স্যার গ্যারি সোবার্স: অবিসংবাদিত সেরা অলরাউন্ডার!

১.

একদিকে ঘরের মাটিতে ইংরেজদের সিরিজ বাঁচানোর লড়াই। অন্যদিকে প্রথম তিন ম্যাচের দুটিতে জেতা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে পাঁচ ম্যাচের সিরিজটি নিজেদের করে নেওয়ার সুযোগ। এই যখন অবস্থা তখন হেডিংলিতে টস করতে নামলেন দুই অধিনায়ক কলিন কাউড্রে ও গ্যারি সোবার্স। টানা চতুর্থবারের মত টসে জিতলেন সোবার্স, জানিয়ে দিলেন আগে ব্যাটিং করবে তাঁর দল। বৃষ্টি এবং আলোকস্বল্পতার কারণে প্রথম দিন খেলা বন্ধ থাকল প্রায় সোয়া তিন ঘণ্টা। দিনশেষে সফরকারীদের সংগ্রহ দাঁড়াল তিন উইকেটে ১৩৭ রান।

১৯৬৬ সালের পাঁচ আগস্ট। হেডিংলি টেস্টের দ্বিতীয় দিন। দলীয় ১৫৪ রানের মাথায় পড়ল চতুর্থ উইকেট। ক্রিজে এলেন গ্যারি সোবার্স, খেললেন রাজসিক এক ইনিংস। ক্যারিয়ারের সতেরোতম টেস্ট সেঞ্চুরিটা তুলে নিলেন চা বিরতির আগেই। ডানহাতি সিমুর নার্সকে নিয়ে পঞ্চম উইকেট জুটিতে যোগ করলেন ২৬৫ রান।

সোবার্সের ২৬০ বলে ১৭৪ রানের অনবদ্য ইনিংসটিতে বাউন্ডারি ছিল ২৪টা। যার ১৬ টাই মেরেছিলেন এক সেশনে!ে উইজডেন যে ইনিংসটির বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিল, ‘Bowlers were slaughtered with a blade that flashed in a manner both savage and sublime. The fast men were carted all around the wicket. The spinners were driven and lofted with uncanny quickness of eye and feet.’

সোবার্সকে দারুণ সঙ্গ দেয়া সিমুর নার্স করেছিলেন ৩২৩ বলে ১৩৭। শেষ পর্যন্ত ৯ উইকেটে ৫০০ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করে দিলেন সোবার্স।

ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসের শুরুতেই ৪ উইকেট ফেলে দিলেন দুই স্ট্রাইক বোলার ওয়েস হল আর চার্লি গ্রিফিথ। এরপর আবার শুরু হল ‘সোবার্স শো’! এবার অবশ্য ব্যাট হাতে নয়, বল হাতে! বাঁহাতের কব্জিশিল্প প্রয়োগে মাত্র ৪১ রান খরচায় তুলে নিলেন ৫ উইকেট। ফলাফল মাত্র ২৪০ রানে অলআউট ইংল্যান্ড।

ফলোঅনে পড়ে দ্বিতীয়বার ব্যাটিংয়ে নেমে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা চালায় স্বাগতিকরা। কিন্তু ল্যান্স গিবস-গ্যারি সোবার্স যুগলের ঘূর্ণিতে সে প্রতিরোধ নিমিষে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ডানহাতি অফ স্পিনার গিবস নেন ৬ উইকেট আর ‘চায়নাম্যান’ সোবার্সের ঝুলিতে জমা পড়ে ৩ উইকেট। ব্যাট হাতে দুরন্ত সেঞ্চুরির পর বল হাতে সোবার্সের ম্যাচ ফিগারটাও দাঁড়ায় দেখার মত, ৩৯.৪-১০-৮০-৮!

ইংলিশরা অলআউট হয় ২০৫ রানে। সফরকারী উইন্ডিজ ম্যাচটি জিতে নেয় এক ইনিংস এবং ৫৫ রানের ব্যবধানে।

১৯৬৬ সালের সেই ট্যুরে পাঁচ টেস্ট খেলে সোবার্স করেছিলেন ৭২২ রান। সেঞ্চুরি ৩টি, ফিফটি ২টি। ব্যাটিং গড় ১০৩.১৪!

পাশাপাশি বল হাতে ২৭.২৫ গড়ে নেন ২০ উইকেট। সাথে যোগ করুন ফিল্ডার হিসেবে ১০টি দুর্দান্ত ক্যাচ। সব মিলিয়ে এ এক অনন্য কীর্তি; কেননা টেস্ট ক্রিকেটে সেই থেকে আজ অব্দি কোন খেলোয়াড় এক সিরিজে ৫০০ রান, ১০ উইকেট, ১০ ক্যাচের মালিক হতে পারে নি!

বলা হয় যে, ত্রিশের দশকে ব্র্যাডম্যানের পর সিক্সটিজে এসে সোবার্সই প্রথম ক্রিকেটার যিনি ইংরেজদের হৃদয় জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এতটাই যে ইংলিশ মিডিয়ার কল্যাণে এক সিরিজেই তাঁর নাম হয়ে যায় ‘কিং ক্রিকেট!’ এই নামে সোবার্সের একটি বইও বেরিয়েছে পরবর্তীকালে।

২.

ক্রিকেটবোদ্ধাদের বেশিরভাগের চোখেই তিনি টেস্ট ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার। ২০০০ সালে উইজডেন কর্তৃক শতাব্দীর সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন মনোনীত হন সোবার্স। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯০ ভোট পান তিনি। সেরা পাঁচে থাকা বাকিরা হলেন স্যার ডন ব্রাডম্যান (১০০), স্যার জ্যাক হবস (৩০), শেন ওয়ার্ন (২৭) ও স্যার ভিভ রিচার্ডস (২৫)।

ব্র্যাডম্যানের চোখে ইতিহাসের ‘সেরা’ দুই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের একজন হলেন গ্যারি সোবার্স (অন্যজন গ্রায়েম পোলক)। সোবার্সের ব্যাটিং পরিসংখ্যানটা একবার দেখুন। ৯৩ টেস্টে ৮০৩২ রান, ব্যাটিং গড় ৫৭.৭৮। ২৬টি সেঞ্চুরির পাশে ৩০টি হাফ সেঞ্চুরি। এর সাথে যোগ করুন ৩৪.০৩ গড়ে ২৩৫ উইকেট এবং ১০৯টি ক্যাচ।

টেস্টে সোবার্সের ব্যাটিং এবং বোলিং গড়ের পার্থক্য ২০ এর বেশি। অত্যন্ত দুর্লভ এই রেকর্ডের অংশীদার মাত্র দুজন; জ্যাক ক্যালিস আর ওয়ালি হ্যামন্ড।

সহজাত স্ট্রোকমেকার সোবার্সের ব্যাটিংয়ের মূল দর্শন ছিল আক্রমণ। অফসাইডে নান্দনিক কাভার ড্রাইভ ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক। ন্যাচারাল ব্যাকফুট প্লেয়ার হওয়ায় কাট এবং পুল শটে ছিলেন ভীষণ পারদর্শী।

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক ও চ্যানেল নাইনের প্রয়াত ধারাভাষ্যকার রিচি বেনোর ভাষায়, ‘When he drove through the off-side he looked at once classy and fierce. In his cuts and pulls it was brilliance in brutality.’

প্রোটিয়া কিংবদন্তি ব্যারি রিচার্ডসের ভাষায়, ‘Sobers was the only 360-degree player in the game. From his backlift to follow-through, the bat traversed a perfect and complete circle.’

সোবার্সের দৃষ্টিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। স্পিনারদের বিপক্ষে তাঁর পায়ের কাজ ছিল ‘লাইটনিং কুইক’। সোবার্স সবসময়ই বলতেন, ‘ব্যাটিংয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল পায়ের পজিশন। যদি তোমার পা ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় থাকে তাহলে তুমি অবশ্যই ভাল খেলবে।’

সোবার্সের ব্যাটসম্যানশিপ প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ সি. এল. আর. জেমস একটা কথা বলেছেন, ‘Sobers had the ability to judge the ball early in its flight and so quickly decide which stroke to play. His ability of “seeing” the ball is only comparable to Don Bradman.’

৩.

৯৩ টেস্টে ২৩৫ উইকেট। ম্যাচে কখনও ১০ উইকেট পাননি। তবে ইনিংসে ৫ উইকেট আছে ৬ বার। পরিসংখ্যান বিবেচনায় সোবার্সকে তাই ‘গ্রেট বোলার’ বলা যাবে না কোনভাবেই। তবে ‘বোলার’ সোবার্সের বিশেষত্ব ছিল অন্য জায়গায়।

লেফট আর্ম অর্থোডক্স (ফিঙ্গার স্পিন) এবং চায়নাম্যান (রিস্ট স্পিন) দুই ধরনের বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন তিনি। বেশ ভাল টার্নও পেতেন। এমনকি ‘ব্যাক অফ দ্য হ্যান্ড’ অ্যাকশনে চমৎকার গুগলিও দিতে পারতেন। আবার দলের প্রয়োজনে বাঁহাতি সিমারের ভূমিকাতেও দেখা গেছে তাঁকে।

উইজডেনের ভাষায়, ‘His versatility enabled him to bowl all varieties of left-arm bowling from spin to fast-medium.’

সোবার্সের বলে খুব বেশি গতি না থাকলেও নতুন বলে বেশ কার্যকরী ছিলেন। সুইং, কন্ট্রোল আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ব্যাটসম্যানদের ভালই ভোগাতে পারতেন। তাঁর ন্যাচারাল ডেলিভারি ছিল লেট ইনসুইঙ্গার। খুব ভাল বাউন্সারও নাকি দিতে পারতেন। মাঝেমধ্যে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ জোরে বল করতেন এমনটাও দাবি করেছেন অনেকে।

সাবেক অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান নেইল হার্ভের মতে, ‘As a fast-medium bowler, he was quite nippy. On occasions Sobers could be faster than Hall.’

সাবেক ইংরেজ ওপেনার জিওফ্রে বয়কটের ভাষায়, ‘With the new ball, he could make the delivery curve late in flight at high speed; his action being a loose, springy run followed by a ‘whiplash’ delivery.’

সোবার্সের চেয়ে ভাল বোলার ইতিহাসে অনেক আছে, কিন্তু তাঁর মত ভার্সেটাইল বোলার আর ক’জন এসেছে? পাশাপাশি সোবার্স ছিলেন একজন বিশ্বমানের অ্যাথলেট। সোবার্সকে তাঁর সময়ের অবিসংবাদিত সেরা ফিল্ডার বলেও রায় দিয়েছেন অনেকে। স্লিপ, লেগ স্লিপ, কাভার, পয়েন্ট – মাঠের সব জায়গাতেই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। সোবার্সের ছিল স্পিড, ব্যালান্স আর রিফ্লেক্সের নিখুঁত কম্বিনেশন আর পাওয়ারফুল থ্রোয়িং আর্ম।

রিচি বেনোর ভাষায়, ‘Sobers is the greatest all-round cricketer the world has ever seen. A brilliant batsman, splendid fielder, particularly close to the wicket, and a bowler of extraordinary skill.’

৪.

১৯৩৬ সালের ২৮ জুলাই, বার্বাডোজের ব্রিজটাউনে জন্মগ্রহণ করেন সোবার্স। পুরো নাম গারফিল্ড সেন্ট অব্রান সোবার্স। পরিবারের ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম।

ছেলেবেলায় বাবাকে হারান মাত্র পাঁচ বছর বয়সে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সলিল সমাধি হয়েছিল তাঁর বাবার।

প্রথম জীবনে ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবল এবং বাস্কেটবলেও সমান পারদর্শী ছিলেন সোবার্স। বড় ভাই জেরাল্ড সোবার্সের সঙ্গে টানা তিনবার নিজের স্কুল ‘বে স্ট্রিট বয়েজ’কে ইন্টার স্কুল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন করেন তিনি।

প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে হাতেখড়ি স্থানীয় বার্বাডোজ লিগে। ১৬ বছর বয়সে ফার্স্ট ক্লাস অভিষেক, বার্বাডোজ একাদশের হয়ে ভারতের বিপক্ষে। বাঁহাতি স্পিনে ৭ উইকেট (৪/৫০ ও ৩/৬২) নিয়ে অভিষেকেই চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে।

১৯৫৪ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে টেস্ট ডেব্যু, কিংস্টনের স্যাবাইনা পার্কে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সুযোগ পেয়েছিলেন পেটের পীড়ায় আক্রান্ত অভিজ্ঞ বাঁহাতি স্পিনার আলফ ভ্যালেন্টাইনের বদলি হিসেবে।

অভিষেক টেস্টের দুই ইনিংসে সোবার্স নেমেছিলেন ৯ নম্বরে! রান করেছিলেন যথাক্রমে ১৪* এবং ২৬। তবে বল হাতে নিজের সামর্থ্যের কথা জানান দিতে একদমই ভুল করেন নি। ৭৫ রান খরচায় তুলে নেন ৪ উইকেট।

১৯৫৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোম সিরিজের একটা ঘটনা বলি। সিরিজের মাঝপথে একদিন হুট করে সদ্য কৈশোর পেরোনো সোবার্সকে ওপেনিংয়ে নামিয়ে দেন অধিনায়ক ডেনিস অ্যাটকিনসন। উদ্দেশ্য ছিল, নতুন বলের বিধ্বংসী জুটি মিলার-লিন্ডওয়ালের হাত থেকে টপ অর্ডারকে আগলে রাখা।

এরপর কী ঘটেছিল জানেন? রে লিন্ডওয়ালের করা ইনিংসের প্রথম তিনটি বলকেই সীমানাছাড়া করেছিলেন সোবার্স! অজি ফাস্ট বোলারদের গতি-সুইং-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে শেষ পর্যন্ত আউট হন ৪৩ রানে, চার মেরেছিলেন ১০টি।

এক ফ্রেমে দুই কিংবদন্তি – সোবার্স ও মোহাম্মদ আলী

৫.

ক্যারিয়ারের প্রথম চার বছর ব্যাটসম্যান হিসেবে সোবার্স ছিলেন আন্ডারপারফর্মড। ১৬ টেস্টের ২৩ ইনিংসে ফিফটি ছিল মাত্র তিনটি, সর্বোচ্চ ৬৬!

যখন ‘ব্যাটসম্যান’ সোবার্সকে নিয়ে সবাই একরকম হতাশ, ঠিক তখনই সর্বকনিষ্ঠ ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ানের রেকর্ড গড়ে বসলেন সোবার্স! ভেঙে দিলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ২৮ বছরের পুরনো বিশ্বরেকর্ড।

১৯৩০ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩৩৪ রানের ইনিংস খেলার সময় ব্র্যাডম্যানের বয়স ছিল ২১ বছর ৩১৮ দিন। আর ১৯৫৮ সালে কিংস্টনে পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ৩৬৫ করার সময় সোবার্সের বয়স ছিল ২১ বছর ২১৩ দিন!

শুধু তাই নয়, সোবার্সের ৩৬৫* রানের ইনিংসটি ছিল তখনও অবধি টেস্ট ক্রিকেটের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস। যেটি খেলার পথে তিনি ভেঙেছিলেন ইংরেজ কিংবদন্তি স্যার লেন হাটনের ২০ বছরের পুরনো আরেকটি বিশ্বরেকর্ড। ১৯৩৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হাটন করেছিলেন ৩৬৪ রান।

পাকিস্তানের বিপক্ষে পাঁচ টেস্টের ওই সিরিজে ৩ সেঞ্চুরিসহ সোবার্সের ব্যাট থেকে এসেছিল ৮২৪ রান!

তারপর জীবনে প্রথমবারের মত গেলেন ভারত সফরে। সেখানে গিয়ে হাঁকালেন আরও ৩টি সেঞ্চুরি! মুম্বাইতে ১৪২, কানপুরে ১৯৮, কলকাতায় ১০৬। সিরিজ সর্বোচ্চ ৫৫৭ রান এসেছিল সোবার্সের ব্যাট থেকেই।

পরের বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজে আবারও তিন সেঞ্চুরি! ব্রিজটাউনে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরিটি (২২৬) তুলে নেবার পথে অধিনায়ক ফ্রাঙ্ক ওয়ারেলের সাথে পঞ্চম উইকেট জুটিতে গড়লেন ৩৯৯ রানের বিশ্বরেকর্ড। সাত শতাধিক (৭১৯) রান নিয়ে সিরিজের হাইয়েস্ট স্কোরার হলেন আরও একবার।

১৯৬১ সালে ব্রিসবেনের দর্শক সাক্ষী হল ইতিহাসের প্রথম ‘টাই’ টেস্টের! সোবার্স খেললেন ১৩২ রানের চোখধাঁধানো এক ইনিংস। যেটা দেখে স্যার ডন ব্র‍্যাডম্যান এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে বলেই বসলেন, এটা নাকি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে তাঁর দেখা সেরা ইনিংস! এক ম্যাচ পরই সিডনির স্পিন সহায়ক উইকেটে খেললেন ১৬৮ রানের আরও একটি মাস্টারক্লাস!

তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সিরিজটি শেষমেশ ২-১ ব্যবধানে হেরে বসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২টি সেঞ্চুরিসহ সোবার্সের ব্যাট থেকে আসে ৪৩০ রান। এছাড়া বল হাতে নেন ১৫ উইকেট।

বিয়ের দিন

১৯৬২ সালে দেশের মাটিতে ভারতকে ৫-০ ব্যবধানে ধবলধোলাই করে ক্যারিবীয়রা। সোবার্সের অবদান ছিল ৭০.৬৭ গড়ে ৪২৪ রান এবং ২০.৫৭ গড়ে ২৩ উইকেট।

পরের বছর ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মত গড়েন এক সিরিজে তিন শতাধিক রান ও ২০ উইকেটের ‘ডাবল’ অর্জনের কীর্তি। সোবার্সের অলরাউন্ড নৈপুণ্যেই (৩৩২ রান ও ২১ উইকেট) সেবার ৩-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতেছিল ক্যারিবীয়রা।

৬.

১৯৬৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক মনোনীত হন সোবার্স। প্রথমবারের মত দায়িত্ব পেয়েই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাটিতে ফ্রাঙ্ক ওয়ারেল ট্রফির শিরোপা (২-১) এনে দেন তিনি।

এরপর ১৯৬৬-৬৭ সালে ইংল্যান্ডকে ৩-১ এবং ভারতকে ২-০ ব্যবধানে পরাজিত করে সোবার্সের নেতৃত্বাধীন উইন্ডিজ।

১৯৬৭-৬৮ মৌসুমে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ত্রিনিদাদ টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৯২ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করেন ‘জয়ের জন্য মরিয়া’ সোবার্স। শেষ দিনে জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ২১৫ রান। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে চ্যালেঞ্জটা হেরে যান তিনি। ৭ উইকেট হাতে রেখেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ইংলিশরা। এই হারের জন্য সোবার্সকে গণমাধ্যমের কঠোর সমালোচনার শিকার হতে হয়েছিল। রীতিমতো ‘জাতীয় শত্রু’তে পরিণত হয়েছিলেন তিনি!

আসলে সে মুহূর্তে ভাগ্যও তাঁর সহায় ছিল না। না হলে কি আর পরের টেস্টটাও নিশ্চিত পরাজয়ের মুখ থেকে অবিশ্বাস্যভাবে বাঁচিয়ে ফেলতে পারত ইংল্যান্ড? দুই ইনিংসে যথাক্রমে ১৫২ ও ৯৫ রান, আর বল হাতে ৬ উইকেট নিয়েও তাই ক্যারিবীয় সমর্থকদের চোখে খলনায়ক বনে যান সোবার্স।

এদিকে ওয়েস হল এবং চার্লি গ্রিফিথের বিদায়ের পর উইন্ডিজের পেস আক্রমণ অনেকখানিই দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ ১৯৬৮-৬৯ মৌসুমের ফ্রাঙ্ক ওয়ারেল ট্রফিটা ৩-১ ব্যবধানে হেরে বসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

সিরিজের একমাত্র জয়টা এসেছিল ব্রিসবেনে। ব্যাট হাতে ১৩০ রানের (৯৪ ও ৩৬) পর বাঁহাতি সিম বোলিংয়ে ৭ উইকেট (১/৩০ ও ৬/৭৩) নিয়ে সামনে থেকে যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গ্যারি সোবার্স।

দুর্ভাগ্যবশত নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পরের সিরিজটাও জিততে পারে নি (১-১) সোবার্সের উইন্ডিজ। একই মৌসুমে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে যান ২-০ ব্যবধানে।

১৯৭০-৭১ সালে ভারতের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচ সিরিজের চারটাই ড্র হয়! অন্যটিতে হেরে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তিন সেঞ্চুরিসহ ৫৯৭ রান করেও সিরিজ হার ঠেকাতে পারেন নি সোবার্স।

অধিনায়ক হিসেবে সোবার্স ছিলেন সাহসী, আগ্রাসী এবং উচ্চাভিলাষী এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ক্যাপ্টেন্সি ক্যারিয়ারের সূচনাটাও ছিল দুর্দান্ত, তবে শুরুর সাফল্যটা শেষদিকে আর ধরে রাখতে পারেন নি।

দলীয়ভাবে ব্যর্থ হলেও অধিনায়ক থাকাকালীন সোবার্সের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স ছিল চোখে পড়ার মতো। অধিনায়ক হিসেবে সোবার্সের ব্যাটিং গড় ৫৮.৮০। টেস্টে কমপক্ষে তিন হাজার রান করা অধিনায়কদের মধ্যে সোবার্সের ওপরে আছেন কেবল স্যার ডন ব্রাডম্যান (১০১.৫১) আর মাহেলা জয়াবর্ধনে (৫৯.১১)।

তাছাড়া অধিনায়ক হিসেবে সোবার্সের ঝুলিতে আছে ১১৭টি উইকেট। উইকেটসংখ্যায় তাঁর উপরে আছেন কেবল ইমরান খান (১৮৭) আর রিচি বেনো (১৩৮)।

এমনকি অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি বল করার রেকর্ডটিও গ্যারি সোবার্সের (১০,৮৬০ টি)! দ্বিতীয় স্থানে থাকা রিচি বেনো (১০,৭২০ টি) ব্যতীত আর কোন অধিনায়কের ১০ হাজারের ওপর বল করার রেকর্ড নেই।

৭.

১৯৭০ সালে সোবার্সের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিল ‘বিশ্ব একাদশ’ নামধারী একটি বহুজাতিক ক্রিকেট দল। সেই দলে ছিলেন গ্রায়েম পোলক, ক্লাইভ লয়েড, জহির আব্বাস, সুনীল গাভাস্কার, মাইক প্রক্টর, ব্যারি রিচার্ডস, বিষেণ সিং বেদীর মত বিশ্বের নামীদামী সব ক্রিকেটার। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হল, সিরিজটি ছিল আন-অফিশিয়াল অর্থাৎ এটির টেস্ট মর্যাদা ছিল না।

লর্ডসে সিরিজের প্রথম ম্যাচেই দেখা মিলেছিল সোবার্স ম্যাজিকের! বাঁহাতি সিম বোলিংয়ে ৬ উইকেট (৬/২১) শিকারের পর ব্যাটিংয়ে নেমে উপহার দেন ১৮৩ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস!

বিশ্ব একাদশ সেবার সিরিজ জিতেছিল ৪-১ ব্যবধানে। সোবার্সের ব্যাট থেকে এসেছিল ৭৩.৫০ গড়ে ৫৭৩ রান আর বল হাতে ২১.৫২ গড়ে শিকার করেছিলেন ২১ উইকেট।

এরপর ১৯৭১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আরও একটি ‘আনঅফিশিয়াল’ সিরিজে বিশ্ব একাদশকে নেতৃত্ব দেন সোবার্স। প্রথম ম্যাচ হারলেও সোবার্সের নেতৃত্বাধীন দলটি সিরিজ জিতেছিল ২-১ ব্যবধানে।

সিরিজের তৃতীয় ম্যাচটা হয়েছিল মেলবোর্নে। যে ম্যাচে কাউন্টার অ্যাটাক স্টাইলে ব্যাট করে সোবার্স খেলেছিলেন ২৫৪ রানের ‘অতিমানবীয়’ এক ইনিংস। যে ইনিংসের কল্যাণে নিশ্চিত হারতে বসা ম্যাচে অবিশ্বাস্য এক জয় ছিনিয়ে এনেছিল তাঁর দল।

এমসিজির বাউন্সি ট্র‍্যাকে সেদিন ডেনিস লিলি, গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জি, বব ম্যাসির মত ফাস্ট বোলারদের পিটিয়ে তুলোধুনো করেছিলেন সোবার্স। তাঁর ভয়ডরহীন স্ট্রোকপ্লে দেখে অভিভূত হয়েছিলেন স্বয়ং ব্র্যাডম্যান!

সোবার্সের ‘এক্সট্রাঅর্ডিনারি’ সেই ইনিংসের বর্ণনা দিতে গিয়ে উইজডেন লিখেছিল, ‘When the ball was up, he drove — with timing and power beyond the capability of lesser men. When it was short and wide, he cut or drove off the backfoot with a ferocity that was primal in beauty and brutality. And when deliveries came rearing into his body, he rocked back to pull and hook, furious and fearless.’

৮.

১৯৭২ সালে কলিন কাউড্রের গড়া টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের (৭৪৫৯) রেকর্ড টপকে যান সোবার্স। যে রেকর্ডটি পরবর্তীতে ভেঙেছিলেন ইংলিশ ওপেনার জিওফ্রে বয়কট।

১৯৭২-৭৩ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোম সিরিজে অধিনায়ক মনোনীত হন রোহান কানহাই। হাঁটুর ইনজুরির কারণে ওই সিরিজে ছিলেন না সোবার্স। পরের বছর কানহাইয়ের নেতৃত্বে শেষবারের মত যান ইংল্যান্ড সফরে।

ভারতীয় অভিনেত্রী অঞ্জু মাহেন্দ্রুর প্রেমে পড়েছিলেন সোবার্স

ক্যারিয়ারের শেষ অ্যাওয়ে সিরিজেও ব্যাটে-বলে যথারীতি উজ্জ্বল ছিলেন স্যার গ্যারি সোবার্স। ৭৬.৫০ গড়ে করেছিলেন ৩০৬ রান আর উইকেট পেয়েছিলেন ১০টা। লর্ডস টেস্টে অপরাজিত ১৫০ রানের ইনিংসটি তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ সেঞ্চুরি।

১৯৭৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজে টেস্ট ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৮০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন সোবার্স। টেস্টে দ্রুততম আট হাজার রানের রেকর্ড (১৫৭ ইনিংস) হিসেবে যা টিকে ছিল দীর্ঘ ২৮ বছর। ২০০২ সালে রেকর্ডটি ভেঙে দেন শচীন টেন্ডুলকার (১৫৪ ইনিংস); বর্তমানে যেটি কুমার সাঙ্গাকারার (১৫২ ইনিংস) দখলে।

তবে একটা জায়গায় সোবার্সকে পেছনে ফেলতে পারেননি কেউই। টেস্টে কমপক্ষে আট হাজার রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সোবার্সের ৫৭.৭৮ গড়ই এখনও অবধি সবার শীর্ষে!

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচটা হয়েছিল পোর্ট অব স্পেনে। ওটাই ছিল সোবার্সের ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট। ডেরেক আন্ডারউডের বলে বোল্ড হবার আগে ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে করেছিলেন ২০ রান। এর আগে বল হাতে নিজের শেষ ইনিংসে নিয়েছিলেন তিন উইকেট।

সোবার্স যখন অবসর নিলেন তখন তিনি টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক (৮০৩২), দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টেস্ট সেঞ্চুরির (২৬) মালিক, দেশের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী (২৩৫) এবং ফিল্ডার হিসেবে তৃতীয় সর্বোচ্চ ক্যাচের (১০৯) মালিক।

আচ্ছা সোবার্স কি কখনো ওয়ানডে খেলেছেন? হ্যাঁ, খেলেছেন। তবে মাত্র একটি, প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড। সে ম্যাচে কোনো রান করতে না পারলেও একটি উইকেট নিয়েছিলেন তিনি।

সোবার্স কেন সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার? একটি পরিসংখ্যান দিচ্ছি। টেস্ট ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় হলেন স্যার গ্যারি সোবার্স যিনি সর্বোচ্চ ৩ বার এক সিরিজে তিন শতাধিক রান এবং ২০ উইকেটের ‘ডাবল’ অর্জনের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন!

  • ১৯৬২ সালে ভারতের বিপক্ষে ৪৭৪ রান এবং ২৩ উইকেট
  • ১৯৬৩ সালের ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৩২ রান এবং ২১ উইকেট।
  • ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৭২২ রান এবং ২০ উইকেট।

টেস্ট ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ৩০০০ রান, ২০০ উইকেট এবং ১০০ ক্যাচের ‘ট্রিপল’ অর্জনের কীর্তিটিও স্যার গ্যারি সোবার্সের। যে রেকর্ডের অংশীদার আর মাত্র তিন জন- স্যার ইয়ান বোথাম, শেন ওয়ার্ন এবং জ্যাক ক্যালিস।

আরেকটি তথ্য জানিয়ে রাখি, ১৯৫৮-১৯৭০ সালের মধ্যে মোট আট বার উইজডেন ‘লিডিং ক্রিকেটার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হন সোবার্স। তাঁর চাইতে বেশিবার বিরল এই সম্মানে ভূষিত হয়েছেন কেবল স্যার ডন ব্র‍্যাডম্যান (১০ বার)!

৯.

টেস্টের মত সোবার্সের ফার্স্ট ক্লাস রেকর্ডও বেশ সমৃদ্ধ। ৩৩৮ টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৫৪.৮৭ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ২৮,৩১৪ রান। সেঞ্চুরি ৮৬টি এবং হাফ সেঞ্চুরি ১২১টি।

উল্লেখ্য, স্বদেশিদের মধ্যে তাঁর চেয়ে বেশি ফার্স্ট ক্লাস হান্ড্রেড আছে শুধুমাত্র ভিভ রিচার্ডস (১১৪টি), গর্ডন গ্রিনিজ (৯২টি) আর আলভিন কালিচরণের (৮৭টি)। এছাড়া বল হাতে ২৭.৭৪ গড়ে সোবার্স নিয়েছেন ১০৪৩টি উইকেট।

অনেকেই হয়ত জানেন, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের একটি ঐতিহাসিক অর্জনের সাথে জড়িয়ে আছে সোবার্সের নাম। ১৯৬৮ সালে ইংলিশ কাউন্টির এক ম্যাচে নটিংহামশায়ারের হয়ে গ্ল্যামারগনের বিপক্ষে এক ওভারে টানা ৬টি ছক্কা হাঁকান সোবার্স। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে যেটি প্রথমবার ঘটেছিল। বোলার ছিলেন ২৩ বছর বয়সী বাঁহাতি পেসার ম্যালকম ন্যাশ।

বিখ্যাত সেই ওভার প্রসঙ্গে হতভাগ্য বোলার ম্যালকম ন্যাশের বক্তব্যটা ছিল এরকম, ‘এটা ছিল কেবলই একটা ওভার। এ নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ নেই। আমি ওটা কখনোই ভুলে যেতে চাই না; বরং এমন একটা কীর্তির অংশ হতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। গ্যারি এমনভাবে পেটাচ্ছিল, আমার আসলে তখন চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না।’

শেষ করব একটি অন্যরকম তথ্য দিয়ে। স্যার গারফিল্ড সোবার্স জন্মেছিলেন দুই হাতে ছয় ছয় বারোটি আঙুল নিয়ে। ছেলেবেলায় এক দুর্ঘটনায় তার এক হাতের অতিরিক্ত আঙুলটি পড়ে যায়। পরবর্তীতে অন্য হাতের আঙুলটিও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কেটে ফেলা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link