটিং। কীভাবে ইনিংস গড়তে হয় তিল তিল করে, ঠাণ্ডা মাথায় স্কোরবোর্ড সচল রেখে, তা শ্যামসুন্দর মিত্রের ব্যাটিং থেকে শেখা যেত।

তবু ভারতীয় দলের দরজা খোলেনি। রাজু মুখার্জী বলছিলেন, ‘খোলেনি হয়তো ভালই হয়েছে। তখনকার দিনের মতো যদি দুচারটে টেস্ট খেলিয়ে বসিয়ে দেওয়া হত তাহলে শামুদার প্রতিভার সঙ্গে অবিচার হত। শামুদা টেস্ট খেললে কম করে দশ বছর খেলতেন!’

তবে টেস্ট খেলা কেন হল না, সেই নিয়ে সরাসরি মুখ খোলেননি এই অজাতশত্রু দীর্ঘদেহি ব্যক্তি। যদিও মোটামুটি সবাই জানতেন যে স্পোর্টিং ইউনিয়নের হয়ে খেলতে অস্বীকার করাটাই কারণ। মোহন বাগান অন্তঃপ্রাণ এই দৃঢ়চেতা ব্যক্তি স্বর্ণসময়ে শত প্রলোভন সত্ত্বেও মণীন্দ্র দত্ত রায়ের স্পোর্টিং ইউনিয়নের ফিরে যাননি। ফলতঃ দরজা খোলেনি ভারতীয় টেস্ট দলের। রহস্যটা কী ছিল? কেন স্পোর্টিং-এ খেললেই ভারতের হয়ে খেলে ফেলা যেত, পূর্বাঞ্চলের দলেও কোনও সমস্যা হত না? জিজ্ঞাসা করলে মৃদু হেসে বলতেন, ‘না না সেরকম কিছু নয়, স্পোর্টিং-এর দল তখন তারকাসমৃদ্ধ ছিল, তাই!’ কিন্তু সত্যিই কি তাই?

পরিসংখ্যান বলছে, মোহন বাগান ক্রিকেট দলও ১৯৬২ থেকে ১৯৭১-এ ৭ বার কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, ৪ বার নকআউট। অর্থাৎ মুখে না বললেও ঘটনার সত্যতা নিয়ে বিশেষ ভাবনার অবকাশ থাকে না।

ঠিক যেমন ১৯৭১এর ভারতের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে দুলীপ ট্রফি ফাইনাল। পূর্বাঞ্চলের নিয়মিত উইকেট রক্ষক তখন বিহারের দলজিৎ সিং। অধিনায়ক রমেশ সাক্সেনা। কানাঘুষোয় শোনা যায় যে বাংলার রুশি জিজিবয়কে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে নিয়ে যাবার কথা হয়েছিল। কীভাবে, কেন, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা না গেলেও, কোনও মহল থেকে জাতীয় নির্বাচকদের উপর চাপ ছিল। তাই ইডেনে ফাইনালে টস করতে যাবার ঠিক আগে জাতীয় দলের মুখ্য নির্বাচক প্রখ্যাত ব্যাটসম্যান বিজয় মার্চেন্ট পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ককে ডেকে বলেন যে রুশি জিজিবয়কে খেলাতে হবে উইকেট কিপার হিসাবে। কারণ ফারুক ইঞ্জিনিয়র না যাওয়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের জন্য ফাইনালের প্রতিপক্ষ দক্ষিণাঞ্চলের পি কৃষ্ণমূর্তি এবং জিজিবয়ের নাকি ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাবার সম্ভাবনা প্রবল। শেষ মুহূর্তে দলে পরিবর্তন হল। দুই উইকেট কিপারই খেললেন, কিন্তু বাদ পড়লেন সেরা ব্যাট শ্যামসুন্দর মিত্র। দলে তখন বাংলার প্রকাশ পোদ্দার, বিহারের রমেশ সাক্সেনারা থাকলেও শ্যামসুন্দরের যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। তবু বাদ পড়লেন।

সেই অভিমানেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক। পরের বছর শ্যামসুন্দর মিত্র প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন। মোহন বাগানের হয়ে আরও বছর কয়েক অবশ্য খেলেছিলেন। মেন্টর হিসাবে শ্যামসুন্দর মিত্রের থেকে ভালো আর তো কেউ হয় না। তাঁকে দেখেই জুনিয়ররা ম্যাচে ব্যাটিং-এর অআকখ শিখে ফেলতে পারতেন। মিতভাষী শ্যামসুন্দর মিত্র নিজে থেকে যে কাউকে দেখাতে যেতেন তাও না। তবে ক্রিকেট মনন অসম্ভব ভালো ছিল। ফলে কেউ তাঁর কাছে সাহায্য চাইলে চট করে দেখিয়ে দিতে পারতেন। পরবর্তীকালে বাংলার নির্বাচক হিসাবেও কাজ করেছেন অন্তরালে থাকতে ভালবাসা এই ক্রিকেট মহীরুহ।

বহু, বহু পরে তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি পেয়েছেন। ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল সারাজীবনের জন্য সম্মানিত করে ২০০৯এ আর এই হালে ২০১৭য় পরম বন্ধু এবং সহখেলোয়াড় মোহন বাগান লেজেন্ড চুনি গোস্বামীর হাত থেকে তিনি মোহন বাগান রত্ন পান মোহন বাগান দিবসে।

আসলে বাংলায় ক্রিকেট একটা হুজুগ, ফুটবলও। যত নাচানাচি মাতামাতি আছে, ইতিহাসকে সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টা তার তিলমাত্র নেই। হয়তো কোনও প্রাক্তন খেলোয়াড়ের স্মৃতিচারণে বা অন্য কোথাও দু-এক কথা এইভাবেই শ্যাম সুন্দর মিত্র, অম্বর রায়, সুনীত সোম, মাইকেল দাল্ভি, রাজেশ দানি, রাজু মুখার্জী, প্রবীর চেল, উদয়ভানু ব্যানার্জীরা ভেসে ওঠেন মাঝেমধ্যে।

শ্যামসুন্দর মিত্রকে তো আর হাজার শব্দে ধরা যায় না। বাংলার হয়ে টেস্ট না খেলা ক্রিকেটারদের মধ্যে হয়তো সেরা। বঞ্চনার কথায় গোপাল বসু, মন্টু ব্যানার্জী, প্রেমাংশু চ্যাটার্জী, শুঁটে ব্যানার্জী বা উৎপল চ্যাটার্জীদের শুধু সঙ্গে নয়, হয়তো সবার আগে উচ্চারিত হওয়া এই নাম। কেন খেলতে পারেননি এই আলোচনায় জবাবদিহির লোক আর নেই। কিন্তু তাঁর কীর্তি সংরক্ষিত কেন হবে না, সে বিষয়ে আজও প্রশ্ন থেকে যায়। উত্তর দেবার কারোর ইচ্ছা বা সম্ভাবনা আছে কি না এখনও জানি না।

 কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...