ছোট্ট একটা টিনের ছাউনি দেওয়া বাড়ি।
বাড়ির সামনে একটা উপন্যাসের মতো বটগাছ। বাড়ির দরজা হাট করে খোলা। দুটো ভিনদেশি লোক সেই দরজায় ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে উপস্থিত দেখে ভেতরে খবর গেল। আটপৌঢ়ে পোশাক পরা একজন মায়াবী চেহারার নারী ছুটে এলেন, ‘তোমরা কারা বাবা? ভেতরে এসো।’
তখনো তিনি পরিচয় জানেন না, কোত্থেকে আসছি তাও জানেন না, অথচ বলছেন—ভেতরে এসো!
ভেতরে ঢুকে নিজেদের ওজন বাড়াতে একটু পরিচয়টাও বাড়িয়ে বললাম, ‘আমি কৌশিকের বন্ধু। আমরা ঢাকা থেকে এসেছি।’
সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলা চিৎকার শুরু করলেন, ‘ওরে আমার কপাল। তুমি কৌশিকের বন্ধু? ওরে, কে আছিস। তাড়াতাড়ি আয়। বাবার ব্যাগটা ভেতরে রাখ। বাবা তোমরা এদিকে এসো। একটু হাত-মুখ ধুয়ে নাও। বাবা, কিছু খাও। এই খাটে শুয়ে পড়তে পারো। ইস, মুখটা কাল হয়ে গেছে। পথে খুব কষ্ট হয়েছে?’
আমার মা সেই দূর আকাশের তারা হয়ে গেছেন অনেক কাল হলো। আগে ঢাকা থেকে মাসে, দুই মাসে বাড়ি ফিরতাম-এমনটা অভ্যেস ছিল। তারপর কতগুলো বছর হয়ে গেল, এই কথাগুলো শুনি না। আমি তখন কীভাবে এই বেয়াড়া চোখের জল সামলাই। এক অচেনা-অজানা ভদ্রমহিলা এক লহমায় আমার মায়ের প্রতিরূপ হয়ে আমাকে শাসন শুরু করলেন, আদর শুরু করলেন। বুড়ো বয়সে স্রষ্টা আমার জন্য নড়াইলে এই মায়াটুকু রেখে দিয়েছিলেন।
চোখে জল এনে দেওয়া এই মায়ের নাম হামিদা মুর্তজা, ওরফে বলাকা।
একটু যারা খোঁজখবর রাখেন তারা বুঝতে পারছেন এই মা আসলে মাশরাফি বিন মুর্তজার মা। তবে বর্ণনাটা পড়ে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে, মাশরাফির একার মা কেবল এমন মায়াবী, এমন আদর করেন সকলকে। এই ক্ষুদ্র সাংবাদিকতা জীবনে যে ক’জন তারকার মায়ের কাছাকাছি যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, বিস্ময়ের সাথে আবিস্কার করেছি ছেলের জন্য, ছেলের বন্ধুদের জন্য এবং এমন হঠাৎ সামনে এসে পড়া ছেলেদের জন্য সবার বুকেই জমে রয়েছে এমন ভালোবাসা।
অনেক আগের কথা। কার্ডিফ-ম্যানচেস্টার তাণ্ডব চালিয়ে মোহাম্মদ আশরাফুল তখন নতুন করে নিজেকে চেনাচ্ছেন। টেস্টের কনিষ্ঠতম এই সেঞ্চুরিয়ান তখন মাইকেল শুমাখার, শচীন টেন্ডুলকারদের সাথে ক্রীড়াবিশ্বের প্রতীক হয়ে উঠছেন। সেই সময়ে আশরাফুলের বাড়ি গিয়েছিলাম, তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে একটি ফিচার করার নেশায়। ফিরে এসে যেটা লিখলাম, তা দাঁড়ালো—আশরাফুলের মা!
এই লেখাটা সাংবাদিক হিসেবে বা গদ্যকার হিসেবে আমাকে একটু পায়ের নিচে মাটি তৈরি করে দিয়েছিল। আমার মতো নির্লজ্জ মানুষের কানও সেদিন লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল। ঘোর লাগা চোখে দেখেছিলাম, আনিসুল হক এই লেখাটা পড়ে গোটা গোটা হরফে লিখছেন, ‘দেবুর একটা সোনার কলম আছে। আমার ইচ্ছে কলমটা চুরি করার…’
ফলে ওই লেখাটা আমার আর ভোলার নয়। ওই লেখা আমাকে অনেক দুয়ার খুলে দিয়েছিলো। তার চেয়ে বেশি করে সেই প্রথম টের পেয়েছিলাম, একজন মহাতারকার মায়ের চিন্তাটা কেমন হতে পারে।
আশরাফুলের মা-ই প্রথম আমাকে কথাটি বলেছিলেন, ‘ওর খেলা দেখতে ভয় লাগে। সবাই ওর রান করা দেখে আনন্দ পায়, আমার ভয় করে—বল যদি শরীরে লাগে! ও লাফ দিলেই ভয় হয়।’
এই একটা জায়গায় দুনিয়ার বাকি সব দর্শকের চেয়ে একজন তারকা খেলোয়াড়ের মা ভিন্ন হয়ে ওঠেন। এরপর যত জন তারকার মায়ের মুখোমুখী হয়েছি এই কথাটি তোলার চেষ্টা করেছি। দেখেছি, কোনো মা আসলে মাথা ঠাণ্ডা করে ছেলের খেলা দেখতে পারেন না।
সাকিব আল হাসানের মা শিরিন আখতারের কথাই ধরুন।
মাঠে গিয়ে ছেলের খেলা দেখতে চান না। টেনশন সহ্য হয় না। সাকিবের বাবা, বোন, স্ত্রী সবাই মাঠে বা টিভিতে হইচই করে খেলা দেখেন, শিরিন আখতার এই হইচই করতে পারেন না। কেবলই টেনশন হয় তার। প্রথম সাকিবের খেলা টিভিতে দেখার কথা বলতে গিয়ে বলছিলেন, ‘একবার সাকিব আমাকে ফোন করে জানালো সে ফাস্ট ডিভিশন (প্রিমিয়ার লিগ) খেলবে। তাই শুনে তো আমি খুব খুশি হলাম। কারণ উজ্জ্বল ফুটবল খেলে (সাবেক জাতীয় ফুটবল তারকা মেহেদী হাসান উজ্জ্বল)। উজ্জ্বলের খেলা টিভিতে দেখা যায়। তখন আমি খুব আনন্দের সঙ্গে বলছিলাম এইতো আর কিছুদিন পর আমাদের ফয়সালকেও দেখা যাবে। টিভিতে আমরা খেলা দেখবো। তখন তো খেলা দেখা যায়নি। পরে সাকিবের যখন অভিষেক হয় জিম্বাবুয়েতে তখন তাকে দেখতে পাই। তবে তিন ম্যাচে তাকে মাঠে নামায়নি। চতুর্থ ম্যাচে সাকিবকে মাঠে নামাবে যখন তখন আমি টিভিতে দেখছি। ওই অভিষেক খেলা যখন দেখি তখন আমার গা, হাত-পা কাঁপা শুরু হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। রাত্রিতে আর ঘুম হয়নি। দোয়া কালাম পড়তে লাগলাম সবাই। সবাই বসে খেলা দেখলাম। আমার খুব ভয় করছিল। বুকের ভেতর খুব কাঁপছিল। আনন্দ হচ্ছিল আবার ভয়ও হচ্ছিল।’
এই আনন্দ আর ভয়ের কথা ঠিক একই ভঙ্গিতে বলছিলেন সাবিনা ইয়াসমিনও, তাসকিন আহমেদের মা।
তাসকিন যখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে অ্যাকশনের কারণে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ফিরেছিলেন, ওদের জাকির হোসেন রোডের বাসায় গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, তাসকিনের সাথে কথা বলে বেদনার একটা ফিচার করবো।
তাসকিনের মান ‘বেদনা’ টের পেতে দিলেন না। ছেলের পছন্দের মানুষ শুনে ছেলের মতই যত্ন করলেন, খাওয়ালেন এবং সেই মাতৃরূপ সামনে নিয়ে এলেন। আমিও সেই সুযোগে প্রশ্নটা করলাম-ছেলের খেলা দেখতে কেমন লাগে?
সাবিনা ইয়াসমিন সেদিন ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছিলেন, ‘সত্যিই ছেলের খেলা দেখতে ভয় লাগে। যদি ছেলেটা ব্যাথা পায়।’
এই একটা জায়গায় তারা সবাই এক। আশরাফুলের আদরের মা, সাকিব আল হাসানের প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মা, তাসকিন আহমেদের আমুদে মা কিংবা মাশরাফি বিন মুর্তজার মমতাময়ী আকাশের মতো উদার মা, সবাই একটা জায়গায় এক—ছেলেটাকে ডানার নিচেই আগলে রাখতে চান।
মা তো আর আলাদা হয় না! মা তো একটাই শব্দ!