শাহীন আফ্রিদি, আগুন পাখির ডানায় ভর

বেশ কয়েক বছর আগের কথা।

পাকিস্তানের প্রত্যন্ত এলাকার গল্প। এক বড় ভাই তাঁর ছোট ভাইকে ক্রিকেট বল হাতে তুলে দিলেন। বড় ভাই নিজেই পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে দীর্ঘদিন খেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি তিনি! তাই তিনি চাইতেন তার যে স্বপ্নটা পূরণ হয়নি, সেটি তাঁর ছোট ভাই পূরণ করবে। তাঁর ছোট ভাই পাকিস্তান দলের জন্য খেলবে।

কিন্তু, ঘটনায় টুইস্ট অন্য জায়গায়। তাঁর ছোট ভাই কখনো ক্রিকেট বল হাতে পর্যন্ত নেয়নি! টেনিস বলে ক্রিকেট খেলতো সে। লান্ডি কোতালের শহরে পাহাড়ের নিচে বেড়ে ওঠা সেই ছোট ছেলেটিই আজকের শাহিন শাহ আফ্রিদি।

শাহীন শাহ আফ্রিদির ক্রিকেটের সফরটা তার বড় ভাই রিয়াজ আফ্রিদির হাত ধরেই শুরু। রিয়াজ আফ্রিদি একজন পেসার ছিলেন এবং সেই সাথে ক্রিকেটের প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক! ২০০৪ সালে পাকিস্তানের পক্ষে একটি টেস্ট ম্যাচও খেলেন রিয়াজ । কিন্তু রিয়াজ আফ্রিদি বেশি দিন পাকিস্তান ক্রিকেট দলের হয়ে খেলতে পারেনি! সেই অধরা স্বপ্ন পূরণ করতে সেখান থেকেই ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হয় শাহিন শাহ আফ্রিদির।

২০০০ সালে জন্ম শাহিনের। খাইবারপাকতুনওয়ার লান্ডি কোতালে বেড়ে ওঠেন তিনি। এই জায়গাটি পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সীমান্তের অনেকটাই কাছাকাছি! সাত ভাইর মধ্যে সবচেয়ে ছোট শাহিন। তার মেন্টর রিয়াজ আফ্রিদি সাত ভাইর মধ্যে সবচেয়ে বড়। লান্ডি কোতালের একটি ক্রিকেট মাঠ থেকে শাহিনের ক্রিকেট যাত্রা শুরু হয়। বড় ভাই রিয়াজ আফ্রিদির সাথে টেনিস বল দিয়েই অনুশীলন করতেন শাহিন।

বড় ভাই রিয়াজ আফ্রিদি যখন দেখলো তার ছোট ভাই টেনিস বলে দুর্দান্ত বল করছেন, তখনি তিনি ভেবে ফেলেছিলেন ক্রিকেট বলে খেললে শাহিন আফ্রিদি নিজেকে অনেক উপরে নিয়ে যেতে পারবেন। এরপর থেকেই রিয়াজ আফ্রিদি শাহিনকে অনুপ্রেরণা আর সাহস যোগাতে থাকে। দুই ভাইয়ের মধ্যে ১৫ বছরের বয়সের ব্যবধান ছিল! রিয়াজ আফ্রিদির ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা দেখেই শাহিনের মনে ক্রিকেটের প্রতি স্বপ্ন জন্মে।

লান্ডি কোতালের পাহাড়ের পাদদেশে সে জায়গায় ক্রিকেটের তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। দুই ভাই যেখানেই সুযোগ পেতেন ক্রিকেট খেলা শুরু করে দিতেন। পড়ালেখায় শাহিনের কোনো মনযোগই ছিল না, শাহিন শুধু পাকিস্তান জাতীয় দলে নিজের নাম বড় করতে চেয়েছিলেন। ১৪ বছর বয়সেই নিজের বাবা-মাকে ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্নের কথাটা জানিয়ে দেন শাহিন। শাহিনের বাবা প্রথমে ভেবেছিল ছেলের সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। কিন্তু বড় রিয়াজ আফ্রিদি শাহিনকে শুরু থেকেই পুরোদস্তুর সাপোর্ট করেন। তার প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম দেখে একটা সময় শাহিনের পুরো ফ্যামিলিই বুঝতে পারে যে শাহিনকে ক্রিকেট খেলতে দেয়া উচিত।

শাহিন শাহ আফ্রিদি জানতেন পাকিস্তান জাতীয় দল পর্যন্ত রাস্তাটা তার জন্য নেহায়েত সহজ নয়। সে রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁছুতে তাকে বেশ পরিশ্রম করতে হবে, অনেক ভালো পারফরম্যান্স করতে হবে। এই কথা মাথায় রেখে শাহিন প্রথম দিন থেকেই কঠোর পরিশ্রম করা শুরু করেন।

লান্ডি কোতালে থাকলে তার ক্রিকেটে উন্নতি হবে না, সেটা ভেবেই শাহীন তাঁর ভাইয়ের পরামর্শে তখন পেশোয়ারে চলে যান। এরপর সেখানে খান ল্যাবরেটরিজ নামে একটি ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হয়ে যান। সেখানেই তিনি তার স্কিল ডেভেলপমেন্ট শুরু করেন।

পেশোয়ারে শাহিন ল্যাবরেটরিজ ক্লাবে একজন পেসার হিসেবে খেলা শুরু করেন। তার দীর্ঘ শারীরিক গড়ন, আর গতির জন্য বাকি পেসারদের থেকে তাকে বেশ আলাদাই দেখাতো৷ সেই ক্লাবে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করার পর শাহিন সুযোগ পেয়ে গেলেন লাহোর ক্রিকেট একাডেমিতে।

রিয়াজ আফ্রিদি সব সময়ই ফোনে শাহিনকে পরামর্শ দিতেন। বড় ভাইর পরামর্শেই শাহিনের পারফরম্যান্সে আরো উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। ২০১৫ সালে শাহিন শাহ অনূর্ধ্ব-১৫ ক্রিকেটের জন্য ট্রায়াল দেন আর পেয়ে যান সুযোগ! সেখান থেকেই তার পাকিস্তান ক্রিকেটের যাত্রার শুরু।

২০১৫ সালেই প্রফেশনাল ক্রিকেটে নিজের প্রথম সাফল্য পান শাহিন। অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত সিরিজে অনূর্ধ্ব-১৬ দলের হয়ে সুযোগ পেয়ে গেলেন তিনি। সেবার ২-১ এ অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সিরিজ জয় করে পাকিস্তান! সেই সিরিজে শাহিন আফ্রিদি বল হাতে দলকে দারুন শক্তি আর সাপোর্ট যোগায়। তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স নির্বাচকদেরও নজর কাড়ে!

সেখান থেকেই সরাসরি সুযোগ পেয়ে গেলেন অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে এশিয়া কাপ খেলেন শাহিন! শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ২৭ রানে তিন উইকেট লাভ করেন শাহিন! তার এই পারফরম্যান্সের পর অনেকেই বলেছিলেন তিনি হবেন পাকিস্তান ক্রিকেটের ‘নেক্সট বিগ থিঙ’!

পাকিস্তান জাতীয় দলের সাবেক স্পিনার মুশতাক আহমেদ তখন লাহোর ক্রিকেট একাডেমির হেড কোচ ছিলেন। শাহিন শাহের বোলিং পারফরম্যান্স দেখে বেশ মুগ্ধ হয়েছিলেন মুশতাক। এরপর তিনি শাহিন আফ্রিদির বোলিংয়ের কিছু ক্লিপ লঙ্কান কিংবদন্তি কুমার সাঙ্গাকারাকে পাঠান! সেই ক্লিপে শাহিনের বোলিং দেখে সাঙ্গাকারা নিজেও বেশ মুগ্ধ হন! তিনি এতোটাই মুগ্ধ হন যে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) ঢাকা ডাইনামাইটসের হয়ে খেলার সুযোগ করে দেন শাহিনকে।

কোনো ধরনের ঘরোয়া ক্রিকেট না খেলেই সরাসরি ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার সুযোগ পান শাহিন! ঢাকা ডাইনামাইটসের হয়ে দুই বছর খেলেন শাহিন। তবে এই সফরটা বেশি লম্বা হয়নি তার!

২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, পাকিস্তানের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে নিজের অভিষেক ম্যাচ খেলেন শাহিন। সেই ম্যাচে ৩৯ রানের বিনিময়ে ৮ উইকেট শিকার করেন তিনি! প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে পাকিস্তানের হয়ে অভিষেকে তিনি সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ড গড়েন! এই পারফরম্যান্সের পর পুরো পাকিস্তানেই সাড়া ফেলে দেন শাহিন। ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে মাত্র ৩৯ রানের বিনিময়ে ৮ উইকেট নেওয়ায় বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি।

এরপর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও পাকিস্তানের হয়ে খেলার ডাক পেয়ে গেলেন শাহিন! সেই টুর্নামেন্টে ১২ উইকেট শিকার করেন তিনি। তার এমন অসাধারণ পারফরম্যান্সের পর আইসিসি তাকে ‘রাইজিং স্টার অফ দ্য স্কোয়াড’ পুরস্কার দেয়।

২০১৮ সালে শাহিন শাহ আফ্রিদির পাকিস্তান সুপার লিগে (পিএসএল) লাহোর কালান্দাসের হয়ে অভিষেক হয়। সেই ম্যাচে মাত্র চার রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট লাভ করেন তিনি! সেই বছরই পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয় শাহিন আফ্রিদির। তিনি তার ক্যারিয়ারের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ উইন্ডিজ এবং প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন আফগানিস্তানের বিপক্ষে।

২০১৮ সালেই টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয় শাহিনের! এরপর ২০১৯ বিশ্বকাপে শাহিন এমন রেকর্ড গড়েন যা পাকিস্তানি গ্রেট ওয়াসিম আকরামও করতে পারেননি। বাংলাদেশের বিপক্ষে সেই টুর্নামেন্টে শাহিন আফ্রিদি ৬ উইকেট শিকার করেন! সেই সাথে বিশ্বকাপে সবচেয়ে কম বয়সে পাঁচ উইকেট শিকারের রেকর্ড গড়েন তিনি। বিশ্বকাপে পাকিস্তানের হয়ে এটিই সেরা বোলিং ফিগার!

২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর, ইংল্যান্ডের ঘরোয়া লিগ টি-টোয়েন্টি লিগ ব্লাস্টে গ্রুপ পর্বের ফাইনালে হ্যাম্পাশায়ারের হয়ে শাহিন শাহ আফ্রিদি টানা চার বলে চার উইকেট নেন, সেই সাথে নিজের প্রথম হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন তিনি! ৪ ওভারে ১৯ রানে ৬ উইকেট শিকার করেন তিনি সেই ম্যাচে!

বাকি সময়টা তো স্রেফ ইতিহাস। পাকিস্তান সুপার লিগে (পিএসএল) অধিনায়ক হিসেবে জিতেছেন দু’টি শিরোপা। ফাস্ট বোলার কিংবা নেতা হিসেবে হয়ে উঠেছেন আরও বেশি পরিণত।

শাহিন শাহ আফ্রিদি ছোট থেকেই ওয়াসিম আকরামকে ফলো করতেন এবং তার মতোই হতে চাইতেন। বেশ কিছু ম্যাচেই আগেই তিনি ওয়াসিম আকরাম থেকে পরামর্শ নিতেন। শাহিন আফ্রিদি একবার বলেছিলেন ওয়াসিম আকরাম ছাড়াও তার বড় ভাই রিয়াজ আফ্রিদি থেকে তিনি অনেক কিছুই শিখেছেন। গেল বিশ্বকাপে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে যেতে পারেনি পাকিস্তান, তবে শাহীন আফ্রিদির মতো লম্বা রেসের ঘোড়া ঠিকি খুজে পেয়েছে।

লাইন-লেন্থ, গতি, ইয়োর্কার কি পারেন না শাহীন? যে স্বপ্ন নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একটু একটু করে সেই স্বপ্ন বাস্তবে রুপ দিচ্ছেন তিনি। বিশ্ব ক্রিকেটে শাহিন আফ্রিদি এখন ব্যাটসম্যানদের জন্য এক আতংকের নাম! তার বিষাক্ত ইয়োর্কারে খেই হারিয়েছেন বড় বড় তারকা ক্রিকেটারেরা। মাত্র তো শুরু! কিন্তু এভাবে পারফরম্যান্স ধরে রাখতে পারলে বিশ্ব ক্রিকেটে এক সময় সেরাদের তালিকায় থাকবেন শাহিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link