সে এক পাঠান সাহেবের গল্প

২০০৮ সালের ঘটনা।

বাংলাদেশের সাথে ভারত ও পাকিস্তানকে নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে কিটপ্লাই কাপ। চোখের সামনে তারা দেখার এক বিরাট আয়োজন। সৌরভ-শচীনরা নেই। তারপরও তারকার অভাব নেই। যুবরাজ সিং, মহেন্দ্র সিং ধোনি, মিসবাহ-উল-হক, মোহাম্মদ ইউসুফ, ইউনুস খান; যেদিকে তাকাই, আকাশ থেকে নেমে আসা তারার সারি।

হোটেলের লবিতে ঘুরি আর একটা ছোট ইন্টারভিউয়ের চেষ্টা করি। একেবারে বিফল হচ্ছি, তা নয়। ইউসুফ পাঠান ও ইরফান পাঠানকে একসাথে পেয়েছিলাম; ভাইদের নিয়ে একটা স্টোরি হয়েছিলো। কিন্তু সেদিন সকাল থেকে ভাগ্য বড় খারাপ।

কোনো তারকা কথা বলতে চাইছেন না। কেউ ভদ্রভাবে, কেউ সপাটে ‘না’ বলে দিচ্ছেন। বীরেন্দর শেবাগ এফ অক্ষরের ছোট্ট একটা প্রীতিসূচক সম্বোধনও করলেন!

মনটা খারাপ করে লবির দিকে চেয়ে আছি। বুঝতে পারছি, আজ আর কিছু জুটবে না। ঠিক এমন সময় কাঁধের ওপর কে যেনো হাত রাখলো। পেছন ফিরতেই লোকটা বললেন, ‘কাকে খুজছ? ইন্টারভিউ খুজছ?’

পেছন ফিরে হতভম্ব হয়ে গেলাম-শহীদ আফ্রিদি।

হ্যাঁ, সাহিবজাদা মোহাম্মদ শহীদ খান আফ্রিদি। কেউ বলেন, বুম বুম আফ্রিদি। কেউ বলেন, নাচুনে আফ্রিদি। কারো কাছে তিনি এখনও হিরো। কারো কাছে বোকাটে মানুষটা। কারো কাছে তিনি ক্রিকেটের কিংবদন্তি। কারো কাছে তিনি প্রতিভার অপচয় মাত্র। আবার কারো কাছে তিনি স্রেফ ট্রলের বিষয়বস্তু।

আফ্রিদি আসলে কে, এ নিয়ে সেমিনার আয়োজন করে বিতর্ক করা যেতে পারে। তাও সম্ভবত বোঝা যাবে না যে, তার জন্য মানানসই বিশেষনটা কী। এই মানুষটার সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসা খুব কঠিন। এই ক্রিকেটারের কতটুকু সত্যি এবং কতটুকু হাইপ; সেটাও বোঝা কঠিন।

তবে আমি একবাক্যে বলতে পারি, সমসাময়িক ক্রিকেট দুনিয়ার সবচেয়ে সরল মনের মানুষদের একজন শহীদ খান আফ্রিদি। সবচেয়ে বন্ধুবৎসল মানুষদের একজন শহীদ খান আফ্রিদি।

এই গুনটা আসলে আফ্রিদি নিয়ে এসেছেন তার গোত্র থেকে।

খাইবার এজেন্সির একেবারে আফগান সীমান্তে জন্ম তার। আফ্রিদির বয়স যখন দশ, তখন থেকে তিনি বন্দুক চালাতে পারেন। এখনও পাশতুনে গেলে ঐতিহ্যমত এম-সিক্সটিন বন্দুক নিয়ে মহড়া দেন। জাত পাঠানের মতো বলেন, ‘আমরা ভালোবাসতে জানি এবং লড়াই করতে জানি।’

আফ্রিদির জন্ম এক পশতুন গোত্রে। মূলত আমরা যে নামটি জানি, সেই ‘আফ্রিদি’ হলো গোত্রের নাম। তার নিজের নাম শহীদ খান। সুফী শিক্ষকদের এক বংশে জন্ম তার। তার দাদা মাওলানা মোহাম্মদ ইলিয়াস একজন নামকরা সুফী দার্শনিক ও গোত্রনেতা। নানা প্রথম কাশ্মীর যুদ্ধের সৈনিক হিসেবে ‘গাজী-ই-কাশ্মীর’ খেতাব পেয়েছিলেন।

অমন এক পরিবার থেকে উঠে এসে ক্রিকেটার হওয়াটা প্রায় অসম্ভব ছিলো। আফ্রিদি গোত্রের লোকেরা একসময় যুদ্ধবাজ ছিলো। এই গোত্রের লোকেরা হয় যুদ্ধ করতো, নইলে পন্ডিত হিসেবে কাজ করতো। কালের বিবর্তনে আফ্রিদিরা মূলত সেনাবাহিনীর চাকরি ও ব্যবসায় ঝুকে পড়ে। ফলে ক্রিকেট তাদের সিলেবাসে ছিলো না।

শহীদ আফ্রিদির এক সেনা কর্মকর্তা চাচা বাড়িতে ফিরে ক্রিকেট চেনালেন। আফ্রিদির বড় ভাই খেলাও শুরু করেছিলেন। কিন্তু ইনজুরির জন্য তিনি পেরে ওঠেননি। সেই প্রেমটা আচ্ছন্ন করে ফেলে শহীদ আফ্রিদিকে।

করাচিতে স্থানান্তরিত হন আফ্রিদিরা। যে গলিতে থাকতেন, সেখানে ছিলো আশির দশকের নামকরা ব্যাটসম্যান হারুন রশিদের বাসা। এই হারুন রশিদকে দেখে ক্রিকেটে উৎসাহী হলেন আফ্রিদি। কিন্তু নিজে ব্যাটসম্যান না হয়ে হলেন লেগস্পিনার।

হ্যাঁ, এটাই আফ্রিদির জীবনের রহস্যের শুরু।

এখান থেকেই প্রশ্নটা শুরু হলো, তার ক্রিকেটে প্লেয়িং রোলটা আসলে কী? একজন ভবিষ্যত মুশতাক পাওয়ার জন্য লেগি আফ্রিদিকে দলে ডাকা হয়েছিলো। কিন্তু নিজের প্রথম ব্যাট হাতে মাঠে নামার সুযোগেই বিশ্বরেকর্ড করা সেঞ্চুরি করে পরিচয়টা বদলে ফেললেন।

খুব দ্রুত তাঁর পরিচয় হয়ে গেলো বুম বুম আফ্রিদি।

এখন মুশকিল হলো, পাকিস্তান ম্যানেজমেন্ট এই দীর্ঘকালে কখনো আফ্রিদির এই ব্যাটিংকে প্রমোট করতে পারেনি। বীরেন্দর শেবাগ, ম্যাথু হেইডেন বা জয়াসুরিয়া যে সাপোর্ট ম্যানেজমেন্ট থেকে পেয়েছেন, তা আফ্রিদি পাননি। তাকে বলা হয়েছে-আন কোচেবেল।

তা তো বটেই, এরকম সহজাত প্রতিভাকে আপনি কোচিংয়ের ফরম্যাটে ঢোকাবেন কি করে! তাকে তো তার মত খেলতে দিতে হবে। একমাত্র বব উলমার ছাড়া কেউ আফ্রিদির ব্যবহারটাই তাই ঠিকমত করতে পারলেন না। ফলে খুব স্থায়ী হয়ে ওঠা হয়নি, খুব ভরসার নাম তার হয়ে ওঠা হয়নি। শর্টার ফরম্যাটে ঠাই হয়েছে নিয়মিত, লঙ্গার ফরম্যাটে যাওয়া আসার মধ্যে থেকেছেন।

এর মধ্যে ওয়ানডেতে ৮ হাজারের ওপরে রান করেছেন। টেস্টে দারুন কিছু ইনিংস আছে তার। যদিও আফ্রিদি এখনও বলেন, তিনি নিজেকে ‘বেটার বোলার’ মনে করেন।

অধিনায়কত্ব করেছেন কিছুদিন; একদমই গোছানো ছিলেন না। বরং বিভিন্ন সময় হাস্যকর সব কান্ড করেছেন। কখনো বল কামড়ে ধরে টেম্পারিংয়ের অভিযোগে পড়েছেন, কখনো সতীর্থদের সাথে ঝামেলা বাঁধিয়েছেন। সবমিলিয়ে যে অসীম প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন, তার প্রকাশ কিছুতেই করতে পারেননি। বলা ভালো এই সরল পাঠান ছেলেটিকে কেউ গুছিয়ে ব্যবহার করতে পারলো না।

বারবার অবসর নিয়েছেন, ফিরে এসেছেন। এই করতে করতে কাগজ কলমেই বয়স কখন যেনো ৪৫-৪৬ হয়ে গেছে। এখনও টি-টেন থেকে শুরু করে নানারকম ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন। এখনও পৃথিবীর কোথাও না কোথাও বুম বুম আফ্রিদি নামে স্লোগান ওঠে।

সেই সাথে কী একটা আফসোসে বুকটা মুচড়েও ওঠে না? মনে হয় না যে, লোকটা প্রাপ্য পেলো না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link