পূব আকাশটায় তখন খানিকটা আলোকচ্ছটা। সূর্য্যি মামা আলো ছড়িয়ে দেওয়ার অপেক্ষায়। দা-কাস্তে আর মাথায় গামছা বেঁধে কিষাণ ছোটেন ক্ষেতের দিকে। শহর তখনও খানিকটা নিস্তব্ধ। তবুও কোদাল আর টুকরি নিয়ে মোড়ের ধারে বসে থাকা যেন নিত্যদিনে গল্প। তবে এই গল্পগুলোর মিডিয়া জগতের জমকালো আলো দেখে না। এই গল্পগুলো এই মহাজাগতিক ভ্রমাণ্ডে বড্ড তুচ্ছ।
তাইতো খেলোয়াড়দের কাছে নির্দ্বিধায় এসবকিছুই তুলনার বস্তুতে পরিণত হয়। বাংলাদেশ ক্রিকেটে ওয়ানডের এক উত্থানের পথে হাটছে। এই উত্থানের পথের কারিগরদের একজন নিসঃন্দেহে মুশফিকুর রহিম। বাংলাদেশের ক্রিকেটের মিডল অর্ডারটা তিনি সামলেছেন কঠিন হাতে। হুড়মুড় করে ভেঙ্গে যাওয়া ব্যাটিং অর্ডারটাকে কোনরকমে বাঁচিয়েছন শতবার। তাইতো তাঁর গায়ে এঁটে গেছে ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ তকমা।
বাংলাদেশের মিডল অর্ডাররে সাকিব আল হাসানের সাথে জুটি বেঁধে সর্বাধিক রান করার রেকর্ডের ভাগিদার মুশফিক। দীর্ঘ প্রায় দেড়দশক ধরে তিনি ক্রমশ হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের আস্থাভাজন। তবে এখনও ঠিক নিজের অবস্থানটুকু বুঝে উঠতে পারেননি মুশফিক। প্রায়শই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সংবাদ সম্মেলন সর্বত্রই অবান্তর সব মন্তব্য করে নিন্দার স্বীকার হচ্ছেন বর্ষীয়ান এই ক্রিকেটার।
প্রতিটা ক্রিকেটারদের জীবনের চিরন্তন সত্য এক সময় অফফর্ম। হাজার চেষ্টা করেও রানটা ঠিক আর করা হয়ে ওঠেনা। বোলারদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই রকম থাকে। এই যে যেমন ভারতের কিংবদন্তি ব্যাটার বিরাট কোহলির কথাই বলা যাক। প্রায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে এই ব্যাটার রয়েছেন শতক খরায়। কত প্রচেষ্টা। তবুও যেন সোনার হরিণের দেখা মেলে না।
তাকে নিয়েও সমালোচনার অন্ত নেই। তবুও নিরবে-নিভৃতে তিনি নিজের হারানো ফর্ম ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় মশগুল। এমন একটা সময়ই পার করছিলেন মুশফিক। স্বাভাবিকভাবেই সমালোচনার তীব্র স্রোতে ভেসে যেতে হয়েছিল তাঁকে। ঠিক তখন থেকেই যেন সমালোচনা আর সইতে পারেন না মিস্টার ডিপেন্ডেবল। তিনি দর্শক, সমালোচকদের আয়নায় নিজেদের মুখ দেখতে বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন যে তিনি যখন অনুশীলন করেন তখন বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে থাকেন।
ঠিক সে মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি ঘটালেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের অনুশীলনের ভিডিও আপলোড করে তিনি লেখেন, ‘আসসলামুয়ালাইকুম সবাইকে। যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে এবং আপনি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে অনুশীলন করেন সেটাই সর্বোচ্চ স্বস্তিদায়ক।’ এমন অবান্তর মন্তব্য আসলেও কি যুক্তিসংগত!
দেশের প্রায় প্রতিটা মানুষ নিজ নিজ জায়গা থেকে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে। দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখার আপ্রাণ চেষ্টাটা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা মানুষের কাজ করবার সময়, ধরণ কিংবা শ্রম একরকম হবে না এটাই তো স্বাভাবিক। একজন বুদ্ধিজীবী তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডার হাতরে দেশকে বিশ্বদরবারে প্রতিনিধিত্ব করবার চেষ্টা করন। অন্যদিকে বিদেশের মাটিতে নিজেদের শ্রমের বিনিময়ে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন লাখ লাখ শ্রমিক।
একজন মুশফিকুর রহিম অ্যাথলেট হিসেবে সকাল সকাল দৌড়াবেন, নেটে ব্যাটিং অনুশীলন করবেন। এটাই তো স্বাভাবিক। এমনটাই তো হবার কথা। এমন সাধারণ কাজটা এলাকার কিশোর ছেলেটাও করে, যে একদিন জাতীয় দলের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। তবে সে ছেলে নিশ্চয়ই সবাইকে বলে বেড়ায় না। অথবা অন্য আরেক পেশার মানুষের সাথে নিজেকে নিছক এক তুলনার পাত্রে ফেলে দেয় না।
মুশফিক বেশ কর্মঠ, মুশফিক বেশ পরিশ্রমে। কালে কালে এ নিয়ে বহু চর্চা হয়েছে। তিনি প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। তবে মুশফিক যে কাজটা কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে হাসিল করেন তার সমপরিমাণ কিংবা বেশি ফলাফলের দেখা অন্য ক্রিকেটাররাও পেয়েছেন, পাচ্ছেন, ভবিষ্যতেও পাবেন সমান পরিশ্রম কিংবা মুশফিকের চাইতেও কম পরিশ্রম করে। ক্যারিয়ারের শেষের দিকে এসে দর্শকদের উদ্দ্যেশে এমন বিদ্রুপ অন্তত মুশফিকের কাছ থেকে শোভা পায় না।
নিতান্তই এক ছেলে মানুষী। হয়ত অচিরেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটা ঠিক তাকে দিয়ে হয়না এই বিষয়টা বুঝতে পারবেন মুশফিক। সে সাথে এটাও বুঝবেন সমালোচনা, নিন্দা আর তিরস্কাররের জবাবটা মাঠের ক্রিকেটেই দেওয়া সর্বোত্তম। পনেরো বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা একজন ক্রিকেটারের কাছ থেকে অন্তত এতটুকু প্রত্যাশা করাই যায়।