অজি স্পিরিট বলে ক্রিকেট পাড়ায় একটা শব্দের চল আছে। কিন্তু ফুটবল মাঠে এত দিনে সেই শব্দের সামান্য প্রতিফলনও দেখাতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপ ফুটবলে ঠিকই খেলে, কিন্তু টুর্নামেন্ট শেষে সেটা শুধু অংশগ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে এবারের বিশ্বকাপে দলের মাঝে লড়াকু মানসিকতাকে পুঁজি করে কাতারে এসেছিলেন কোচ গ্রাহাম আরনল্ড।
আর সেই মানসিকতাতেই মাঠের খেলায় প্রমাণ করে চমকে দিল ক্যাঙ্গারুজরা। ইউরোপের নতুন ডার্কহর্স ডেনমার্ককে ১-০ গোলে হারিয়ে দীর্ঘ ১৬ বছর পর দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত করলো তারা।২০০৬ বিশ্বকাপে গুস হিডিংকের সহকারী হিসেবে অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে ছিলেন গ্রাহাম আরনল্ড। সেবারই প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকিট পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ১৬ বছর পর, এবার প্রধান কোচ হিসেবে সেই সাফল্যকেই স্পর্শ করলেন গ্রাহাম আরনল্ড।
তবে তাঁর জন্য তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে বেশ খানিকটা কঠিন পথ। অস্ট্রেলিয়ার সাথে গ্রুপ ডি তে ছিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স, ইউরোপের নতুন শক্তি ডেনমার্ক আর আফ্রিকান জায়ান্ট তিউনিশিয়া। এমন দলের ভিতরে অস্ট্রেলিয়ায় একমাত্র দল ছিল যাদের কাতার বিশ্বকাপ নিশ্চিত হয়েছিল প্লে অফের মাধ্যমে। সে গল্পে পরে ফেরা যাক। আপাতত দৃষ্টি দেওয়া যাক, কিভাবে গ্রাহাম আরনল্ডের মুনশিয়ানায় শেষ ১৬ নিশ্চিত করলো অস্ট্রেলিয়া।
গ্রুপ পর্বের খেলায় অস্ট্রেলিয়ার প্রথম প্রতিপক্ষ ছিল ফ্রান্স। স্বাভাবিক ভাবেই আন্ডারডগ হিসেবে মাঠে নেমেছিল অজিরা। তবে খেলতে নেমেই ফ্রান্সের জালে বল জড়িয়ে এগিয়ে যায় তারা। ইতিহাসের দুষ্টচক্রে পড়ে কি তবে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের সাথে আবারো কোনো অঘটন? এমন একটা প্রশ্ন তখন ছুঁড়েই দিয়েছিল আরনল্ডের দল। তবে শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি। ফ্রান্সের ঘুরে দাঁড়াতে খুব সময় লাগেনি। গুণে গুণে চার গোল দিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে নিমেষেই উড়িয়ে দেয় ফ্রান্স।
প্রথম ম্যাচ হেরে স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। এক যুগ ধরে বিশ্বকাপে কোনো ম্যাচে জয় নেই। একই সাথে টানা তিন আসরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ার তিক্ত এক অভিজ্ঞতা ছিল অজিদের। আর সেটিই যেন তাঁতিয়ে দেয় আরনল্ড শিষ্যদের। বৃত্ত ভাঙার চ্যালেঞ্জে পরের ম্যাচে তিউনিশিয়াকে হারিয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়া। বহুল প্রতীক্ষিত জয়। একই সাথে ঐ ম্যাচ জয়েই পরের রাউন্ডে যাওয়ার দারুণ একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায় ক্যাঙ্গারুজদের। তবে সেই পথে বাঁধার নাম ছিল ডেনমার্ক।
গতবারের ইউরোতে যারা ছিল সেমিফাইনালিস্ট দল। তাছাড়া তরুণ আর অভিজ্ঞতার মিশেলে দারুণ এক দল হয়ে উঠেছিল ডেনমার্ক। কিন্তু স্বপ্নযাত্রায় যাদের চোখ ঐ দূর সীমানায়, তাদের কি আর এসব বাঁধা দমাতে পারে! ডেনমার্ক ম্যাচে ড্র হলেই চলতো অস্ট্রেলিয়ার। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া সেকেন্ড রাউন্ড নিশ্চিত করলো সরাসরি ম্যাচজয়ের মাধ্যমে। আর অজিদের এই পুনরজ্জীবিত হওয়ার নেপথ্যে ছিলেন গ্রাহাম আরনল্ড। তাঁর হাত ধরে বাছাই পর্বে অস্ট্রেলিয়া কিভাবে জেগে উঠেছিল সেই গল্পে এবার ফেরা যাক।
বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে শুরুটা ভালই হয়েছিল অজিদের। টানা ৮ ম্যাচ জিতেছিল তারা। তবে তৃতীয় রাউন্ডে গ্রুপ বি’র পয়েন্ট তালিকায় সৌদি আরব আর জাপানের পিছনে থাকায় বিশ্বকাপে সরাসরি সুযোগ হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। তবে এশীয় প্লে-অফে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে হারিয়ে সেই আশা জিইয়ে রাখে আরনল্ডের দল। এরপর আন্তঃমহাদেশীয় প্লে অফে মুখোমুখি হয়ে পেরুর বিপক্ষে। আর সেই ম্যাচে টাই ব্রেকারে জিতে কাতার বিশ্বকাপের টিকিট নিশ্চিত করে সকারুরা।
সেদিন শেষ মুহূর্তে গোলরক্ষক এন্ড্রু রেডমেইনকে নামিয়ে চমক দেখিয়েছিলেন আরনল্ড। কারণ রেডমেইন মূলত পেনাল্টি স্পেশালিস্ট ছিলেন। আর কোচের আস্থার প্রতিদানও দেন রেডমেইন। পেনাল্টি ঠেকিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে যান বিশ্বকাপে।
আর কাতার বিশ্বকাপে আসার পর বাকিটা তো ইতিহাস। দীর্ঘ ১৬ বছর পর প্রথম রাউন্ড টপকে দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত করলো দলটা। তাতে দল হিসেবে অস্ট্রেলিয়া যতটা দুর্দান্ত খেললো তার আড়ালের নায়ক ছিলেন কোচ গ্রাহাম আরনল্ড। অস্ট্রেলিয়ার সাথে এর আগে তিনটি মেয়াদে কাজ করেছিলেন। তবে ২০১৮ সালে দায়িত্ব নেন প্রধান কোচ হিসেবে।
তার আগে ঘরোয়া ফুটবল ক্লাব সিডনি এফ সি’র কোচ হিসেবে ছিলেন আরনল্ড। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার অনূর্ধ্ব-২৩ দলের দায়িত্বেও তিনি ছিলেন। আর খেলোয়াড়ী জীবনে ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ এক যুগ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলেছেন।
খেলোয়াড়ী জীবন, সাথে চলমান কোচিং ক্যারিয়ার, সব মিলিয়ে গ্রাহাম আরনল্ডের ক্যারিয়ারটা বেশ সমৃদ্ধ। আর এবার তো, অস্ট্রেলিয়াকে সেকেন্ড রাউন্ডে তুলে নিজের অর্জনের খাতায় আরেকটি পালক যুক্ত করলেন। অস্ট্রেলিয়া যেভাবে সেকেন্ড রাউন্ডে গেল তাতে তাদের ইতিহাসের সেরা সাফল্য এবারেই মিলল। অবশ্য সেটা ছাড়িয়ে সুযোগ এখনো রয়েছে।
রাউন্ড অফ সিক্সটিনে তাদের প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা। শক্তিমত্তায় আর্জেন্টিনা ঢের এগিয়ে। তবে অজিরাও তো আর অল্পেই থেমে যাওয়ার মতো দল না। তিউনিশিয়া, ডেনমার্কদের মতো দলদের হটিয়েই তারা শেষ ১৬ নিশ্চিত করেছে। এখন দেখার পালা শেষ পর্যন্ত অজি সকারুদের দৌড় এবার কোথায় গিয়ে থামে। তবে গ্রাহামের কণ্ঠে সম্ভবত থামার কোনো সুর নেই। রূপকথার গল্পে চড়ে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার পথে তারা নিশ্চিতভাবেই দৃঢ়প্রত্যয়ী থাকবে। কারণ অজিদের স্পিরিটে আত্মতুষ্টি বলে কোনো শব্দ নেই।