চাইলেই একটা কাব্য হতে পারে। কিংবা নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন করার মতো প্রশান্তিও খুঁজে নেওয়া যায়। ভ্যান গগের চিত্রকর্মের দিকে তাকিয়ে যে চোখযুগল বিস্ময়ে মোহিত হয়, সেটিও হতে পারে এবার। ক্রিকেটের ক্ল্যাসিক সৌন্দর্য্য বোধহয় এমনই হয়। যে সৌন্দর্য্যের স্ন্যাপশট-স্বরূপ এবার একটা বিমোহিত চিত্রের দৃশ্যায়ন ঘটালেন সৌম্য সরকার।
অশোকের বলে অফ সাইডে সিঙ্গেল। ৯৯ পেরিয়ে তিন অঙ্কের সেই ম্যাজিক্যাল ফিগার। সেঞ্চুরি। এরপর দিলেন এক লাফ। উল্লসিত সৌম্যর মুখে স্মিত হাসি। ব্যাটের ওপর হেলমেট নিয়ে দুহাতে ধরে করলেন ধ্যানের ভঙ্গি। এমন দৃশ্যের আবর্তন সৌম্যকে যেমন তৃপ্ততা দিয়েছে, তার চেয়ে হয়তো বেশি প্রশান্তি দিয়েছে ক্রিকেটমোদীদের চোখকে। কারণ, নিজের ইনিংসে সৌম্য তো আর দর্শক নন।
পুনর্জীবন তত্ত্বের অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে নেই। তবে বাইশ গজের পৃথিবীতে ফিরে আসার রাজকীয় গল্পের ইতিহাস রয়েছে অনেক। সৌম্য সরকার সেই ইতিহাসই গড়লেন। ফিরলেন। ফেরাটা হলো রাজকীয়। হয়তো ক্যারিয়ারে একটা পুনর্জাগরণের পথও পেয়ে গেলেন তিনি। নেলসনের স্যাক্সটন ওভালে ১৬৯ রানের ইনিংস খেললেন সৌম্য। যে ইনিংসের বর্ণনা একটাই, সৌম্যের সমার্থক রূপের মতোই সুন্দর।
সমালোচনার স্রোত সৌম্যর নিত্যদিনের সঙ্গী। তাতে অবশ্য তাঁর দায়ও কম নেই। ক্যারিয়ারের শুরুটা যেভাবে করেছিলেন, তাতে তাঁকে নিয়ে প্রত্যাশা ছিল তুঙ্গে। কিন্তু শুরুর ছন্দ মিলিয়ে যেতেই এরপর থেকে ক্যারিয়ার গ্রাফ নিম্নগামীই হয়েছে শুধু। নিজের দিনে যেকোনো বোলিংকে উড়িয়ে দিতে পারেন ঠিকই। কিন্তু নিজের সেই দিন আসতো কালেভদ্রেই। আর তাই বাংলাদেশ দলেও তাঁর আসা-যাওয়া হয়েছে নিয়মিত বিরতিতে।
নিউজিল্যান্ড সিরিজ দিয়ে এবার যখন ফিরলেন, তখন আবার ম্যাচহারের খলনায়ক হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁর। ব্যাট হাতে শূন্য রানের ইনিংস দিয়ে শুরু। তারপরও টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থা ছিল। আর সেই আস্থার প্রতিদানই এবার দিলেন সৌম্য। অনেক দিন ধরে পুষে রাখা বারুদের বিস্ফোরণ যেন ঘটলো এই ইনিংস দিয়ে।
যে ইনিংস শুধু একটি ইনিংস নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে তর্কযোগ্যভাবে এই ১৬৯ রানের ইনিংসটিকে সেরার রায়ও দিয়ে দেওয়া যায়। অন্তত বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশি ব্যাটার হিসেবে এটিই তো এখন সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। তবে শুধুই কি বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ? স্যাক্সটন ওভালে খেলা এ ইনিংস দিয়ে সৌম্য ছাড়িয়ে গেছে শচীনকেও। এর আগে শচীনের ১৬৩ রানের ইনিংস ছিল এশিয়ান ব্যাটার হিসেবে নিউজিল্যান্ডে খেলার সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের রেকর্ড। এবার সেই রেকর্ডটিই নিজের করে নিলেন সৌম্য।
নিউজিল্যান্ডে সৌম্যর সুখস্মৃতি ছিল আগেও। তবে সেটি ওয়ানডে ফরম্যাটে নয়। টেস্টে শতক করেছেন, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে ছিল ৫১ রানের দুটি ইনিংস। স্যাক্সটন ওভালে পেয়ে গেলেন ওয়ানডে শতকও। তামিম ইকবাল ও লিটন দাসের পর তৃতীয় বাংলাদেশি হিসেবে পেরোলেন ১৫০ রান। তবে সে সব ছাপিয়ে নজর কাড়লো ক্ল্যাসিক সৌম্যর প্রত্যাবর্তনে। শট, ব্যাটে টাইমিং এবং প্লেসমেন্টে কভার ড্রাইভ কিংবা পুল শট— সৌম্য যেন এ দিন সব কিছুতেই ছিলেন দুর্দান্ত।
বাংলাদেশের ইনিংস এ দিন আক্ষরিক অর্থেই সৌম্যকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছিল। ৮০ রানে ৪ উইকেট হারানো বাংলাদেশের ইনিংস শেষ পর্যন্ত থামে ২৯১ তে। যার মধ্যে ১৬৯ রান একাই করেন সৌম্য। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে সর্বশেষ ব্যাট হাতে পঞ্চাশ পেরিয়েছিলেন এ বাঁহাতি ব্যাটার। প্রায় সাড়ে চার বছর পর অবশেষে আরেকটি ফিফটি যখন পেরোলেন সৌম্য, তখন সেই ইনিংসটি তিনি নিয়ে গেলেন ১৬৯-এ। যেখানে ফিফটি পূরণ করেন ৫৮ বলে। পরে ফিফটি থেকে শতকে পৌঁছাতে খেলেন সেই ৫৮ বলই।
কিন্তু সেঞ্চুরি পেরোতেই এ এক অন্য সৌম্যর দর্শন। ইনিংসের তৃতীয় ফিফটিতে পৌঁছাতে খেললেন মাত্র ২৮ বল। বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে ব্যক্তিগত সংগ্রহের দিক দিয়ে লিটন দাসের রেকর্ডটা ভাঙার পথেই ছিলেন। তবে ১৬৯-এ শেষমেশ থামতে হয় তাঁকে। এই রেকর্ডটা হয়তো ছোঁয়া হলো না। তবে এই এক ইনিংস দিয়েই তো এশিয়ান ব্যাটার হিসেবে কিউই দূর্গে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস, বাঁহাতি ব্যাটার হিসেবে বাংলাদেশির সর্বোচ্চ রানের ইনিংস, একই সাথে বিদেশের মাটিতে খেলা সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের রেকর্ডও নিজের করে নিলেন সৌম্য।
সৌম্য ফিরলেন। তবে ফেরার এই গল্পের আর পুনরাবৃত্তি নয়, এবার চাই ধাবাবাহিক সৌম্যের আগ্রাসী পথচলা। যে বৃত্তে সৌম্য বাংলাদেশকে স্বপ্ন দেখাবেন দিন বদলের কিংবা বিশ্বজয়ের।